শনিবার, ৯ মে, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে অন্তর কাঁদছে, এটাই আমাদের প্রার্থনা- নিখিলেশ বাবু


১. অবরুদ্ধ সময়ে একটা মৃত্যু সংবাদ কতটা বেদনার্ত করতে পারে তা টের পেলাম নিখিলেশ বাবুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে নটর ডেম পরিবারে বেগবান একটা ঝড় সাংঘাতিকভাবে আঘাত দিয়ে গেল। গতকাল ৭ মে, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ ১:৪৫ মিনিটে তিনি সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। নিখিলেশ ঘোষ নটর ডেম কলেজের বাংলা বিভাগের মধ্যবয়সী উদীয়মান শিক্ষক ছিলেন। ক্লাশ বন্ধের কারণে ৫২দিন পূর্বে আমাদের শেষ দেখা হয় তারপর প্রবেশ করি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের অনিশ্চিত জীবনকালে। নিখিলেশ বাবুর সাথে অনেক সময় এক সাথে কাটিয়েছি, পরীক্ষা-কুইজ সংক্রান্ত আলাপ করতে করতে, ছাত্রদের বিষয়ে আলাপ করতে করতে, ক্লাব সংক্রান্ত আলাপ করতে করতে, পিকনিকে এলোমেলো ঘুরাফেরা করতে করতে, কখনও ক্যান্টিনে চা-কাপ হাতে আড্ডা দিতে দিতে। এসব ছিল চলার পথে জীবনবোধ উজ্জীবিত রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টা, অবরুদ্ধ সময়ে এমুহূর্তে সবই এলোমেলো স্মৃতি হয়ে রইল। খুব নীরবে চলে গেলেন আমাদের ধীর স্থির নিখিলেশ বাবু, তিনি ছিলেন আমার দেখা একজন ভদ্রলোক।

২. অবরুদ্ধ সময়ে এমন বেদনার সংবাদ শুনে মনে পড়েছে তার ছেলে নিলাভ্র এর মুখখানি। ভাবছি চঞ্চল দুরন্ত ছেলেটির অন্তরে না জানি কী ভীষণ ভয়ানক ঝড়টা বয়ে যাচ্ছে।হয়তো ছেলেটি হতভম্ব নির্বাক হয়ে আছে। প্রায়ই স্কুল শেষে বাবার কাছে চলে আসত, সারাক্ষণ দুষ্টুমিতে মেতে থাকত, বাবা-ছেলের দুষ্টুমি ভালই লাগত। প্রাণচঞ্চল ছেলেকে নিয়ে প্রায়ই টিম ভবনে নীচের তলায় আমরা অফিসে সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আলাপ করত। কখনও নিখিলেশবাবু চলে যেতেন ক্লাশে, তখন নিলাভ্র থাকত আশেপাশে দুষ্টুমিতে, আর অপেক্ষায় থাকত বাবা কখন ক্লাস শেষে বের হবে। এ অসময়ের বিচ্ছেদ আধ্যাত্মিক একাত্মতায় লালিত হবে ছেলেটির অন্তরে নিরন্তর। ভাবছি তার সহধর্মিনীর মনের অবস্থা, দু’তিন মাসের শিশু সন্তান নিয়ে কী সংকটময় ক্রান্তিকালটা অতিবাহিত করছে। ছেলে কাঁদছে, স্ত্রী কাঁদছে, আপনজনরা কাঁদছে, নটর ডেম পরিবারের আমরাও কাঁদছি। কারও চোখভেজা, কারও বুকফাটা, কারও অন্তর বিদীর্ণ, কারও আর্জিসমেত এই কান্নাই তাঁর নিকট আমাদের প্রার্থনা- হে দয়াময় ঈশ্বর, নিখিলেশ বাবুর প্রতি দয়া কর, তার পরিবারকে সান্ত্বনাদান কর। তাঁকে মিনতি জানাই, নিখিলেশ বাবু যেন চির সুখেই থাকে। অবরুদ্ধ সময়ে কলেজের পিয়ন ধর্মপ্রাণ খালেকভাইকে হারিয়েছি। তার আত্মার চিরকল্যাণ কামনায় প্রার্থনা করি।


৩. অবরুদ্ধ সময়ে বার্ধক্যজনিত ব্যধিতে দুর্বল যারা তারা কাঁদছে, যারা একাকী সেবাকেন্দ্রে আছে তারা কাঁদছে, যারা হাসপাতালে অসুস্থ অথবা নিজ বাড়িতে বিপদাপন্ন তারাও কাঁদছে। তারা কাঁদছে কারণ তাদের ভয় তারা জানে না আগামীকাল তাদের জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে। এ কান্নাই তাদের প্রার্থনা- হে ঈশ্বর, তুমিই একমাত্র ভরসা, আমাদের প্রতি দয়া কর। 

৪. অবরুদ্ধ সময়ে যারা বেকার অথবা যাদের স্থায়ী কোন আয়ের উৎস নেই, তারাও নীরবে কাঁদছে। যারা দিনমজুর অথবা অতি দরিদ্র তারাও কাঁদছে। কারণ তাদের ভয় কীভাবে আগামীকাল আপনজনদের মুখে খাবার যোগান দিবে। কারখানা শ্রমিক, অভিবাসী শ্রমিক,  পোশাক শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে কাঁদছে, বিক্ষোভে নেমে কাঁদছে। কারণ দুর্যোগে তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে না, আপনজনরা অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। অবরোধ, বিক্ষোভ, মিছিল আর আর্তচিৎকার সবই জীবন বাঁচানোর কান্না। সমবেত এ কান্না মালিক পক্ষের নিকট প্রার্থনা- আমাদের দয়া করুন, তবুও আপনজনদের জীবন বাঁচুক। তাদের কান্না- মানব মর্যাদা ও কাজের মর্যাদা সুরক্ষার আর্জি।  

৫. অবরুদ্ধ সময়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণে এ পর্যন্ত ২৭২,২৮৬জনের মুত্যু হয়েছে, তাদের স্বজনরা কাঁদছে।  সময়ে আমরাও কাঁদছি কারণ এ সময়ে আমাদের সকলেরই নিজেস্ব ভয় আছে, আমাদের ভয় আমরা জানি। আমার শ্রদ্ধেয় বাবাও পাঁচ বছরপূর্বে স্বর্গবাসী হয়েছেন, এ অবরুদ্ধ সময়ে তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে হবে। আপনজনরা অন্তরীণ সময়ে গভীরভাবে তার আত্মার স্বর্গসুখ কামনা করে প্রার্থনা করছি। একদিন বহুলোকের সঙ্গে খ্রিস্ট যিশু যখন জেরিখো ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তখন অন্ধ ভিক্ষুক বার্তিমেয় পথের ধারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল, আর বলছিল আমাকে দয়া করুন। যিশু তাকে বললেন- কী চাও তুমি, সে উত্তরে বলল- গুরদেব আমি যেন দেখতে পাই (মার্ক ১০:৪৬-৫২)। খ্রিস্ট যিশুর সমাধিস্থানে এসে মা মারীয়া কাঁদছিলেন। জীবন্ত যিশু দেখা দিয়ে তাঁকে বললেন- মা, কাঁদছ কেন? মারীয়া বললেন- দয়া করে বলুন কোথায় রেখেছেন তাঁকে (যোহন ২০:১১-১৮)। বার্তিমেয় কাঁদছে, সে প্রার্থনা করছে- যেন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। মা মারীয়া কাঁদছে, তিনিও প্রার্থনা করছেন- তাঁর সন্তানকে যেন ফিরে পায়। পোপ ফ্রান্সিস আহ্বান করেছেন- এমন সময়ে আমরা যেন ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখি এবং নিয়মিত প্রার্থনা করি। ক্রন্দনরত ভক্তদের অন্তরে তিনি জাগাবেন আত্মিক জীবনীশক্তি ও পরম ত্রাণশক্তি। তাঁর অনুগ্রহে তখনই ভক্তরা শক্তিমান হয়ে উঠবে। আস্থা রাখে যারা তাদের অন্তরে তিনি আশার জীবনীশক্তি জাগাবেন ।

৬. অবরুদ্ধ সময়ে পোপ ফ্রান্সিস আরও বলেছেন- করোনাভাইরাসে আক্রান্তে ক্ষতবিক্ষত বিশ্ব কাঁদছে, আক্রান্তদের আপনজনেরা কাঁদছে, যারা আক্রান্ত তারা কাঁদছে, যারা মারা গেছেন তাদের আপনজনরাও কাঁদছে। খ্রিস্ট যিশুর খুবই প্রিয় একযুবক লাজার মারা যাবার পরে তার বোন মার্থা, মারীয়া ও উপস্থিত লোকেরা কাঁদছে দেখে খ্রিস্ট যিশু অন্তর থেকে কেঁদে ফেললেন (যোহন ১১:৩৩-৩৫)।  খ্রিস্ট যিশু আজ আমাদের সাথে এ দুর্যোগ সময়ে কাঁদছেন, আমাদের জন্য পিতা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করছেন- তাঁর ভক্তরা যেন নিরাপদে থাকে। পোপ মহোদয় আমাদের সকলের কান্নার সাথী হয়ে আছেন। প্রতিদিন তিনি গভীরভাবে আমাদের জন্য চিন্তিত এবং নিয়মিত প্রার্থনা উৎসর্গ করছেন। পোপ মহোদয় আহ্বান করেছেন- আমরা সকলে যেমন কাঁদছি তেমনি আমাদের কান্না যেন পরস্পরের প্রতি ভালবাসায় পরিণত হয়। অন্যদের জন্য যেন প্রার্থনা করি, দয়া দেখাই ও মঙ্গল কাজ করি। আসুন, ক্রন্দনরত চোখে আর্তজনেরা আর্জি জানাই ঈশ্বরের কাছে- পীড়িতরা আরোগ্য পাক দ্রুত, চিরনিদ্রারত যারা তারা পাক স্বর্গে চিরসুখ, বেঁচে আছি যারা আমরা যেন সান্ত্বনা পাই ও সুরক্ষিত থাকি। নিখিলেশ বাবু, আপনি স্বর্গে সুখে থাকুন, আমাদের জন্য প্রার্থনা করবেন।


ছবি: Notre Dame College Alumni Association, facebook.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন