সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে একাত্মতা কিংবা বিচ্ছিন্নতা - কিছু ঘটনা



১. ছবিটি ব্যবহার করেছি তা পবিত্র ক্রুশ সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ফা. বাসিল আন্তনী মরো'র স্বেচ্ছা 'একা অন্তরীণ' ধ্যান প্রার্থনা কাটানোর ঘর। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই সেখানে আমি গিয়েছি। তিনি মাঝে মাঝে ফ্রান্সের এক নিভৃত ছোট পল্লীর এই বাড়িতে প্রার্থনারত একা থাকতেন কিছু দিন।মানুষের জীবন এখন সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্নতা এবং বন্ধাবস্থা এই চারটি পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ লেখাটি যখন লিখছি তখন ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে মাইকিং করে সতর্কমূলক ঘোষণা দিচ্ছে- প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা বাড়াতে জনগণকে মসজিদসহ কোনো ধরণের ধর্মীয় উপাসনালয়ে উপস্থিত না হয়ে ঘরে প্রার্থনা করতে বলছে সরকার। অবরুদ্ধ সময়ে ঈশ্বরের সাথে আধ্যাত্মিক একাত্মতার কিছু ঘটনা ও অনুধ্যান তুলে ধরছি। আমার বিশ্বাস অনেকের ভাল লাগবে।

২. সবেমাত্র বাংলাদেশে কারাবন্দিদের আধ্যাত্মিক পরিচর্যার দায়িত্ব পেয়েছি। একটি কারাগারে বন্দিদের সাথে সাক্ষাতের সময় একজন বন্দি পবিত্র সাক্রামেন্ত গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে তার নয় বছরের বন্দিবাস অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু মামলার বিচারকাজ এখনও চলমান আছে। দীর্ঘসময় সে সাক্রামেন্ত গ্রহণ করতে পারেনি। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালেও কারাকর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া যায়নি। অনেক আলোচনা করে বড়দিনের সাক্ষাতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া গেল। তবে ত্রিশ মিনিট সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে । এদিকে বড়দিনের কেক কাটবেন কারাকর্তৃপক্ষ, এরপর অন্যান্য বন্দিদের মাঝে বড়দিনের উপহার বিতরণ করা হবে। ইতোমধ্যে খ্রিস্টভক্ত ১৮জন বন্দি ছোট দরবার কক্ষে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমে বন্দিরা পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহণ করেছে তারপর অল্প সময়ে খ্রিস্টযাগ সমাপ্ত হয়েছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহণের সময় সকলের চোখেজল দেখেছি, অন্যদিকে খ্রিস্টকে গ্রহণ করে সকলের চেহারায় আনন্দের প্রকাশ ছিল। বিদায়ের সময় খ্রিস্টভক্ত বন্দির অনুভূতি অনেকটা এমন ছিল- “মূল্যবান কিছু পেতে পেতে হঠাৎ যখন বঞ্চিত হই তখনই গুরুত্ব বুঝতে পারি।” বিভিন্ন কারাগারে বন্দিদের সাক্ষাৎকালে প্রায় সময় একই উপলব্ধি সহভাগিতা করেছে। কারাবন্দিরা নিয়মিত আধ্যাত্মিক অনুশীলন থেকে বঞ্চিত থাকে। তারা জানে না আবার কখন খ্রিস্টকে গ্রহণ করতে পারবে। তবে আধ্যাত্মিক একাত্মতায় তারা খ্রিস্টের সাথে যুক্তই আছে। কভিড-১৯ সংক্রমণ যেন দ্রুত বিস্তারিত না হয় সেজন্য আমরা নিজ বাড়িতে অন্তরীণ আছি। যা আমরা অবজ্ঞা করে চলতে পারছি না। এ সময়টা কিছুটা কারাবন্দির মতোই আছি, তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা কিছু করছি । এ সময় নিয়মিত খ্রিস্টযাগে যোগদান করে আধ্যাত্মিক অনুশীলন আমরা করতে পারছি না, কিন্তু আমরা খ্রিস্ট ও খ্রিস্টভক্তদের সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে একাত্মই থাকতে পারি।  

৩. খ্রিস্টীয় ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে অনেক সাধুজন আধ্যাত্মিক সাধনায় সন্ন্যাস জীবনযাপন করতেন। তারা স্বেচ্ছায় মরুপ্রান্তরে ছোট ছোট ঝুপড়িতে একা একা ধ্যানমগ্ন থাকতেন। পাশাপাশি ৫/৬জন সন্ন্যাসী অবস্থান করলেও পরস্পরের সাথে অতি প্রয়োজন ছাড়া দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না। একজন পথিক যাত্রাপথে পাশের সন্ন্যাসীর ঝুপড়ির সামনে ঝুড়িতে কিছু আঙ্গুর ফল রেখে গেল, এমনটি প্রচলিত ছিল। সন্ন্যাসী তার ঝুপড়ির সামনে সুস্বাদু আঙ্গুরের ঝুলি পেয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। তিনি চিন্তা করলেন- রাস্তা থেকে আমার ঝুপড়িই প্রথম। পথিকরা আমার কাছে যখন-তখন আবারও কিছু নিশ্চয়ই রাখবে। আমি বরং পাশের সন্ন্যাসীকে আঙ্গুরগুলো দিয়ে আসি। পাশেরজন তার ঝুপড়ির সামনে লোভনীয় আঙ্গুর দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি চিন্তা করলেন- বেশ ভালই হলো পাশের সন্ন্যাসী দেখছি কয়েকদিন যাবৎ অসুস্থ, আঙ্গুরগুলো এসময় তার সুস্থস্তার জন্য উপকারী হবে। এবার অসুস্থজন আঙ্গুরের ঝুড়ি পেয়ে ভাবলেন- আমার পাশে যুবক সবেমাত্র সন্ন্যাস জীবনে যোগ দিয়েছে তার নিশ্চয়ই ভালকিছু খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি আঙ্গুরের ঝুড়ি যুবকের ঝুপড়ির সামনে রেখে গেলেন। এদিকে যুবক সন্ন্যাসী চিন্তা করল- আমার সামনে অনেক সময় আছে; আমি বরং পাশের প্রবীন সন্ন্যাসীকে আঙ্গুরগুলো দিয়ে আসি। এবার প্রথম সন্ন্যাসী দেখলেন- ঝুড়ি ভর্তি লোভনীয় আঙ্গুর ফল তার ঝুপড়ির সামনেই আছে। সন্ন্যাসীরা ধ্যান-সাধনার উদ্দেশ্যে সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্ন থাকা এবং বন্ধাবস্থা স্বেচ্ছায়  গ্রহণ করেছেন। তথাপি তারা আধ্যাত্মিক একাত্মতায় পরস্পরের কাছে আছেন। বিভিন্ন কারণে মানুষ বিচ্ছিন্ন বা দূরত্বে থাকতে পারে। তবে পরস্পরের প্রতি যখন ভালবাসা থাকে, অন্যের উপকার করার মনোভাব থাকে এবং অন্যের জন্য মঙ্গলকাজ করে তখন আধ্যাত্মিক একাত্মতায় থাকতে পারি। 

৪. করোনাভাইরাসটি নির্মুল করার যুদ্ধসময়ে বিশ্বাসের ঐতিহ্যগত ‘আধ্যাত্মিক একাত্মতা’ অনুশীলন নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমানের আহ্বান। তৃতীয় শতাব্দীর প্লেগ মহামারীর সময়টা সাধু সিপ্রিয়ান মানুষের অন্তরে বিশ্বাস ও আশা জোরদারের সুযোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি প্রচুর সাহস এবং বিপুল আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘এটা কতই না আধ্যাত্মিক মহিমা’ যা ‘ধ্বংস ও মৃত্যুর আক্রমণ এর সামনে জীবন্ত বিশ্বাস নিয়ে অবিচল থাকা। ভয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ার পরিবর্তে বিশ্বাসে শক্তিশালী হতে ‘সুযোগটি আলিঙ্গন করা’ দরকার। আধ্যাত্মিক অনুশীলন হিসেবে পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ ও খ্রিস্টের উপস্থিতি অভিজ্ঞতা করার বিকল্প কিছুই নাই। তবে মহামারী সময়ে ‘আধ্যাত্মিক একাত্মতা’ প্রথমে অর্থহীন বিকল্প হিসেবে মনে হতে পারে অবশেষে নিজেরা অভিজ্ঞতা করতে পারব যে এটি সত্যিই ঈশ্বরের একটি অসাধারণ অনুগ্রহ। অনেক শতাব্দী পর্যন্ত সাধু ও ধর্মতত্ত্ববিদরা নিজেরা অভিজ্ঞতা করেছেন ও বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। আভিলার সাধ্বী তেরেজা অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন- যখন তুমি পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করতে পার না, খ্রিস্টকে গ্রহণ করার সুযোগ পাও না, তখন খ্রিস্টের সাথে ‘আধ্যাত্মিক একাত্মতা’ অভ্যাস করবে। তখন দেখবে খ্রিস্টের ভালবাসায় দিনে দিনে তুমি আপ্লুত হতে থাকবে। একা কারাবন্দি অবস্থায় ক্রুশভক্ত সাধু যোহন একটি কবিতায় লিখেছেন- জীবন্ত জলের ঝর্ণা বিশ্বাসীর অন্তরে সর্বদা সঞ্চারিত হয়, এমনকি বিশ্বাসের অন্ধকার সময়েও।  বুলগেরিয়ার একজন বিশপ বহু বছর আগে বলেছেন- তার দেশে কমিউনিস্ট নির্যাতনের সময়কালে অনেক পুরোহিত রাজপথে প্রাণ দিয়েছে অথবা কারাগারে বন্দি ছিল। এমন অবস্থায় পুরোহিত ছিল না। বিশ্বাসী খ্রিস্টভক্তগণ যখন পাপস্বীকার করতে ইচ্ছা করত তখন তাদের পরিচিত পুরোহিতের কবরে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে পাপস্বীকার করত।  

৫. মরুভুমিতে খ্রিস্ট যিশুর একাকী অভিজ্ঞতা ও তাঁর ধর্মনিষ্ঠার পরীক্ষা (মথি ৪:১-১১) ঘটনা আমার জানি। মরুপ্রান্তরে দীক্ষাগুরু যোহনের বাণী প্রচারের গল্পটি আমাদের স্মরণ আছে (৩:১-১০)।  ইহুদী ধর্মনেতাদের ভয়ে শিষ্যরা ‘দরজা বন্ধ করে’ একত্রে ছিল এবং তারা যিশুর দেখা পেয়েছে  (যোহন ২০:১০)। তারা অন্যান্য লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, 'একত্রে অন্তরীণ'  ছিল। বাইবেল আমরা পড়ি আরও একবার শিষ্যরা কীভাবে ‘একত্রে অন্তরীণ’ অবস্থায় সেই  ‘উপরের ঘরে’ ছিল । লক্ষণীয় বিষয় এবার তারা ভয়ে তাদের হৃদয় হিমশীতল হতে দেয়নি বরং পবিত্র আত্মার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল (শিষ্যচরিত ১:১২-১৪, ২: ১-১২)। পবিত্র বাইবেলে অন্ধ বার্তিমেয় (মার্ক ১১০:৪৬), অসুস্থ মহিলা, অনিহুদী স্ত্রীলোক (মার্ক ৭:২৪-৩০) এমন অনেকে সামাজিক কারণে যিশুর কাছে যেতে পারেনি। তবে তারা ঠিকই যিশুর নিরাময় কৃপা লাভ করেছেন কারণ তাঁর সাক্ষাৎ লাভের তাদের অন্তরে গভীর ইচ্ছা ছিল। যিশুর সাথে তারা আধ্যাত্মিক একাত্মতায় ছিল। অন্যদিকে করগ্রাহক ও পাপীরা (লুক ১৫:১-১০) গভীর আগ্রহ নিয়ে যিশুকে গ্রহণ করতে অপেক্ষা করেছে, যখন সুযোগ পেয়েছে তখন যিশুর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। হারানো ছেলে ‘বিচ্ছিন্ন  জীবনযাপন’  করে বাবার ভালবাসা আবিস্কার করেছে এবং অন্তরে আধ্যাত্মিক একাত্মতা জাগ্রত হয়েছে; অন্যদিকে বড়ছেলে একসঙ্গে বাবার বাড়িতে থেকেও অন্তরে বাবার ভালবাসায় একাত্ম হতে পারেনি (লুক:১৫:১১-৩২)। 

৬. বিচ্ছিন্নতা, অবরুদ্ধ থাকা, অন্তরীণ সময় খুব সহজেই আমাদের ভিতরে ভয়, ক্রোধ, তিক্ততা, অভিযোগ এবং হতাশার মনোভাব প্রবলভাবে প্রতিপালন করতে পারে। শিষ্যদের অন্তরীণ থাকার কী বিশেষত্ব ছিল যা তাদের অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করেছিল। আমরা পড়েছি কয়েকজন স্ত্রীলোক এবং যিশুর মা মারীয়ার সাথে শিষ্যরা একত্রে প্রার্থনারত ছিল’ (শিষ্যচরিত ১:১২-১৪)। প্রার্থনা আমাদের জন্য মহা আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন সময় দেখি ও অভিজ্ঞতা করছি। একটি অন্ধকার ও বিরক্তকর অভিজ্ঞতা যা আমাদের কাছে অভিশাপের মত হতে পার। ঐ মুহূর্তে প্রার্থনা আমাদের জীবনে গভীর অভ্যন্তরীণ রূপান্তর আনে, শান্তির সূচনা করে। এমন কী কিছু সময় পরে অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আর্শীবাদের অভিজ্ঞতা করতে পারি। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও মহা ব্যস্ততা থেকে বাধ্য হয়ে দূরে আছি যেখানে আমরা  ‘বিশ্বটা অবরুদ্ধ’  বা  ‘পৃথিবীটা মনেস্টারি’  ভাবছি। এমনও হতে পারে অবশেষে সৃষ্টিকর্তা বিশ্বের এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হুমকি স্বরূপ ঘাতক ভাইরাসটি দুনিয়া থেকে নির্মুল করবেন। আমাদের বিশ্ব, আমাদের সমাজ, আমাদের মণ্ডলী হয়ে উঠবে পুনর্নবীকরণ, ব্যাপক রূপান্তরিত যা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।  

৭. ঘরবন্দি অবস্থায় আমরাও প্রেরিতশিষ্যদের ও মা মারীয়ার মত প্রার্থনারত থাকতে পারি। এমন আধ্যাত্মিক একাত্মতা অনুশীলন করে নিজে রূপান্তরিত হতে পারি ও  অন্যকে রূপান্তরিত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারি। আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের বিশ্বাসের সাক্ষ্যদান হবে তখনই যখন- প্রার্থনা, ধ্যান, উপাসনা, ধর্মশিক্ষা ও সংস্কারীয় জীবনের প্রতি আমাদের অনুরাগ ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। খ্রিস্টীয় বিবাহ, যাজকীয় ও সন্ন্যাসব্রতী জীবনের আহবান সম্পর্কে নবচেতনা ও নবজাগরণ ঘটবে। স্থানীয়, ধর্মপ্রদেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মণ্ডলীর কর্মসূচী ও কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ বাড়বে। সামাজিক জীবনের সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ বাড়বে। দয়াকর্ম, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক  কর্মকান্ডের জন্য নতুন উদ্যোগ ও চেতনা সৃষ্টি হবে। খ্রিস্টবিশ্বাসে যাদের স্খলন ঘটেছে, তারা আবার খ্রিস্টীয় জীবনে ও মণ্ডলীর মিলন-সংযোগে ফিরে আসবে। আসুন, আমরা প্রার্থনা করি, অবিরত প্রার্থনা করি এবং খ্রিস্ট ও আপনজনদের সাথে আধ্যাত্মিক একাত্মতায় থাকি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন