শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে সামাজিক অস্থিরতা এবং করণীয়


১. বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ‘লকডাউন’ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের দেশে রপ্তানি আয়ের প্রাধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভে নেমেছে (১৬ এপ্রিল, বিডিনিউজ২৪.কম)। বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা ঢাকার মালিবাগ, কমলাপুর, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে। এতে শ্রমিকদের ওপর সাধারণ জনগণ বিরক্ত প্রকাশ করছে, সরকারের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে  জনগণ বিরক্ত কারণ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিস্তার ঠেকানোর বৈজ্ঞানিক উপায় ‘লকডাউন’ অবস্থান, যার একটু ব্যত্যয় ঘটলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। জনগণ বিভ্রান্ত কারণ সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে ‘লকডাউন’ সকল জনগোষ্ঠীর জন্য বাধ্যতামূলক। আর শ্রমিকদের বেতন দিতে সরকার এ খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ।  কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমএ’র তথ্য অনুযায়ী তাদের সদস্যভুক্ত কারখানা রয়েছে ২,২৭৪টি, এরমধ্যে মার্চ মাাসের বেতন পরিশোধ করেছে ১,৬৬৫টি কারখানা। যা মোট করাখানার ৭৩ শতাংশ এবং ৮৭ শতাংশ শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করেছে (১৬ এপ্রিল)। এখনও ৬০৯টি কারখানার শ্রমিকরা মজুরি পায়নি। 

২. করোনাভাইরাস মহামারী বিস্তার ঠেকাতে মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে, ফলে নিজেরা শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। একদিকে মধ্যবিত্ত, বাস্তুহারা ও অভিবাসী শ্রমিকরা নিজেদের উৎপাদিত শ্রমের ফল থেকে নিজেরাই দিনদিন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে নিজের স্বার্থ, নিজের লোভ এবং নিজের মুনাফা মালিকদের সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্ট মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে শ্রেণি বিভাজন, তা ক্রমে ক্রমে মানুষকে অপর মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। ফলে শ্রমিক মনে নিঃসঙ্গতাবোধের কারণে নিজে বেঁচে থাকার তাগিদে করোনাভাইরাস দুর্গতি জেনেও রাস্তায় নেমেছে। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধেই দেশের সুরক্ষার সম্ভব, অন্যথায় শ্রমিকরা রাস্তায় থাকলে মাশুল দিতে হবে খুব শীঘ্রই। পোপ মহোদয় বলেছেন, করোনা দুর্যোগে উৎপাদন, ভোগ ও মুনাফা নিয়ে সঠিক সমন্বয় আবশ্যক। পোপ মহোদয় আরও বলেছেন-- করোনাভাইরাস মহামারী দরিদ্রদের 'দেখার' এবং উৎপাদন ও ভোগের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার একটা সুযোগ এসেছে। এই অভিজ্ঞতাটা ভুলে থাকা ঠিক হবে না।  

৩. নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বাড়ির মালিক এক নারী চিকিৎসককে ‘দুর্ব্যবহার’ করে ভাড়াবাড়িতে ঢুকতে বারণ করেছে। তিনদিন উপজেলা সদরে একটি অসরকারি ক্লিনিকে অবস্থান করে পুলিশ সহায়তায় নারী চিকিৎসক বাড়িতে উঠেছে (১৭ এপ্রিল, বিডিনিউজ২৪.কম)। ঢাকায় সবুজবাগে এক বাড়ির মালিক এক চিকিৎসককে ভাড়াবাড়ি ছাড়তে নোটিশ দিয়েছে, চিকিৎসক টাঙ্গাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত। মালিক টেলিফোনে একজন কর্মরত নার্সকে রাত ১০টার পর ভাড়াবাড়িতে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছে । কর্মস্থলের কর্তৃপক্ষ বাড়ির মালিকের সাথে যোগাযোগ করলে উল্টো নার্সের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। অবশ্য দুদক ইতিমধ্যে বাড়ির মালিকদের এমন সব আচরণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর বাড়ির মালিকরা দুর্ব্যবহার করছে, যখন তখন হেনস্থা করছে ।  যা আমরা ইন্টারনেট সংবাদ থেকে জানতে পারছি। 

৪. পৃথিবীর অনেক দেশ ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের করোনাভাইরাস দুর্যোগ মুহূর্তের অবদান বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছে, আমাদের মাননীয় প্রাধানমন্ত্রীও একই মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের সহযোগিতা পাচ্ছে, জাতির বীরসেনা সম্মানে খ্যাতি পাচ্ছে। এ দুর্গতি সময়ে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, “আমি এই মুহুর্তে আপনাদের সাথে স্মরণ করতে চাই  সেইসব নারীদের, যারা এই স্বাস্থ্য সংকটকালে অন্যদের দেখাশোনা করছেন, নারী ডাক্তার, নার্স, প্রশাসনিক কর্মী,  জেলখানার প্রহরী, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানকর্মী এবং মা-বোনেরা যারা পরিবারে সন্তান, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের সাথে নিজেরাও বন্দি হয়ে আছেন।”  পোপ আশংকা  প্রকাশ করে আরো বলেছেন- এই গৃহবন্দি সময়ে নারীরা গৃহসন্ত্রাসের শিকার হতে পারে। পোপ ফ্রান্সিস আরো বলেছেন, “নারীরা যে সব সংকট মোকাবেলা ক’রে এমন অবস্থায় বসবাস করছেন, তা তাদের জন্য অত্যন্ত ভারী দায়িত্ব, ফলে তাদের উপর সন্ত্রাসের একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।” পোপ মহোদয় তাদের সেবাকাজে অভিভূত হয়ে বলেছেন- ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মিশনারি ও পুলিশসহ সকল সেবাকর্মীরা দুর্যোগ সময়ের বীরসেনা ও সাধুসম সেবাকর্মীদল।

৫. ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিদিন প্রত্যেক থানায় ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ি থানা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক খাবার দেয়ার পরও বাইরে ছিল বহু মানুষের ভিড়। সংবাদ থেকে জানা গেছে ছোট, বড়, বৃদ্ধ সবাই লাইনে দাঁড়ানো, কিন্তু ছিল না কারও কোন করোনাভাইরাস সচেতনতা (সূত্র: একই)। একই দিনে জেনিছি ভারতের কেরালারাজ্যে অভিবাসী শ্রমিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় সরকার, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি এবং সরকারের দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির সমন্বিত সহায়তায় রাজ্যজুড়ে ১,২০০এর বেশি কমিউনিটি কিচেন কার্যক্রম শুরু হয়েছে । যেখানে প্রতিদিন আড়াই লাখ মানুষকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করছে। কিচেন থেকে ৯০ শতাংশের বেশি খাবার বিনামূল্যে দিচ্ছে, বাকী ১০ শতাংশ খাবার মাত্র ২৫ রুপিতে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। সেখানে প্রতি ১৫দিন পরপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি প্যাকেট ৮৭ লাখ পরিবারকে পৌঁছে দিয়েছে। যার মধ্যে বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় ১৭ রকমের পণ্যসামগ্রী রয়েছে। যার ফলে জনগণ ত্রাণ নিতে ঘরের বাইরে আসছে না, তারা ঘরেই থাকছে, না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। সমাজের  সুরক্ষা নিশ্চিত থাকছে শতভাগ। পোপ মহোদয় বলেছেন, দুর্যোগ সময়ে সেবাকাজে থাকতে হবে সেবাকর্মীর গভীর দরদবোধসহ মনোযোগ ও সৃজনশীল কর্মকৌশল । 

৬.  প্রতিদিন বিকালে কলেজের প্রধান ফটকে এসে দেখি ১০/১৫জনের পথশিশু দলটি রাস্তায় ছুটাছুটি করছে। টহলরত পুলিশের তাড়া পেলে বিচ্ছিন্নভাবে লুকিয়ে থাকে নিজ নিজ কৌশলে, আবার সেনাবাহিনীর গাড়ি এলে ওদের ফুটপাতে সামাজিক দূরত্বে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে রেখে যায়। কিছুক্ষণ পরে এরা নিজেদের মতই ছুটাছুটি করে, কখনও কখনও হৈচৈ করে ক্রিকেট খেলে সময় অতিবাহিত করে। ভারতের কেরালারাজ্যে সরকার বিশেষ গুরুত্ত্ব দিয়ে অতি দরিদ্র এবং গৃহহীনদের এই দুর্যোগ সময়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। শুধু তা নয় তাদের বিনামূল্যে খবারের ব্যবস্থাও করেছে। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আড়াই মাসে ৬৫ হাজারের বেশি অতি দরিদ্র ও ছিনমূল মানুষকে সহায়তা দিয়েছে রাজ্য সরকার। একাজে স্থানীয় সরকার ও গ্রাম পঞ্চায়েতের সাহায্য নিয়েছে। এ দুর্যোগ মোকাবেলায় রাজ্যসরকার সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষদের নিয়ে ৪ লাখ স্বেচ্ছাসেবক গঠন করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যকর্মী ও সমাজকর্মীরা একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লকডাউন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, সঙ্গনিঃরোধ, চিকিৎসা, সৎকার, জীবন রক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে। বিশ্বর মানুষ করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকানোর ( আড়াই মাসে আক্রান্ত রোগী মাত্র ৩৯৪ জন, সুস্থ হয়েছে ২৪৫ জন আর মারা গেছে ৩ জন)  তাদের কর্মকৌশলকে দেখছে ‘কেরালা মডেল’ হিসেবে। তারাতো মাণ্ডলিক ক্ষুদ্র সমাজের সমদায়িত্ববোধ প্রেরণায় ‘দেখা, বিশ্লেষণ করা ও কাজ করা’ এ কর্মনীতিই অনুসরণ করেছে। এটি এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে যা সঙ্গতিপূর্ণ, বাস্তবধর্মী ও দায়িত্বশীল। কেরালার প্রায় তিনকোটি জনগণ মধ্যে  ১৮% শতাংশ জনগণ খ্রিস্টবিশ্বাসী, অভিবাসীরা কেরালাকে ‘ঈশ্বরের আপন নগরী’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। 

৭. অন্যদেরটা দেখে ও শুনে স্থানীয়ভাবে একসাথে সমন্বিত পদ্ধতিতে কাজ করার সময়টা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সেটা হতে পারে নিজের এলাকা, পাড়া, গ্রাম, উপজেলা, জেলা বা অঞ্চল হিসেবে। তবুও সামাজিক অস্থিরতা বন্ধ করতে হবে, সেটা যত ছোট পরিসরেই থাকুক না কেন। অন্যথায় করোনাভাইরাস বিপর্যয় দীর্ঘায়িত হওয়ার ভয় থেকে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন