সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি কিছু সুপারিশ


১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন- আপাতত কোনো স্কুল-কলেজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না, তবে জীবনযাপনের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করা যেতে পারে। সোমবার সকালে (বিডিনিউজ২৪.কম, এপ্রিল ২৭, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ) গণভবন থেকে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেন- "স্কুল এখন আমরা খুলব না। স্কুল কেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটাও খুলব না।"  তিনি আরো বলেছেন- "অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই স্কুল কলেজ সবই বন্ধ থাকবে যদি না করোনাভাইরাস তখনও অব্যাহত থাকে। যখন এটা থামবে আমরা তখনই খুলব। বেশি জনসমাগম যেন না হয়।"

২. ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন- পাঠদানের ধারাবাহিকতা রাখতে ২৯ মার্চ থেকে সংসদ টিভিতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়েছে, আর গত ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের ক্লাস শুরু হয় । এই ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে এসব বাড়ির কাজ দেখাতে হবে। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজের উপর প্রাপ্ত নম্বর তাদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং নিয়মিত ক্লাশ অনুসরণ করলে, খাতায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নোট নিতে থাকলে এবং তারিখভিত্তিক নিজেদের বাড়ির কাজ করে নির্দিষ্ট ফাইলে রাখলে ক্লাশ শুরু হলে সুবিধা হবে।

৩. সুতরাং শিক্ষার্থীরা কিছুদিন যাবৎ লেখাপড়ার প্রচলিত পদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন তবে শিক্ষাগ্রহণ থেকে কিন্তু পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন নয়। ইতোমধ্যে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় অনেকেই শিক্ষার আগ্রহটা চলমান রেখেছে। করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালীন সময়ে বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া চলমান রাখা দরকার। পোপ মহোদয় বলেছেন- এমন পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রা সচল রাখার জন্য মনোযোগিতা ও সৃজনশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ দুর্যোগে বদলে যাওয়া ‘নতুন স্বাভাবিক’ পরিস্থিতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতে হবে।

৪. বাসা, স্কুল, পড়া, বন্ধু এবং খেলাধুলা এসব স্বাভাবিক ছন্দময় জীবনের করোনাভাইরাসের কারণে ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থা শুরু হয়েছে ।  ছুটি ঘোষণা হলে প্রথমে বিষয়টা যতটা আনন্দের ছিল, তবে দিন গড়ানোর সাথে সাথে ততটা দখল করছে অস্থিরতা। বিশ্বজুড়ে পরিবার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য দিনের বেলা জীবনের ছন্দ বদলানো কঠিন হয়ে পরেছে,  বিশেষত যখন স্কুলের পাঠসমূহ ঘরে বসে চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মহামারীর দুর্যোগে বাবা-মা সন্তানকে জীবনের খুব মূল্যবান একটি দর্শনের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিতে পারে- প্রত্যেকের জীবনে বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন অনিশ্চয়তা আসবে এবং সেই অনিশ্চয়তার ভিতরেও জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

৫. শিক্ষার্থীদের অন্তরের ‘আশা’ সব সময় জাগ্রত রাখতে হবে, নিরাশ হওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে একদিকে করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বকে একটি বিরাট ট্র্যাজেডি ও বিঘ্নের মধ্যে ফেলেছে অন্যদিকে বিশ্বকে ট্র্যাজেডি জয় করতে একত্রিত করেছে। করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করতে বিশ্বজুড়ে মহামারী নিয়ে ‘একটা যুদ্ধ’ চলছে। এসময়ে বিশ্বের সব জ্ঞান, সব বিজ্ঞান, সকল পরামর্শ নিয়ে মানুষকে রক্ষা করার লড়াই চলমান আছে; মানবতার পক্ষে বিশ্ব একত্রে একমাত্র লক্ষ্য তৈরি করেছে। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য আশার আলো ও অনুপ্রেরণামূলক।

৬. প্রথমেই লেখাপড়ার নতুন অবস্থাটার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে, এজন্য একটি নিয়মিত সময়সূচী থাকলে খুবই সহায়ক হবে। বড়দের সহযোগিতা নিয়ে ‘একটি সৃজনশীল রুটিন’ প্রস্তুত করলে উপকার হবে। রুটিন মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও উঠা, নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস,  প্রার্থনা এবং বিষয়ভিত্তিক পড়ায় নিজেকে অভ্যস্ত করলে উপকার হবে। অবসর সময়ে সখের বিষয়সমূহ- ছবিআঁকা, গান-নাচ অনুশীলন, বইপড়া, খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার অভ্যাস করা যেতে পারে। নিজের একটা শৃঙ্খলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বাড়িতে অবস্থান করে কিছু শিখতে আরও বেশি শৃঙ্খলা প্রয়োজন। অভিভাবকবৃন্দ পাশে থেকে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সহযোগিতা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বিষয়াদি সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হবে। 

৭. পরিবারের একত্রে অনেকজন একসাথে সময় কাটছে তাই একে অপরকে পড়ালেখায় সহযোগিতা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষককে টেলিফোন বা অনলাইনে যোগযোগ করে কিছু সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে। তাছাড়া অনলাইনে সহপাঠীদের কাছ থেকে পড়াশুনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়তা প্রদান ও গ্রহণ করা যেতে পারে। 

৮. যাদের ঘরে কম্পিটার আছে তারা ঘরে বসে পরিবারের সদস্যদের সাথে কম্পিউটার সহভাগিতা করতে পারে। একে অন্যকে আরো বেশী সাহায্য করতে পারে। অনলাইনে যাদের সুযোগ আছে এই নতুন পদ্ধতিটার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে, অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যাদের কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুযোগ নাই তাদের জন্য অনেক অসুবিধা হবে। অনলাইন ক্লাশ ও সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি  হতে পারে, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য। এক্ষেত্রে যাদের সুযোগ আছে তারা বন্ধুদের মধ্যে যারা সুবিধা-বঞ্চিত তাদেরকের সহযোগিতা করার নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে পারে। একটাও একটি দয়ায়কাজ, তাতে বঞ্চিত অনেকে সুযোগ পাবে।

৯. এসময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভ্রান্ত ও বিচলিত হলে লেখাপড়া বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। টিভির খবর নির্দিষ্ট সময় ধরে দিনে শুধু এক-দুইবারের বেশি দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সেইসাথে এই মুহূর্তে স্মার্টফোন থেকে নেতিবাচক কোনো প্রচার শেয়ার না করাই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নেতিবাচক কোনো কিছু এলে সেটাকে আমরা ভাইরাসের মতো মুছে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। পড়ালেখা ও জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে মাত্র ফেসবুক ব্যবহার করা যায়, নির্ভরযোগ্য উৎস ব্যতিত বিভ্রান্তকর বার্তা মুছে পরিষ্কার করতে হবে। 

১০. শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ করছে একটি সাধারণ ভাইরাস নিয়ে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান একত্র করে দুর্দান্তভাবে গবেষণা করে যাচ্ছে। একটি বড় বিজয় দেখার জন্য বিশ্বের বিজ্ঞানীদের একসাথে কাজ করার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য একটা অনুপ্রেরণা হতে পারে। কখনও কখনও কঠিন বিষয়ে শেখার জন্য 'দলীয় পদ্ধতি' সত্যই কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ যা শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করতে পারে।

১১. নিজের তরফ থেকেই শিক্ষার্থীদের একটা উদ্যোগ নিতে হবে।  কেননা যেকোন রোগ থাকুক, খারাপ জিনিস থাকুক বা অসুস্থতা থাকুক সেটার ব্যাপারে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। বাসায় থেকে প্রথমেই নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, কেননা প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরছেন। তবুও ঘরে থাকতে হবে, সাবধানে থাকতে হবে।

১২. এমন সময় পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন-  আমরা আজ সেই শিক্ষকদের জন্য প্রার্থনা করছি যাদের ইন্টারনেট এবং অন্যান্য ডিজিটাল উপায়ে পাঠদানের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আমরা এমন শিক্ষার্থীদের জন্যও প্রার্থনা করি যাদের অভ্যাস না থাকা সত্ত্বেও বিকল্পভাবে পরীক্ষা দিতে হবে।  তিনি আহ্বান করেছেন- আমরাও যেন নিজেদের জন্য প্রার্থনা করি। তিনি আরো বলেছেন- আমরা খ্রিস্ট যিশুর নিকট প্রার্থনা করি তবে যিশুও আমাদের জন্য পিতা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করছেন। পোপ মহোদয় আরো বলেছেন- মে মাসে পরিবারের সকলে যখন একত্রে আছি তখন একত্রে রোজারীমালা প্রার্থনা করার একটা সুযোগ আছে; মা মারীয়ার মত অন্তর নিয়ে খ্রিস্টের মুখচ্ছবি ধ্যান করলে আমাদেরকে আরও আধ্যাত্মিক পরিবার হিসাবে একীভূত করে তুলবে এবং পরীক্ষার এই সময়টাকে কাটিয়ে উঠতে আমাদের সহায়তা করবে। মৌলিক প্রার্থনাসমূহ একত্রে আবৃত্তি ও বাইবেল পাঠ করতে করতে ছোটরা কিন্তু শিখার পাঠেই সম্পৃক্ত থাকবে। অভিভাবকদের একটু সৃজনশীল মনোযোগের কারণে করোনা প্রাদুর্ভাব সমাপ্ত হলেও আধ্যাত্মিক ফলটা রয়ে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন