১. এই দুর্যোগ সময়ে একজন বিশপ মহোদয়ের সাথে ফোনে আলাপ হয়েছে। বিশপ হাউজের কাছাকাছি কিছু অভিবাসী দিনমজুর পরিবারের সাথে আমি আগে থেকে পরিচিত। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়ে পরিবারের লোকদের প্রসঙ্গে আসলে তিনি জানালেন- বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামাগ্রী নিজেরা প্যাকিং করে ঘরে ঘরে পৌঁচ্ছে দিচ্ছেন। এভাবে দুর্যোগ মুহূর্তে খাদ্য ও সুরক্ষাসামগ্রী পথশিশুদের কাছেও নিয়ে যাচ্ছেন। নিজেই জড়িত থেকে তাঁর হাউজের আসেপাশে প্রতিবেশী অভাবী ভাইবোনদেরও এভাবেই খাদ্য ও সুরক্ষাসামাগ্রী পৌঁচ্ছে দিচ্ছেন। এমন কঠিন সময়ে অভাবী লোকদের সাথে কিছু সহভাগিতা করাটা ভীষণ আনন্দ ও পরিতৃপ্তির বিষয়। বাইবেলে খ্রিস্ট যিশু শিষ্যদের বলেছেন- তোমরা নিজেরা বরং ওদের খেতে দাও, তোমাদের ক’খানা রুটি আছে, একবার দেখে এসো তো। তিনি উত্তম মেষ পালক, শিষ্যদেরও পালক হতে নির্দেশ দিয়েছেন। একজন পালক নিজ হাতে খাদ্যসামগ্রীর ঝুড়ি অভুক্ত মেষদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, এটাই এ সময়ের অন্যতম পালকীয় সেবাকাজ।
২. পোপ ফ্রান্সিস নিজের উদ্যোগে দুর্গত এলাকা ও দেশে আক্রান্ত মানুষের জন্য ঔষধ, সুরক্ষাসামগ্রী ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পাঠাচ্ছেন। কারিতাস কিংবা ভাটিকান দাতব্য সংগঠন থাকা সত্ত্বেও নিজেই জড়িত থাকছেন। ভাটিকান সংবাদ সূত্র থেকে জেনেছি- গতকাল তিনি স্পেন দেশে সেবারত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য যথেষ্ট পরিমান চকোলেট পাঠিয়েছেন। পোপ মহোদয়ের এমনসব উপহার পেয়ে ভীষণ পরিশ্রম ও কষ্টের মাঝেও তারা নিশ্চয় প্রচুর আনন্দ পাবে। সেবাকর্মীদের পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত মনে তিনি হয়তো এই আনন্দটুকুই দিতে চেয়েছেন। অনেকেই নিজেদের অবস্থানে থেকে অভাবী লোকজনের পাশে থাকছেন। যখন দেখি ছোট ছোট সংগঠন, যুবক্লাব, কয়েকজন বন্ধু মিলে অথবা একটি পরিবার অভাবী বস্তিপরিবার, জেলেপরিবার, বেদেপরিবার, অভিবাসী শ্রমিক ও দিনমজুর পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে তখন মনটা আনন্দে ভরে যায়।
৩. লকডাউন সময়ে আমরা দেখেছি হাট-বাজারগুলোতে বহুলোকের ভীড়। অনেকেই বলছি- করোনাভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হাট-বাজার। হাট-বাজারে জনসমুদ্র হ্রাসের জন্য সরকার ত্রাণ হিসেবে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে। তবে দেশে ক্ষুদ্র, মাঝারি বৃহদায়তন অ-সরকারি সাহায্য সংস্থাগুলো দেখছি কোটি কোটি নগদ টাকা অভাবী লোকজনের নিকট বিতরণ করছে। কিছু কিছু সংস্থা কর্মীদের নিরাপত্তা বিষয়টি চিন্তা করে ‘বিকাশ’, ‘নগদ’ এসব অনলাইন ব্যাংকিং সেবার আশ্রয় নিয়েছে। একটি সিটির একজন কর্মকর্তাও নগদ টাকা ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করতে গিয়ে জনসেবায় হুড়াহুড়ি পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন, যা আমরা সংবাদে পড়েছি। ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে ত্রাণ হিসেবে নগদ টাকা হাতে পেয়ে অভাবী লোকেরা যখন তখন হাট-বাজারে যাচ্ছে। নিজের এলাকায় লকডাউন থাকায় পাশের হাট-বাজারে যাচ্ছে; ফলে করোনাভাইরাস বিস্তারের একটা সুযোগ থেকেই যাচ্ছে, সংকটের ক্ষত আরো গভীরতর হতেই পারে।
৪. খবরের কাগজ থেকে জেনিছি- ভারতের কেরালারাজ্যে অভাবী জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় সরকার স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় রাজ্যজুড়ে ১,২০০এর বেশি কমিউনিটি কিচেন কার্যক্রম শুরু করেছে। যেখানে প্রতিদিন আড়াই লাখ মানুষকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করছে। কিচেন থেকে ৯০ শতাংশের বেশি খাবার বিনামূল্যে দিচ্ছে, বাকী ১০ শতাংশ খাবার মাত্র ২৫ রুপিতে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। সেখানে প্রতি ১৫দিন পরপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি প্যাকেট ৮৭ লাখ পরিবারকে পৌঁছে দিচ্ছে। যার মধ্যে বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় ১৭ রকমের পণ্যসামগ্রী রয়েছে। তাছাড়া ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি ছিন্নমূল এবং গৃহহীন মানুষদের এই দুর্যোগ সময়ে পুনর্বাসন ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে । স্বেচ্ছাসেবকরা সামাজিক দূরত্ব ও নিজেদের সুরক্ষানীতি মেনেই সেবাকাজ করছে।যার ফলে জনগণ ত্রাণ নিতে বাসার বাইরে আসছে না, তারা ঘরেই থাকছে, না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। সমাজের সুরক্ষা নিশ্চিত থাকছে শতভাগ, সংক্রমণের হার খুবই কম।
৫. এ দুর্যোগ সময়ে স্থানীয় সরকার, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির সমন্বিত সহায়তায় রাজ্যজুড়ে কাজ করছে। একাজে স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে গ্রাম পঞ্চায়েত পর্যন্ত একসাথে কাজ করছে। কাজটি করতে সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষদের নিয়ে ৪ লাখ স্বেচ্ছাসেবক গঠন করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যকর্মী, ধর্মীয় নেত্রীবৃন্দ ও সমাজকর্মীরা একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লকডাউন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, সঙ্গনিঃরোধ, চিকিৎসা, সৎকার, জীবন রক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে। বিশ্বের মানুষ করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকানোর তাদের কর্মকৌশলকে দেখছে ‘কেরেলা মডেল’ হিসেবে। তারাতো মাণ্ডলিক ক্ষুদ্র সমাজের সমদায়িত্ববোধ চেতনায় ‘দেখা, বিশ্লেষণ করা ও কাজ করা’ এ কর্মনীতিই অনুসরণ করছে। এই সদ্বিবেবচনা এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে যা সঙ্গতিপূর্ণ, বাস্তবধর্মী ও দায়িত্বশীল। কেরালার প্রায় তিনকোটি জনগণের মধ্যে ১৮% শতাংশ জনগণ খ্রিস্টবিশ্বাসী; নাগরিকরা কেরালাকে ‘ঈশ্বরের আপন নগরী’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। অন্যদের ভালকাজ দেখে ও শুনে স্থানীয়ভাবে একসাথে সমন্বিত পদ্ধতিতে কাজ করার সময়টা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সেটা হতে পারে নিজের এলাকা, পাড়া, গ্রাম, উপজেলা, জেলা বা অঞ্চল হিসেবে। পোপ মহোদয় বলেছেন- দুর্যোগ সময়ে সেবাকাজে থাকতে হবে গভীর দরদবোধসহ মনোযোগ ও সৃজনশীল কর্মকৌশল। তবুও সেবাকাজ ও সুরক্ষা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হউক।
(লেখাটিতে পোপ ফ্রান্সিস এর অনুধ্যান বাণীসমূহ এবছর পাস্কা পর্বের সময়কালে তাঁর ধর্মোপদেশে প্রদত্ত ভাটিকান নিউজ ওয়েবপেইজ থেকে সংগৃহীত হয়েছে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন