বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে মানবিক আচরণ করি


১. এ দুর্যোগ সময়ে আমরা দেখছি- কিছু লোকজনের আচার-আচরণে মানবিক বিপর্যয়ের পদচিহ্ন অন্যদিকে অনেক হৃদয়বান লোকজনের দায়িত্বশীল মানবিক আচরণ। সংবাদ থেকে নেয়া কিছু ঘটনা আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারি এবং সদ্বিবেচনা ব্যবহার করে যা সঙ্গতিপূর্ণ, বাস্তবধর্মী ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারি। দেশের দক্ষিণ এলাকা গোপালগঞ্জের একজন স্বাস্থ্যকর্মী যুবতীনারী; সে হাওড় এলাকার সাধারণ, সহজ, সরল, অতি দরিদ্র পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যা। আপনজনদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ঢাকা শহরে একটি অ-সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে একসময় হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ ঘোষণা করে, কিছুটা বাধ্য হয়ে সে লকডাউন উপেক্ষা করে অনেক কষ্টে গ্রামে আপনজনদের কাজে চলে আসে। দুর্গত সময়ে মেয়েকে কাছে পেয়ে আপনজনরাও খুশী। কিন্তু সামাজিক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের কাছে তারা হেরে যায়, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার হুকুমে লকডাউন হিসেবে তালপাতার 'ঝুপড়িবন্দি' হয় মেয়েটি। বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি ও কাদাময় পুকুরধারে ভয়ে আতঙ্কে মেয়েটির লকডাউন জীবন শুরু হয়। পরিবারের আপনজনদের জীবন বাঁচাতে যুবতী মেয়ে ঝুঁকি নিয়ে শহরে কাজে গিয়েছে, এখন দুর্যোগে নিজের জীবন বাাঁচাতে ঝুঁকিপূর্ণ এ দুর্গতি গ্রহণ করেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সময়ে সৃষ্টিকর্তা পরমকরুণা দেখিয়েছেন,  মেয়েটিকে বড় ক্ষতির আশংকা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রক্ষা করেছে। মেয়েটির জন্য আপনজনদের পাশে স্থানীয় প্রশাসন টিনের একচালা তৈরি করে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একদিকে সমাজের কিছু মানুষের নিষ্ঠুর অবস্থান অন্যদিকে একই সমাজের মানুষদের দয়াশীল মানবিক আচরণ; এসব আমরা প্রত্যক্ষ করছি এ দুর্যোগ মুহূর্তে।

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাগড়াছড়ির একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে কোথাও চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে। তার ভাই জানিয়েছে- দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিল তার ভাই। ভারতেও সে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল। দেশে ফিরে আবারও ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে কোথাও চিকিৎসা না পেয়ে খাগড়াছড়ির আগাশিলং পাড়ার নিজ ঘরে তার মৃত্যু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়টি খোঁজখবর নিয়েছেন, ডাক্তারদের জবাবদিহিতা চেয়েছেন।

৩. আমরা খবরে পড়েছি চাঁদপুরের অতি দরিদ্র বৃদ্ধ অভিবাসী শ্রমিক ঢাকা কেরানিগঞ্জে কারখানা মজুর ছিল। অসুস্থতা অনুভব করলে নিজ গ্রামে বাড়িতে ফিরে যায়। তার গ্রামের বাড়িতে কেউ বসবাস করে না; স্ত্রী  আগেই মারা গেছে। কিন্তু সামাজিক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের কারণে নিজের ঘরে আশ্রয় নিতে পারেনি। অবশেষে পাশের গ্রামে একমাত্র মেয়ে শশুরবাড়িতে যায়, কিন্তু মেয়ের আপনজনরা তাকে আশ্রয় দিতে রাজি হননি। অবশেষে তারা বৃদ্ধকে পাশের ঈদগাহ্ মাঠে ফেলে আসে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণা, স্থানীয় প্রশাসন বৃদ্ধকে তাদের আশ্রয়ে নিয়েছে।  অন্য আরেকজন বাবার মৃত্যু হলে তার মৃত্যুর সনদ নিয়ে মৃতদেহ হাসপাতালে ফেলেই চলে এসেছে আপন সন্তানরা। বাবার পেনশনের টাকা তোলার জন্য ছেলেমেয়েরা হয়তো মৃত্যুর সনদ তুলে নিয়েছে।  

৪. মা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে শেরপুরের নালিতাবাড়ি যাবার পথে সখিপুরের জঙ্গলে অসুস্থ মাকে ফেলে আসে মেয়ের জামাইসহ অন্যরা। সারারাত সেই মায়ের আর্তচিৎকার পথের কুকুর আর গাছের পাখি ছাড়া আর কারও কানে পৌঁচ্ছেনি। পরদিন এলাকাবাসী ও পথচারীরা চিৎকার শুনে খবর দিলে পুলিশ উদ্ধার করে বিপদাপন্ন নারীকে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে পটুয়াখালির রাঙ্গাবালির এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে রাস্তায় ফেলে যায় আপনজনরা। স্বামী পরিত্যক্তা অতি বিপদাপন্ন নারী সারারাত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত কাটায় খোলা আকাশের নীচে। উপজেলা কর্মকর্তা এবং ওসি খবর পেয়ে নারীকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে; পরে তার স্বজনদের কাছেই ফেরত পাঠায়।

৫. করোনাভাইরাস আক্রান্ত না হয়েও পাঁচ হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন এক প্রকৌশলী। পারিবারিক সূত্র জানায়- তার বংশগত হাপানি ও অ্যাজমা রোগ ছিল। সাভার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ পাঁচ হাসপাতালে সে চিকিৎসার জন্য ঘুরেছে। আত্মীয়স্বজন অভিযোগ করেছে- সাভার উপজেলা এলাকায়  করোনাভাইরাস সন্দেহে চিকিৎসা না দিয়ে আনসার ডেকে জোর করে এক হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। তার মৃত্যুর পর তার এক প্রতিবেশীসহ তার বাড়ি প্রশাসন লকডাউন করে দেয় ।

৭. সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের এক ইটভাটা শ্রমিক জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যান। তার মরদেহ দাফনের জন্য গ্রামের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের খাটিয়া নিতে বাধা দেয়  গ্রামবাসী। বাধ্য হয়ে মৃতের বাবা ও দুই ভাই মৃতদেহ নিজেদের কাঁধে বয়ে নিয়ে যায় এবং দাফনের ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের ভয়ে মৃত ব্যক্তির সৎকারে যখন ছেলেমেয়েসহ অন্য আত্মীয় স্বজন আসেনি এবং কেউই ধর্মীয় আচার পরিচালনা করতে রাজি হননি;  তখন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী নিজ কাঁধে খাটিয়া তুলে সহকর্মীদের সাথে নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেছেন। 

৮. তাঁর মতই দয়ালু হতে সৃষ্টিকর্তা আমাদের আহ্বান করেন; এই অভিন্ন বসতবাটির সকল জীবনের রক্ষণাবেক্ষণ করা তাঁর প্রদত্ত দায়িত্ব। আমাদের মানবিক আচরণ ও কাজসমূহের ভিত্তি তিনটি ঐশগুণের সমন্বয়; এগুলো হলো- বিশ্বাস, আশা ও ভালবাসা। আমাদের কাজে বিশ্বাস, আশা ও ভালবাসা প্রকাশকে দয়া, দয়ার কাজ বা দয়াশীলতা বলে থাকি। দয়ার কাজসমূহ দুই ভাগে চিন্তা করতে পারি- (ক) দৈহিক দয়ার কাজ: যেসব দয়ার কাজ অন্যের বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণে সহায়ক; যেমন- অতি দরিদ্র-বৃদ্ধ-বিপদাপন্নদের সাহায্য করা, অনাথদের ভরণপোষণ করা, মৃতের সৎকার করা ইত্যাদি এবং (খ) আধ্যাত্মিক দয়ার কাজ: যেসব দয়ার কাজ অন্যের মন ও হৃদয়ের অভাব প্রয়োজন পূরণ করে থাকে; যেমন- প্রার্থনা করা, সৎ জীবন যাপন করা, সুপরামর্শ দেওয়া, অন্যের দুঃখ-কষ্টে একাত্মতা প্রকাশ করা ইত্যাদি। প্রতিদিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দয়ার কাজ আমাদের মানবজীবন অর্থপূর্ণ করে; দয়ায় মানুষ হতে সহায়তা করে, আমরা দয়ালু হয়ে উঠি। আমাদের কিছু কিছু দয়াশীলতা আমাদের পরিবার, পরিবেশ, কর্মস্থল, আমাদের সমাজবদ্ধ জীবনে রূপান্তর এনে দিতে পারে। এইজন্যই আমরা হয়ে উঠেছি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম। এ দুর্গতিতে শুধুই মানবিক লোকজনে ও তাদের দয়ার কাজে ভরে উঠুক দেশ।


(ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন