বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে যুবকদের সাফল্যের দশ সূত্র


ওয়ারেন এডোয়ার্ড বাফেট একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিনিয়োগকারী, সুদক্ষ বক্তা ও জনহিতৈষী ব্যক্তি। অর্থ গৌরবে ও পদগৌরবে একজন সফল বিত্ত-বৈভবশালী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর পরিচিতি বিশ্বময়। বর্তমানে (২০১৯ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর নিট পরিসম্পদের পরিমান ৭৮.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।  ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষদের যে তালিকা প্রস্তুত করেন, সেখানে ওয়ারেন বাফেট তৃতীয় স্থান অধিকারী। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছেলেবেলা থেকেই ব্যবসার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। তাই মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি স্টক (শেয়ার) কিনে বিনিয়োগ করতে আরম্ভ করেন। কিশোরবেলায় তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে পত্রিকা বিক্রি করতেন। এমনকি চুইংগাম, কোকাকোলার বোতল বিক্রি করতেন তিনি। একসময় তিনি আয়ত্ত করে ফেলেন বিনিয়োগের উত্তম কলাকৌশল। বর্তমানে তাঁর পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ‘বার্কশাইর হেথওয়ে’ এর অধিনে ৬০টি কোম্পানি রয়েছে। তিনি প্রায় ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মানবকল্যাণ কর্মসূচিতে ব্যবহার করেছেন। 

২০১০ খ্রিস্টাব্দে আরেক শ্রেষ্ঠ বিত্তবান ব্যক্তিত্ব বিল গেটসকে সাথে নিয়ে সকল ধনকুবের ব্যবসায়ীদের নিজেদের সম্পদের অর্ধেক মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি সবসময় শিক্ষার্থী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের গুরুত্বপূর্ণ যতসব পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাঁর পরামর্শ বর্তমানে সাফল্যের সূত্র হিসেবে গৃহীত। তরুণ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তাঁর পরামর্শ থেকে সাফল্যের দশটি সূত্র এখানে আলোকপাত করা হল। যারা ব্যবসা করার জন্য চিন্তা ভাবনা করি অথবা যারা ব্যবসায়ী নই কিন্তু অন্য পেশাজীবি অথবা সমাজকল্যাণ কাজে জড়িত আমরাও ইচ্ছা করলে ওয়ারেন বাফেটের পরামর্শ অনুসরণ করে সাফল্যের আনন্দটুকু উপভোগ পারি।

১. খারাপ সময়ে ধৈর্য ধরা: বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তি যুগে তরুণ সমাজ কিছুটা অস্থির, দ্রুত ফলাফল পেতে আগ্রহী। অন্যথায় হতাশ-নিরাশ হয়ে পরে। ওয়ারেন বাফেটের অন্যতম প্রধান একটি পরামর্শ ‘ধৈর্য ধরুন।  ‌'এমনকি জীবনের খারাপ সময়েও’ । যা তিনি নিজের জীবন থেকে শিখেছেন। ধনকুবের এই ব্যবসায়ী জীবনে নিজের ব্যবসায়ে বেশ কয়েকবার অর্থনৈতিক মন্দা অভিজ্ঞতা করেছেন। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৪৩ কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে তিনি ‘ডেক্সার শ্যুজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান কিনেছিলেন। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে সেই কোম্পানিতে তাঁর ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলারের লোকসান হয়। তিনি ধৈর্যসহ মোকাবেলা করেছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সফলতার জন্য তিনি দুইটি সূত্র মনে রাখতে বলেন।  প্রথম সূত্র:  ‘কখনো হার মানা যাবে না’ আর দ্বিতীয় সূত্র:  ‘প্রথম সূত্রটা কখনো ভোলা যাবে না।’  তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শটি খুবই যুগোপযোগী ও কার্যকর। মন্দ সময়টি ধৈর্যসহ মোকাবেলা করে সাফল্য দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

২. সর্বদা জীবনের লক্ষ্যে স্থির থাকা: ওয়ারেন বাফেট বলেন- লক্ষ্য ঠিক রাখুন, যা করবেন তাতে পূর্ণ মনোনিবেশ করুন। ব্যবসার রোমাঞ্চে বুঁদ হয়ে কখনো ব্যবসায়িক বুদ্ধি হারালে চলবে না। সর্বদা সজাগ থাকতে হবে নিজের কাজের প্রতি। তিনি আরও বলেন,  ‘এমন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা যাবে না, যা আপনি বোঝেন না।’  ব্যক্তির লক্ষ্য,  মনোযোগ, উৎসাগ ও দক্ষতা যেখানে একীভূত হবে,  সেটিই তার ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে কাজের প্রতি আমাদের উৎসাহ প্রবল সেখানে আমাদের সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী।

৩. নিজের ওপর বিনিয়োগ অভ্যাস: নিজের একান্ত ব্যক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভর করে নিজের সাফল্য। ওয়ারেন বাফেট বলেন,  ‘প্রথমত নিজের দক্ষতা অর্জনের ওপর বিনিয়োগ করুন, দক্ষতা যত বাড়বে, ব্যবসাও তত সৃজনশীল হবে।’  দক্ষতা অর্জনে ব্যবহৃত অর্থ-সম্পদকে খরচ না ভেবে বরং বিনিয়োগ ভাবতে হবে। নিজের জন্য সময় দেওয়া যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এ কথা তিনি সর্বদা বলেছেন। তাঁর অভিমত হল,  ‘মাঝে-মধ্যেই আমি চুপচাপ বসে ভাবি। অনেকে বলতে পারেন এটা নিরর্থক। কিন্তু ব্যবসা ও বিনিয়োগ সমস্যা নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে।’  ব্যক্তিগত ধ্যান, অনুধ্যান, অনুধাবন, উপলদ্ধি নিয়ে নিয়মিত সময় কাটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অভ্যাস। সুতরাং ধ্যান করতে শিখতে হবে নিয়মিত, কিছু সময় সকাল বেলা। তবেই নিজেকে জানা যাবে, পেশার গতিবিধি বুঝা যাবে, কাজ মূল্যায়ন করা সহজ ও নিয়মিত হবে। 

৪. সৎ মানুষ সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করা: ওয়ারেন বাফেট নিজে নিজে সফল ব্যবসায়ী হননি।বেঞ্জামিন গ্রাহাম, ডেবিড ডড এবং ফিল ফিসার তাঁকে অনেক কলাকৌশল শিখিয়েছেন। সফলতার জন্য অনুপ্রেরণাদানকারী, এনিমেটর, শিক্ষক এবং ভাল সঙ্গী দরকার। তিনি বলেন, সৎলোকের সংস্পর্শে আসুন ও দক্ষ মানুষদের সাথে সময় কাটান। এমন মানুষদের সাথে সময় কাটান, যাঁরা আপনার চেয়ে দক্ষ। আপনার সাথে যারা কাজ করেন তাদের আচার-ব্যবহার যেন ভালো হয় এবং তা যেন আপনাকে প্রভাবিত করে। ব্যবসার ক্ষেত্রে ওয়ারেন বাফেটের মূলমন্ত্র এটিই। তিনি মনে করেন, মানুষের সততা হল অন্যতম একটি বড় গুণ। সবার মধ্যে এই গুণ প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। যারা ব্যবসার ক্ষেত্রে সৎ, যাদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখা যায় সেই সব মানুষদের আশেপাশে রাখতে হবে।  যাদের সাথে তাঁর বোঝাপড়া ভালো তাদের সঙ্গেই তিনি দীর্ঘদিন ব্যবসা করে আসছেন।

৫. অবিরত পড়ার অভ্যাস করা: একজন নিয়মিত পাঠক হিসেবে এই ধনকুবের ব্যবসায়ীর বেশ সুনাম আছে। অবসর কাটে তাঁর বই পড়ে। অবসরের ৮০ ভাগ সময় তিনি বই পড়ে অতিবাহিত করেন। তরুণ উদ্যোক্তাদের তিনি যে বইসমূহ পড়তে উৎসাহ দিয়ে থাকেন তার মধ্যে ‘বিজনেস অ্যাডভেঞ্চার’, ‘দ্য এসেস অব ওয়ারেন বাফেট’ এবং ‘দ্য ইন্টেলিজেন্টর’ অন্যতম। এইচবিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এখনো দিনের পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা তিনি বই পড়ে অতিবাহিত করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সম্ভব হলে ৫০০ পৃষ্ঠা পড়ো।’ জ্ঞান হলো ‘চক্রবৃদ্ধি সুদ’ এর মতো- ‘যত পড়বে, তত বাড়বে।’

৬. সমাজের জন্য ভাল কাজ করা: তিনি বলেন, আমরা সমাজে বসবাস করি। সমাজ ভাল থাকলে আমরা সবাই ভাল থাকব। সমাজ থেকে আপনি যেমন পাচ্ছেন, তেমনি সমাজের জন্য কাজ করাও আপনার দায়িত্ব। তিনি বলেন, ‘বহু বছর আগে একজন একটা গাছ লাগিয়েছিল বলেই আজ একজন সেই গাছের ছায়া পাচ্ছে।’ পূর্বসূরিদের অবদান মনে রাখতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে কাজ করতে হবে। তাই তিনি মানবকল্যাণে নিজের সম্পদের বড় অংশ ব্যয় করে থাকেন।

৭. অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শিখা: ওয়ারেন বাফেটের মতে ব্যবসার ক্ষেত্রে অতীত ও ভবিষ্যৎ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অভিমত, ভবিষ্যৎটা পরিষ্কার দেখতে না পারলেও ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের অতীতটা স্পষ্ট দেখতে পাই। সেটাই আমাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তিনি আরো বলেন, ‘টাকা উপার্জনের এই খেলায় যদি অতীত ইতিহাসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতো, তবে লাইব্রেরিয়ানরাই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ হতেন।’ অতীত অভিজ্ঞতা উপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যতের সঠিক পরিকল্পনাটি করতে হবে। আর পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে হবে।

৮. আর্দশ ব্যক্তিকে অনুসরণ করা: একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনি কাকে অনুসরণ করছেন। আপনি কার মত হতে চান? গভীরভাবে ভেবে এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক করুন। ওয়ারেন বাফেট বলেন, ‘আমাকে বলো, তোমার চোখে নায়ক কে? আমি তোমার ভবিষ্যৎ কী হবে বলে দেব। তার মানে আপনি কাকে আদর্শ বলে মানেন, সেটাই নির্ধারণ করবে আপনার ভবিষ্যৎ। সেবাদান প্রতিষ্ঠান ‘দ্য অ্যাটল্যানটিক ফিলানথ্রপিস’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও ধনকুবের ব্যবসায়ী মি. চাক ফিইনি ছিলেন ওয়ারেন বাফেটের নায়ক। যিনি তাঁর পরিসম্পদ  নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, বারমুডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভিয়েতনাম দেশে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ন্যায্যতা-শান্তি এবং মানবাধিকার কর্মসূচিতে ব্যবহার করেছেন। 

৯. নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা: দ্য গ্রেট মাইন্ডস অব ইনভেস্টিং বইয়ের ভূমিকায় ওয়ারেন বাফেট লিখেছেন, ‘আমার বাবা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন, আমিও বিশ্বাস করি নিজেকে।’ তাঁর অভিমত, সব সময় তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। তিনি বলেন, ‘কত টাকা আয় হচ্ছে বা কত লাভ হচ্ছে, এই হিসাবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের ওপর বিশ্বাসটা অটুট আছে কি না।’ আত্মবিশ্বাসী হওয়াটা জীবনের জন্য খুবই দরকার।

১০. ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ: জীবনে তিনি যে শতভাগ সাফল্য পেয়েছেন, তা নয়। এমনকি ব্যবসায়িক জীবনে তিনি বড় বড় ভুল করেছেন। তবে ভুল থেকে তিনি শিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনের ভুলগুলো মনে রেখে তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দেন ওয়ারেন বাফেট। তাঁর অভিমত, ভুলগুলোর কথা নিজের সন্তানদের, বন্ধুদের, আপনজনদের জানানো উচিত। যেন তারা একই ভুল না করে।

লেখাটি যখন লিখছি তখন রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে নদীপথে ওয়াটারবাসে একা বরিশাল যাচ্ছি।সকালের রোদে নদীর জলে গাংচিল দলের উচ্ছ্বাস দেখছি আর লিখছি। ভালই লাগছে। বড়সড় জাহাজ যেমন মন্থর গতিতে নদীতে এগিয়ে যাচ্ছে, আবার নদীর জলে তরতর করে চলছে ছোটখাটো জেলেনৌকা, পারাপার নৌকা। নদীর গতিবিধি বুঝে, নৌ-পথের নিয়ম-নীতি মেনে সবাই এগিয়ে চলছে নিজ নিজ গন্তব্যে। বাতাসের তীব্রতা যখন বাড়বে, মাঝি-মল্লা আরো বেশী মনোযোগ দিবে উত্তাল নদীতে নিজেকে নিরাপদ রাখতে, সুরক্ষা দিতে। আমাদের জীবনও তেমন, আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে হবে, অনুসরণ করতে হবে মৌলিক নীতি-নৈতিকতা। বিশ্বাস রাখতে হবে সৃষ্টিকর্তার উপর, আস্থা রাখতে হবে নিজের উপর। আমাদের কাজের মৌলিক প্রত্যাশা হল সমাজ সেবা ও মানবকল্যাণ। ওয়ারেন বাফেটসহ প্রায় সকল ধনকুবের ব্যবসায়ীরা তাদের পরিসম্পদের বিরাট অংশ মানবকল্যাণ কার্যক্রমে বিনিয়োজিত করেছেন। এমনি হোক আমাদের তরুণদের ধ্যান-জ্ঞান, স্বার্থপরতা ত্যাগ করে দয়া ও শান্তির জীবন গড়ি, সাফল্যের পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগ করি।


(ফটো সূত্র: ইটারনেট সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন