বুধবার, ১৩ মে, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে অনেকে গৃহসন্ত্রাসের শিকার


১. নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বাড়ির মালিক এক নারী চিকিৎসককে 'দুর্ব্যবহার' করে ভাড়াবাড়িতে ঢুকতে বারণ করেছে। তিনদিন উপজেলা সদরে একটি অসরকারি ক্লিনিকে অবস্থান করে পুলিশ সহায়তায় নারী চিকিৎসক বাড়িতে উঠেছে (১৭ এপ্রিল, বিডিনিউজ২৪.কম)। ঢাকায় সবুজবাগে এক বাড়ির মালিক এক চিকিৎসককে ভাড়াবাড়ি ছাড়তে নোটিশ দিয়েছে, চিকিৎসক টাঙ্গাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত। মালিক টেলিফোনে একজন কর্মরত নার্সকে রাত ১০টার পর ভাড়াবাড়িতে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছে । কর্মস্থলের কর্তৃপক্ষ বাড়ির মালিকের সাথে যোগাযোগ করলে উল্টো নার্সের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। অবশ্য দুদক ইতিমধ্যে বাড়ির মালিকদের এমন সব আচরণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর বাড়ির মালিকরা দুর্ব্যবহার করছে, যখন তখন হেনস্থা করছে ।  যা আমরা ইন্টারনেট সংবাদ থেকে জানতে পারছি। 

২. পৃথিবীর অনেক দেশ ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের করোনাভাইরাস দুর্যোগ মুহূর্তের অবদান বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছে, আমাদের মাননীয় প্রাধানমন্ত্রীও একই মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের সহযোগিতা পাচ্ছে, জাতির বীরসেনা সম্মানে খ্যাতি পাচ্ছে। পোপ মহোদয় তাদের সেবাকাজে অভিভূত হয়ে বলেছেন- ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মিশনারি ও পুলিশসহ সকল সেবাকর্মীরা দুর্যোগ সময়ের বীরসেনা ও সাধুসম সেবাকর্মীদল।

৩. বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম গত ৬ মে, ২০২০ খ্রিস্টাব্দে "ত্রাণ নিতে গিয়ে ধর্ষিত হচ্ছে শিশুরা" শিরোণামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। জরিপের তথ্য পুরোপুরি এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। জরিপ প্রকাশে সঞ্চালনা করেন 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' এর সিনিয়র মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর শাহানা হুদা। জরিপের তথ্য অনুযায়ী  এপ্রিল মাসে দেশের ২৭ জেলায় চার হাজার ২৪৯ জন নারী ও ৪৫৬ জন শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে, জরিপটি করেছে মোবাইল ফোনে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংস্থা । জরিপের তথ্য উপস্থাপন থেকে আরো জানা যাায়- এদের মধ্যে এক হাজার ৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪ জন শিশু প্রথমবারের মতো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শিশুদের মধ্যে ৯২ ভাগই তাদের বাবা-মা ও আত্মীয়দের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে।

৪. জরিপ থেকে জানা যায়- সংস্থার দুইটি প্রকল্পের কর্মএলাকার ২৪টি সহযোগী সংগঠন ২৭টি জেলার ৫৮ উপজেলার ৬০২টি গ্রাম ও চারটি সিটি কর্পোরেশনের ১৭ হাজার ২০৩ জন নারী ও শিশুদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী “স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৪৮ জন নারী, মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দুই হাজার আটজন, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৫ জন এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩০৮ জন নারী। এর বাইরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চারজন নারী, হত্যা করা হয়েছে একজনকে এবং যৌন হয়রানি করা হয়েছে ২০ জন নারীকে।" জরিপে আরো জানানো হয়- "উত্তরদাতা চার হাজার ২৫৯ শিশুর মধ্যে ৪২৪ জন শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর বাইরে বাল্যবিয়ে হয়েছে ৩৩টি এবং অন্যান্য সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪২টি। চারজন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ১৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়, অপহৃত  হয়েছে দুইজন, যৌন হয়রানির শিকার ১০ জন এবং রিলিফ নেয়ার সময় ১০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।"

৫. করোনাভাইরাসের এই সঙ্কটের মধ্যে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে পারিবারিক এবং অন্যান্য সহিংসতা প্রতিরোধ, সহায়তা দিতেই জরিপটি চালানো হয় বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম আরও বলেছেন- "লকডাউনের কারণে ইনডেপথ জরিপ করা সম্ভব হয়নি, সেজন্য টেলিফোনে করেছি। লকডাউনে পারিবারিক নির্যাতনের অবস্থা ও কি ধরণের নির্যাতন হচ্ছে তা জানতে চেয়েছি। তাদের কি ধরণের সাপোর্ট দেওয়া যায় সেটিও জানতে চেয়েছি।" তারা আরও বলেছেন- ‍‍"সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুরা যেন ফোন করে দ্রুত সহযোগিতা পায় সেজন্য সরকারি হেল্প লাইনগুলো আরও কার্যকর রাখার সুপারিশ করা হয়। সহিংসতার কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হওয়া নারীদের সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় পাওয়ার ব্যবস্থা করা ও অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছে সংগঠনটি। এছাড়া মহামারী পরিস্থিতিতেও নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চালু রাখতে ‘ভার্চুয়াল কোর্ট অর্ডিন্যান্স’ দ্রুত রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়।"

৬. এসব গৃহসন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে, সেটা যত ছোট পরিসরেই থাকুক না কেন। অন্যথায় করোনাভাইরাস বিপর্যয় সামাজিক বিপর্যয়ে পরিণত হওয়া আশংকা থেকে যায়। তাতে বিপর্যয় আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ দুর্গতি সময়ে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, "আমি এই মুহুর্তে আপনাদের সাথে স্মরণ করতে চাই  সেইসব নারীদের, যারা এই স্বাস্থ্য সংকটকালে অন্যদের দেখাশোনা করছেন, নারী ডাক্তার, নার্স, প্রশাসনিক কর্মী,  জেলখানার প্রহরী, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানকর্মী এবং মা-বোনেরা যারা পরিবারে সন্তান, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের সাথে নিজেরাও বন্দি হয়ে আছেন।" পোপ আশংকা  প্রকাশ করে আরো বলেছেন- এই গৃহবন্দি সময়ে নারীরা গৃহসন্ত্রাসের শিকার হতে পারে। পোপ ফ্রান্সিস আরো বলেছেন- "নারীরা যে সব সংকট মোকাবেলা ক’রে এমন অবস্থায় বসবাস করছেন, তা তাদের জন্য অত্যন্ত ভারী দায়িত্ব, ফলে তাদের উপর সন্ত্রাসের একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।" আসুন, আমরা সচেতন হই, মানবিক সমাজ গড়ি।



ছবি: ইন্টানেট সংগৃহীত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন