মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে প্রকৃতি ফিরেছে শহরে


১. বৃষ্টিস্নাত শান্ত-নীরব একটি সকালে বাতাসে ভেসে আসা কোকিলে প্রাণভরা কোলাহল মনকে ছুঁয়ে যায়। এই দুর্যোগ সময়েও প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখছি- পাম গাছে সবুজ টিয়া পাখিদল অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত। ভাবছি, এই দুর্যোগে প্রতিটি মানুষের খাবারের নিশ্চয়তা থাকলে তবুও মানুষকে ঘরবন্দি রাখা সম্ভব হত। সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারত।একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে খেলার মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ূই পাখির বিচরণ, ভাত শালিক, পাতি কাক, হলদে পাখি, দোয়েল, ঘুঘু, জালালী কবুতর, ময়না, টুনটুনিসহ নানারকম পাখির দূরন্ত কোলাহল দেখতে ভালই লাগছে। গাছে গাছে আম, কাঁঠাল, লিচু, বেল, পেপে, কালো জাম, নারিকেল, লেবু আর কলা এই ব্যস্ততম আঙ্গিনায় সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব উপহার । সেই সাথে ডাটা, কপি, কচুশাক, কলমিশাক, পুদিনা পাতা, ধনে পাতা,  পালংশাক, লেটুস, টমেটো, ঢেড়স, শিম, বাধাকপি, গাজর ও পুঁইশাক এই অবরুদ্ধ দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রকৃতির এক অসীম ভালবাসা। পলাশ ফুলে রাঙ্গানো গাছগুলো এখন সবুজ পাতায় নবসাজে সেজেছে, কৃষ্ণচূড়ার সবুজ সমাহার ফুলেফুলে লাল হতে শুরু করেছে। ধূলিময় বৃক্ষলতা বৈশাখী বৃষ্টিতে বিশুদ্ধতা আর সবুজে ছেয়ে গেছে। এসবই কিন্তু প্রকৃতিতে এখন এক অনন্য পরিবেশ। শহর জীবনে এমন সব সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্য মাত্র এই অবরুদ্ধ সময়ই সম্ভব।  করোনাভাইরাস দুর্গতির দিনেও এমন অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসম্ভারে ঢাকা শহরের মতিঝিলে নটর ডেম কলেজ আঙ্গিনা শোভিত।। 

২. বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণে শহুরে পরিবেশ একমাস আগেও বিপর্যস্ত ছিল। এখন মানুষ করোনায় বিপর্যস্ত আর পরিবেশ তার আপন মহিমায় শোভিত। ব্যবসা এবং ভ্রমনের উপর বিধিনিষেধগুলি বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের স্তরটিকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে। দেশে কারখানা ও যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকাতে যানজট, ধূলিবালি, তাপদাহ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ অনেক হ্রাস পেয়েছে।পৃথিবীব্যাপক ‘লকডাউন’ অবস্থার কারণে পরিবেশ দূষণ অনেক কমে গেছে, দূষণে বিপর্যন্ত অন্যত ঢাকা শহর এখন বায়ুদূষণের দিক থেকে ৬ষ্ঠ স্থানে নেমে এেসেছে। নদীর জল হয়ে উঠেছে স্বচ্ছসলিল ওদিকে সবুজে ঢাকছে বনাষ্ণল আর আকাশ হয়ে উঠেছে আরও নীল। এই অন্তরীণ সময় মাত্র একমাস, যুগের পর যুগ ধরে যাকে করেছি ক্ষতবিক্ষত সে মাত্র একমাসে সেড়ে উঠতে শুরু করেছে। বনের পশুরা স্বস্তি পেয়েছে, মুক্ত মনে কখনও কখনও মানুষের চলাচলের স্থবির রাস্তায় এসে হামাগুড়ি দিচ্ছে। পর্যটকশূণ্য কক্সবাজার সৈকতে ডলফিন দলের সাথে গোলাপী ডলফিনও ফিরে এসেছে, সেন্ট মার্টিন সৈকতের বালিভূমিতে হরেক রকম কচ্ছপ ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে যাচ্ছে। একারণে পরিবেশবাদীরা হয়তো কারোনাভাইরাসকে পারিবেশের জন্য আর্শিবাদ হিসেবে দেখছে।

৩. অবরুদ্ধ সময়ে প্রকৃতি আবার শহরে ফিরে এসেছে, প্রকৃতির আপন সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভালই লাগছে। ভাবছি আমরা এখন কোথায় আছি, আর কোথায় ছিলাম। দিনের পর দিন আমরা এই অপূর্ব প্রকৃতিকে বিসর্জন দিয়ে আসছি। করোনাভাইরাসের কারণে পরিবেশগত বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের পুরো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা ভুলে যেতে চাই না।

৪. পরিবেশদূষণে মানুষের জীবন কষ্টকর হয়ে উঠেছে, দীর্ঘসময় যাবৎ আমরা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি । মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে, প্রকৃতির যত্ন নিতে হবে। নিজের সুস্থতা ও জীবনের জন্য নিজের মৌলিক পরিচ্ছন্নতার বিকল্প কিছুই নেই। বর্তমান অভিজ্ঞতা মানুষ ভুলতে পারবে না, বরং ক্ষতিকর ও সংক্রমক রোগ থেকে মুক্ত থাকতেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। পরিবেশবান্ধব হওয়া, পরিবেশের প্রতি যত্নবান হওয়া, রোগ প্রতিরোধে সর্বদা সচেতন হওয়া মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।

৫. পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- করোনাভাইরাস মহামারী অভিজ্ঞতায় উৎপাদন ও ভোগের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার একটা সুযোগ এসেছে (লাউদাতো সি-১৯১)। প্রয়োজনে উৎপাদন ও ভোগ কমিয়ে দিতে হবে। সেই সাথে প্রাকৃতিক বিশ্ব গভীরভাবে অবলোকন ও চিন্তা করতে হবে। আমাদের চারিপাশের পরিবেশের সাথে আমাদের আবার সংযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানুষ সম্পর্কযুক্ত। করোনাভাইরাস এই রূপান্তরটা উপলব্ধি করার ও পদক্ষেপ গ্রহণের একটা সুযোগ দিয়েছে। তিনি আরো বলেছেন- এই অভিজ্ঞতাটা ভুলে থাকা ঠিক হবে না। শুধু ফাইলবন্দি করে রাখাও ঠিক হবে না, আমরা যে দূষণে ছিলাম সেখানে যেন ফিরে না যাই। প্রকৃতি ব্যবহার ও অপব্যবহারের বিষয়টি গভীর ধ্যানে মনোনিবেশ করে সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করি। আমরা প্রকৃতির প্রতি গভীর মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি, আমাদের এখনই এটি ফিরে পেতে করোনাভাইরাস দুর্যোগ সময়টি সুযোগ দিয়েছে।

৬. করোনাভাইরাস মহামারী পরিবেশে রূপান্তর হওয়ার একটা সুযোগ রয়েছে। ইংল্যান্ডের বিশপ জন আরনল্ড বলেছেন-  করোনা দুর্যোগের পর আমরা আগের 'স্বাভাবিক' অবস্থায় আর ফিরে যেতে নাও পারি তবে আমরা যেখানে ফিরে যাব সেটা ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থা বলা যায়। অর্থাৎ আমরা দুর্যোগের পর সব পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে পাব না, কারণ আর্থিকভাবে, ব্যবসায়িক দিক থেকে অনেক পরিবর্তন মোকাবেলা করতে হবে।  আমরা একটা 'নতুন স্বাভাবিক' পরিবেশে যাব, আমরা কীভাবে আামদের 'নতুন স্বাভাবিক' অবস্থাটা দেখতে চাই তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।  

৭. আমাদের ছোট ছোট উদ্যোগ, সামাজিক কর্মসূচি বিশ্বজুড়ে পরিবেশকে প্রভাবিত করতে পারে। আমাদের বসতবাড়ির প্রতি আমরা আরেকটু যত্নবান হতে পারি। প্রকৃতির সাথে আমরা কী ব্যবহার করেছি তার প্রতি সচেতন হয়ে উঠতে পারি। পরিবেশের ক্ষতিরোধ করার জন্য আমরা কী করতে পারি সে সম্পর্কে কিছুটা আত্মমূল্যায়নও করা যেতে পারে। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো হারিয়ে না ফেলে, আমাদের জীবন পরিবর্তন করতে পারি। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতির প্রতি যত্নবান হওয়ার দায়িত্বও আমাদের দিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস অনুশীলনের সাথে পরিবেশ সুরক্ষাও সম্পর্কযুক্ত। পরিবেশ অরক্ষিত থাকায় আমাদের আধ্যাত্মিক অনুশীলনেও স্থবিরতা এসেছে। আমাদের ছোট ছোট সেবাযত্ন প্রকৃতি সুরক্ষায় বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা প্রকৃতির মাঝে থাকব, সৃষ্টিকর্তা আমাদের মধ্যে আছেন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন