বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে সংকট ও সম্ভাবনা


১. অবরুদ্ধ সময়ে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস ছোবলের বিপর্যয় থেকে সুরক্ষার জন্য পুরো বিশ্ব লড়ছে। যারা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত তারা ভীত সন্ত্রস্ত, যারা আপনজনদের হারিয়েছে তারা কাঁদছে আর পুরো বিশ্বের মানুষ ভীষণভাবে আতঙ্কিত। অতি অল্প সময়ে অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে, আমরা নিজ এলাকায় ঘরবন্দি হয়েছি। মানুষের সব জ্ঞান, সব বিজ্ঞান, যত থিওরি, যত উপদেশ, যত পরামর্শ শত্রুটিকে পরাস্ত করতে ব্যস্ত। এ যেন ধ্বংস ও মৃত্যু মুখোমুখি মানুষ জীবন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিজয় লাভের প্রাণপন চেষ্টা করছে। সকলের অন্তরে এমন গভীর এক ঐক্যমত, যা আমাদের জন্য প্রাণবন্ত এক আশার আলো।

২.  আমরা দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের বিজয় হবেই। একবার ভেবে দেখি- ভাইরাসটি যদি বাতাস বাহিত সংক্রমণ হয়ে মানুষকে আক্রান্ত করতো অথবা পানি বাহিত হয়ে মানুষের দেহে প্রবেশ করত, তবে মানুষের আর রক্ষা ছিল না। আমরা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতাম। তাই আমাদের অবস্থা একেবারেই বিপদাপন্ন নয়, সুরক্ষিত থাকার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।

৩. এই অদৃশ্য শত্রুকে পরাস্ত করার অস্ত্র ব্যয়বহুল হতে পারত। কিন্তু সাধারণ  কম খরচের সাবানেই বিশ্বব্যাপক সংক্রমক ভাইরাসটি পরাস্ত। আমরা জানতে পেরেছি কাপড় পরিষ্কারের ‌বাজারে 'পচা' ব্র্যান্ডের মত সাবান আরো কার্যকর। আমরা অতি কম খরচে মাস্ক ব্যবহার করেও সুরক্ষায় থাকতে পারি। সামাজিক দূরত্ব বজায়ে রেখেও অন্যকে সুরক্ষা দিতে পারি। ভাইরাসটি শিখিয়ে যাচ্ছে- দুর্যোগ সময়ে ধনী-গরীব সকল মানুষের বেঁচে থাকাটাই একটা অধিকার।

৪. আমরা জেনেছি ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে ও বংশবৃদ্ধি করতে মানুষকেই বেছে নেয়। যদি ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া অনুসরণে মশা, মাছি, পোকামাকড় আর কীটপতঙ্গকে বাহক হিসেবে বেছে  নিত তবে বাঁচার লড়াইটা আরো কষ্টকর হত। যদি ভাইরাসটি এইচআইভি ভাইরাসের মতো দীর্ঘ জীবনকাল ধরে রাখত তবে বহুসংখ্যক মানুষ বেঁচে থাকত ভাইরাস বহন করে। আমরা জেনে গেছি মাত্র ঘরবন্দি জীবন যাপন করে নিজেকে সুরক্ষা দিতে পারি। সময় অতিক্রমণে আক্রান্তরা আবার আপনজনদের স্বাভাবিক সান্নিধ্যে যেতে পারবে, জীবন আগের মতই হবে। তাই সংক্ষিপ্ত  ঘরবন্দি সময়ের বিচ্ছিন্নতা তো মিলনের তাগিদেই।

৫. অবরুদ্ধ সময়ে বৃদ্ধ, অতিদরিদ্র, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন, বিপদাপন্ন মানুষ আমাদর সমাজে আছে। আবার উদ্বাস্তু শ্রমিক, বাস্তুহারা, দৈনিক হাজিরা শ্রমিক তাদের হাজিরা দিনে খাবার নিশ্চিত, গরহাজিরা দিনে উপোস নিশ্চিত । তাছাড়া গরীবদের বিরাট অংশ আমরা চোখে দেখি না; তারা লুকানো গরীব মানুষ। এদের সকলেরই কার্যকর আরেকটা অদৃশ্য ভয় ‘খিদে’ সারাক্ষণ তাড়া করে। ঘরবন্দি, লকডাউন, অবরুদ্ধ, অন্তরীণ, সামাজিক দূরত্ব  তাদের জন্য বেদনার সময় এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী তাদের সাধ্যের বাইরের বিষয়। শুধু সরকারের ত্রাণ তাদের ভরসা, তাও তাদের পর্যন্ত অনেক সময় অপর্যাপ্ত ও অসময়ে পৌঁচ্ছে । তাই অসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানসহ অনেক ব্যক্তিগত ও ক্ষুদ্রদল এসব অভুক্ত মানুষদের কাছে যাচ্ছে। তাদের হাতে খাবার পৌঁচ্ছে দিচ্ছে, সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করছে। বস্তি, গণবাহন, স্টেশন ও রাস্তাঘাট জীবণুনাশক স্প্রে দিয়ে সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। এই দুর্যোগ সময়ে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা প্রকাশের এমন নিত্যনতুন দয়ার কাজ আমরা দেখছি। এটাই তো একটা মানবিক সমাজের নিদর্শন, দয়ার কাজে বিশ্বাসের প্রকাশ । 

৬. বিগত দিনে জাতি, ধর্ম, প্রাচীর রক্ষা এমনকি শান্তি রক্ষার নামে যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে। ভাইরাসটি সকল যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়েছে, অস্ত্রের শব্দ বন্ধ হয়ে পুরো বিশ্ব স্থবির হয়ে গেছে। নেতারা শিখেছে অস্ত্র দিয়ে মানুষ মারা যায়, ভাইরাস মারা যায় না। প্রাচীর দিয়ে মানুষের চলার পথ বন্ধ করা যায়, কিন্তু ভাইরাসটি প্রাচীর মানে না। কঠোর আইন করে সংখ্যালঘুদের দমিত করা যায়, কিন্তু ভাইরাসটি বিস্তার দমন করা যায় না। ভাইরাসটি শিখিয়েছে-  সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন এক বিশ্বমণ্ডল, এক অভিন্ন বসতবাটি। এটিকে রক্ষণাবেক্ষণ ও চাষবাস করে জীবনযাপন করতে তাঁর অনুগ্রহে আমরা দায়িত্ব পেয়েছি। ঘরবন্দি সময়ে এমন ভাবনা আমারদের মন সৃষ্টিকর্তার প্রতি  অফুরন্ত কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে।  

৭. অবরুদ্ধ সময়ে ইন্টারনেট সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি- স্ত্রীকে খুনের ঘটনা ফেসবুক লাইভস্ট্রিমিংয়ে এসে প্রচার করেছে। এমনসব নিষ্ঠুরতা, দুর্নীতি, চালচুরি, ডালচুরি, অন্যায় আমরা দেখছি; অন্যদিকে মনুষত্বের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ অসংখ্য ডাক্তার, নার্স, স্বেচ্ছাসেবক, ধর্মগুরু, মিশনারী এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষাবাহিনী মানবিক কাজে একাত্ম হয়েছে। একটু উপলব্ধি করি- এভাবে অসংখ্য অসহায় মানুষ সাড়া জীবন নিপীড়িত ও অত্যাচারিত; অন্যদিকে ভাইরাসটি আমাদের সকলের উপর সমানভাবে খুব অল্প সময় অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। নিপীড়িত মানুষের তুলনায় আমাদের কষ্ট ক্ষণিকের। মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার যুদ্ধটা আরো বেগবান করতে হবে, সেই চেতনা অন্তরে নিয়ে আমাদেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এটাই সাম্য, তখনই সমাজে আসবে শান্তি।

৮. ধর্ম পবিত্র, বিশ্বাস জীবন্ত, জীবন সুন্দর। সেই জীবন রক্ষার যুদ্ধে পুরো বিশ্বের মানুষ সক্রিয়। আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনিই আদি, তিনিই অন্ত। তিনিই সবের সূচনা, তিনিই সবের সমাপ্তি। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টির সেরা করেই সৃষ্টি করেছেন। তাই বেঁচে থাকাটা মানুষের একটা অধিকার। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার লড়ায়ে, তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। ঘরবন্দি সময়ে এটাই আমাদের আশা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন