১. করোনাভাইরাসে পৃথিবী আক্রান্তের আজ ১০০ দিন। আমাদের অবরুদ্ধ বা লকডাউন আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া নয় বরং আমরা শিখেছি- এটাই সংক্রমণ কমানোর বৈজ্ঞানিক লড়াই। ভাইরাসটির সংক্রমণের শিকার হয়েছে ১৪ লাখের বেশি মানুষ, প্রাণ গেছে ৯০ হাজারের বেশি মানুষের। সংখ্যাগুলো বাড়ছে প্রতি মিনিটে। পাল্টে গেছে পৃথিবীর চেহারা- অচল করে দিয়েছে যোগাযোগ, অর্ধেক মানুষকে বন্দি করে ফেলেছে ঘরের মধ্যে। থামিয়ে দিয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। বাড়ছে গরীব মানুষের দুর্গতির দিন। এমন দুর্যোগের দিনে দেশের সরকার গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু অসৎ কর্মকর্তার দুর্নীতি এ দুর্যোগ সময়েও অব্যাহত রয়েছে। যা সংবাদ মাধ্যমসমূহের সুবাদে মানুষ জানতে পারছে (৯ এপ্রিল, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ, বিডিনিউজ২৪.কম)। এ সময়ে (৭ এপ্রিল) পোপ ফ্রান্সিসের কিছু ধর্মোপদেশ আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে।
২. গরীব লোকেরা সব সময়ই আমাদের মাঝে আছে। পবিত্র বাইবেলে লাজারের বোন বিশুদ্ধ ব্যয়বহুল সুগন্ধযুক্ত তেল যিশুর পায়ে মাখিয়ে দিয়েছিলে। তখন যুদা ইস্কারিয়োৎ ক্ষোভ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে যিশু বিনম্র কন্ঠে বলেছেন “গরিব লোকদের তোমরা তো সব সময়ই কাছে পাবে” (যোহন ১১২:৮)। পোপ ফ্রান্সিস যিশুর এই কথার গভীরে মনোনিবেশ করে বলেছেন- “আপনারা সর্বদা গরীবদের সাথে থাকবেন।” তারা আমাদের মধ্যেই বসবাস করছে।
৩. অবিশ্বস্ত কর্মকর্তা বর্তমানেও আমাদের মাঝে আছে। আমরা শুনছি এমন দুর্গতির দিনে কিছু কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের অপকর্মের চিত্র। গরীরদের জন্য সরকারি অনুদান চাল-ডাল আত্মসাৎ করছে। বাইবেলে যুদাস গরীবদের কথা বলেছে, তবে তার নিকট গরীবরা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যুদাসের নিকট টাকাকড়ির গুরুত্ব বেশী ছিল। সে টাকাকড়ির যত্ন নিত। সকলের সম্মিলিত টাকার থলিটা সে রাখত, আসলে সে ছিল চোর। পোপ মহোদয় বলেছন- সব সময়ই এমন মানুষ আছে যাদের মধ্যে একই বৈশিষ্ট্যসমূহ আছে। তিনি আরও বলেছেন, “অবিশ্বস্ত কর্মকর্তার (যুদাসের) গল্পটি বর্তমানেও বিদ্যমান আছে। তারা আমাদের আশেপাশে আছে, এমনটি উচ্চ স্তরেও। আমরা যদি দাতব্য বা মানবকল্যাণ সংস্থার কথা ভাবি যাদের অনেকগুলিতে, কিছু কর্মকর্তা রয়েছে যারা কৌশলে ৪০% অনুদান গরীবদের জন্য বিতরণ করে আর ৬০% নিজেদের বেতনভাতা গ্রহণ করে থাকে। এটি গরীবদের নিকট থেকে টাকা নেয়ার একটা উপায়।” মানবকল্যাণের টাকাকড়ি বিভিন্ন কৌশলে কর্মকর্তাদের খ্যাতি, আত্মতুষ্টি, বিনোদন, উৎসব বা স্বার্থে ব্যবহার করাটাও অন্যদের অংশ আত্মসাৎ করা। মানবকল্যাণের নামে নিজের পদ-পদবির আকর্ষণ, গরিবদের জন্য সংগৃহীত টাকা বিতরণ না করে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা, আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানসমূহ জাগতিক ভোজ-উৎসবে পরিণত করাও এক প্রকার পৌত্তলিকতা, ঈশ্বরকে রেখে বস্তুবাদে আসক্ত হয়ে যাওয়া। যেমনটি ইস্রায়েল জাতি মরুপ্রান্তরে ঈশ্বরকে ভুলে তাঁরই অনুগ্রহের স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে তৈরি বাছুরের মূর্তিপূজা করেছিল (যাত্রাপুস্তক ৩২)।
৪. গরীবরা আমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে। অবরুদ্ধ সময়ে মধ্যবিত্তদের দুর্গতি ও অসহায়ত্বের চিত্র কখনও কখনও প্রকাশিত হচ্ছে। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- গরীবরা সব সময় আমাদের সাথে আছে যিশুর এ কথা খুবই সত্য। পোপ মহোদয় আরও বলেছেন- আমরা রাস্তার পাশে যে গরীব মানুষ দেখি তা একটা বৃহৎখন্ডের ক্ষুদ্রতম অংশমাত্র। গরীবদের বিরাটঅংশ আমরা চোখে দেখি না; তারা লুকানো গরীব মানুষ। আমরা দেখতে পাই না কারণ আমরা ‘ঔদাসীন্য সংস্কৃতি’ চর্চা করি। যা তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। প্রায়ই আমরা বলি, ‘না, তারা সংখ্যায় অনেক নয় বা সমাজে এখন আর গরীব মানুষ নাই।’ এমন মনোভাব কারও কারও আছে। তার মানে আমরা কেউ কেউ গরীবদের চোখে দেখতে পাই না। আমরা গরীবদের বাস্তবতা হ্রাস করে থাকি, এমনকি তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করি। কিন্তু তারা সংখ্যায় আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। পোপ মহোদয় বলেছেন- এমনকি যারা গরীবদের উপস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন নয় তারাও গরীবদের গণ্য করে- “একটি শহরের অলংকার বা মূর্তিগুলোর মতো, একটা সাধারণ বিষয় হিসেবে।”
৫. কিছু মানুষ আর্থিক বৈষম্যের শিকার। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, অনেক দরিদ্র মানুষ অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থার বৈষম্যের শিকার। তবে তারা আর্থিক সাহায্য চাইতে খুব লজ্জা পায়। তাদের চাকুরি থাকলেও মাসের শেষে আর্থিক সংকট মোকাবেলার লড়াই করতেই হয় । পোপ মহোদয় আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের আর্চবিশপ থাকার সময়কালের একটি ঘটনা বলেছেন- একবার একজন লোক তাঁকে একটি পরিত্যাক্ত কারখানার কথা বলেছে। সেখানে ১৫টি পরিবার কয়েক মাস যাবৎ বসবাস করে আসছে। তিনি একদিন সেখানে গেলেন এবং দেখলেন কারখানার একটি অংশে বাচ্চাদের নিয়ে পরিবারগুলো বসবাস করছে। তিনি তাকিয়ে দেখলেন প্রতিটি পরিবারে টেলিভিশন ও ভাল আসবাবপত্র রয়েছে যা মধ্যবিত্তের পরিচয় বহন করে। আর্থিক সংকটের লড়াই তাদের নিঃশেষ করেছে ফলে ঘরভাড়া দিতেও অপারগ ছিল। এরা নতুন ধরনের গরীব যারা আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় ঘর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যায্য অর্থনীতি বা আর্থিক ব্যবস্থা তাদের এ অবস্থায় ফেলেছে। আমরা হয়তো তাদেরই মধ্যবিত্ত হিসেবে জানি, তারা আমাদের মাধ্যে লুক্কায়িত গরীব। বহুবিধ আর্থিক সংকট কিংবা দুর্যোগে কিংবা অর্জিত মুনাফার অসময় বন্টনের কারণে এদের সংখ্যা দেশে বাড়তেই থাকে।
৬. তিনি সব সময় গরীবদের মাঝে উপস্থিত আছেন। শেষবিচারের দিনে সৃষ্টিকর্তা প্রশ্ন করবেন- ‘গরীবদের সাথে কেমন ব্যবহার করেছি? তাদের কি খেতে দিয়েছ? তুমি কি কারাগারে বন্দিদের ও যারা অসুস্থ তাদের হাসপাতালে দেখতে গিয়েছ? তুমি কি বিধবা এবং এতিমদের সাহায্য করেছ?’ কারণ আমি সেখানেই ছিলাম। আমরা যদি আজ গরীবদের উপেক্ষা করি, তাদের একপাশে ফেলে রেখে এমন আচরণ করি যে তাদের অস্তিত্বই নেই। তবে তিনি বিচারের দিন আমাদেরও অগ্রাহ্য করবেন। যিশু যখন বলেছেন, “গরিব লোকদের তোমরা তো সব সময়ই কাছে পাবে।” পোপ মহোদয় বলেছেন- যিশু তখন বলেছেন, আমি সব সময় গরীবদের মধ্যে তোমাদের সাথে থাকব। আমি সেখানে উপস্থিত থাকব, আমাকে কাছে পাবে। আমরা গরীবদের সাথে থাকলে আমরাতো মঙ্গলসমাচারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছি। আসুন, নিজের সামর্থ অনুযায়ী এই দুর্যোগ ও অবরুদ্ধ সময়ে অন্যকে সাহায্য করি। যাদের দেখতে পাই শুধু তাদের নয় বরং যারা লুকানো গরীব অর্থাৎ মধ্যবিত্তদেরও সাথে থাকি। আমরা যিশুর সাথেই পথ চলি।
(ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন