বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে বন্দিরাও ঝুঁকিতে


১. আমাদের অবরুদ্ধ সময় মাত্র একসপ্তাহ, আবার পরিবারের আপনজনদের সঙ্গেই আছি। তবুও অনেকে অস্থির হয়ে উঠেছি, কেউ কেউ মনে করছি জীবনটা স্থবির হয়ে পড়েছে। এ সময় ভাবছি কারাকক্ষে  ‘একা অন্তরীণ’ অথবা ছোট কক্ষে  ‌‌‌‌'দলবদ্ধ'  গাদাগাদি করে বসবাসরত বন্দিদের। যাদের জীবন আরো নিয়ন্ত্রিত, নির্দেশিত এবং জীবনের গতি অতি মন্থর। করোনাভাইরাস অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে তাই কারাকক্ষে আক্রান্তের ঝুঁকির মাত্রা অত্যন্ত বেশি। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ মতে- করোনা মোকাবেলার অপ্রতুল প্রস্তুতি, ধারণক্ষমতার বেশি জনবহুল, স্বল্প পরিসরে অধিক বন্দির জীবনযাপন, স্বজনদের সাক্ষাৎ সময়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, নিম্নমানের ভেন্টিলেশন, অরক্ষিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা করোনা সংক্রামণের ঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ৬৮ কারাগারের মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে থার্মাল স্ক্যানার স্থাপিত হয়েছে । 


২. চীনসহ আরো কয়েকটি দেশে কারাগারে ভাইরাস বিস্তারের ঘটনা ঘটেছে। সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে ইরান ৮৫,০০০ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে, অন্যদিকে তুরষ্ক ১০০,০০০ বন্দিকে এবং ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, যুক্তরাজ্যও বন্দিদের বিশেষ ব্যবস্থায় সাময়িক মুক্তি দিতে যাচ্ছে। তাছাড়া মানবাধিকার সংস্থাগুলো চিলি ও আফ্রিকাসহ আরো কয়েকটি দেশের বন্দিদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বসহ দেখছে। যাদের অল্প সাজা, যারা অচল, অক্ষম, বৃদ্ধ বা বিপদাপন্ন বন্দিদের সমায়িকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবছে আমাদের সরকার। কর্তৃপক্ষ ৩,০০০ জন বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা করছেন, যা অতি সামান্য সংখ্যক এবং খুবই বিলম্বিত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া করোনা দুর্যোগে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নীতির ভিত্তিতেই বন্দিদের মুক্তির বিষয়টি ভাবতে হবে। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন অপরাধে বাংলাদেশের ১৩ কেন্দ্রিয় কারাগারসহ মোট ৬৮ কারাগারে প্রায় ৯৬ হাজারেরও বেশী কারাবন্দি রয়েছে, যেখানে ৩৬ হাজারের কিছু বেশী বন্দির জন্য ধারণ ক্ষমতা আছে । বাংলাদেশে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় তিনগুণের বেশি বন্দি রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে কারাগার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি জনবহুল।  

৩. প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ও জরিপ মোতাবেক বিদেশী নাগরিকসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে একশত ষাটজনের বেশী খ্রিস্টবিশ্বাসী বন্দি রয়েছে। তাদের মধ্যে তেরজন হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি আছে। কয়েকজনের বিচারের রায় মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হয়েছে। যদিও তাদের জন্য আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু মামলাজটে তাদের আবেদন আটকে আছে। খ্রিস্টবিশ্বাসী কারাবন্দি অনেকের মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যারা এখনও প্রকৃত অপরাধী বলে নিশ্চিত নন।বন্দিদের সুরক্ষার বিষয়টি ভেবে অবরুদ্ধ সময়ে তাদের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করা ঠিক হবে না। তবে অন্যভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি পাস্কা উৎসব সামনে রেখে কয়েকটি কারাগারে বন্দিদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রীর ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।তাছাড়া বন্দিদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কিছু উপাদান শীঘ্র প্রেরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

৪. যুবকদের পাশাপাশি বৃদ্ধরাও কারাগারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছে। বৃদ্ধদের মধ্যে অনেকে অসুস্থ, অক্ষম, বিপদাপন্ন ও বার্ধক্যজনিত ব্যধিতে অতি দুর্বল। অনেক বন্দি পরিবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। কারাগারে বন্দি অবস্থায় হয়তো প্রথম দুই তিন বছর আপনজনেরা মাঝে মাঝে দেখা করেছে। এরপর নিজের গনিষ্ঠজনেরাও সাক্ষাৎকার বন্ধ করে দিয়েছে। মায়েদের সাথে কারাগারে অন্তরীণ আছে অনেক শিশুরাও। কিছু দিন আগে একটি মহিলা কেন্দ্রিয় কারাগারে ৬৯ জন শিশুর সাথে কয়েক ঘণ্টা সময় কেটেছে। তাদের সবার ছোট ছোট, ভিন্ন ভিন্ন গল্প আছে। যা শুনে প্রতিটি মানবিক হৃদয় দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, আর গভীর ভাবে বিচলিত হবে। কারা অন্তরীণে জন্ম হয়েছে এমন শিশুদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। বাংলাদেশী নাগরিকদের পাশাপাশি বিদেশী নাগরিকরাও কারাগারে বন্দি আছে। একটি কারাগারে প্রায় ২৫জন বিদেশী নাগরিকের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। আরো একটি কারাগারে বন্দি সাতজন বিদেশী নাগরিক আছে, বিদেশী মহিলা নাগরিকও কারগারে বন্দি রয়েছে। 

৫. অন্তরীণ সময়ে আপনজনদের কথা বলার জন্য কারাগারে টেলিফোন সুবিধা সংযোজন করা হয়েছে। পরিবারের আপনজনদের সাক্ষাৎ সময় দূরত্বে অবস্থানের নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে। কারাগারসমূহে মাইকিং করে স্বজনদের সাক্ষাৎ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে অথবা সাক্ষাৎ সংক্ষিপ্ত করত বলছে। মাদারীপুর কারাগারসহ করোনা সংক্রামণে ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারসমূহে স্বজনদের সাক্ষাৎকারের নিয়মকানুন কঠোর করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি আটক হয়ে প্রবেশকৃত বন্দিদের মাধ্যমে করোনা সংক্রামণের ঝুঁকি বেশি বিবেচনা করা হচ্ছে। কারাগারসমূহে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল ও অরক্ষিত।

৬. পোপ ফ্রান্সিস সকল কারাকর্তৃপক্ষের প্রতি সতর্কমূলক বাণী রেখেছেন- করোনা প্রদুর্ভাব সময়ে যথেষ্ট আগে কারাসুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগ হলে মহাদুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। করোনা অন্তরীণ সময়ে প্রতি মুহূর্তে পোপ মহোদয় সকল বন্দিদের বিশেষভাবে অন্তরে রেখেছেন, প্রার্থনায় একাত্ম আছেন। করোনা অন্তরীণ সময়ে তিনি অনুভব করছেন- অন্যদের সান্নিধ্য ছাড়ার একাকী জীবনযাপন করা মানুষের জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক। তাঁর বাণী সর্বদা বন্দিদের অন্তরে আশা জাগায় ও তারা জীবনের নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তিনি বলেছেন- অন্তরীণ সময়ে তোমাদের মনের কষ্ট আমি বুঝতে পারি। তোমাদের জন্য প্রার্থনা করি,  পিতা ঈশ্বর তোমাদের অন্তর শান্ত করুন। আমি বুঝতে পারি এক অজানা হতাশা তোমাদের সুখ মুহূর্তে নষ্ট করে দেয় কারণ তোমরা জান না আগামীকাল তোমাদের জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি ক্ষুদ্র কারাকক্ষে যারা গাদাগাদি করে থাক, যখন-তখন তোমাদের মাঝে করোনা দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। সামাজিক দূরত্ব রেখে চলা তোমাদের জন্য একেবারেই অসম্ভব কারণ ছোট এককক্ষে অনেকজন থাকতে হয়। তিনি আরো বলেছেন- আমি আরো বুঝতে পারি তোমরা বন্দি থেকে যখন করোনা সম্পর্কে বাহিরের অস্পষ্ট কিছু খবর জানতে পার এবং হৃদয়ে অনুভব কর তোমাদের আপনজনদের জীবন করোনার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত অথবা জীবন ঝুঁকিপূর্ণ তখন তোমাদের কষ্ট আরো বেড়ে যায়। আমি বুঝতে পারি তোমাদর হৃদয় কাঁদে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে মন ছুটে চলে আসে। করোনা প্রাদুর্ভাবের সময়ে বন্দিদের সুরক্ষার জন্য নিয়মিত প্রার্থনা করতে ও সামর্থ্য মোতাবেক সহযোগিতা করতে পোপ ফ্রান্সিস আমাদের সকলকে আহ্বান জানান। কারণ বন্দিরা বর্তমান এক অনিশ্চিত এবং মানসিক যন্ত্রণাদায়ক কষ্টকর সময় অতিবাহিত করছে। আসুন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী’র ন্যায় ও শান্তি কমিশন- ‘কারাগার সেবা দপ্তর’কে সহযোগিতা করি। ধন্যবাদ। 

(ছবি সূত্র: ভাটিকান নিউজ ওয়েবসাইড)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন