শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে তারাও পাবে তাঁর দয়া


১. পুণ্য শুক্রবারে পোপ ফান্সিস কারাবন্দিদের সাথে আধ্যাত্মিক একাত্মতায় ক্রুশের পথ ধ্যান করেছেন। পোপ মহোদয় যিশুর ক্রুশের পথের অনুধ্যান লেখার জন্য  আঠারোজনকে আমন্ত্রণ করেছেন। তারা নিজের জীবন অভিজ্ঞতা অনুধ্যান করেছে। আমন্ত্রিতদের মধ্যে পাঁচজন বন্দি, একটি পরিবার যারা হত্যার শিকার হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত একজন বন্দির কন্যা, কারাগারের একজন শিক্ষক, একজন সিভিল ম্যাজিস্ট্রেট, একজন বন্দির মা, একজন কারা ধর্মশিক্ষক, একজন স্বেচ্ছাসেবক, একজন কারারক্ষী এবং একজন যাজক যিনি অভিযুক্ত ছিলেন কিন্তু আট বছর পর মুক্তি পেয়েছেন। কারা অন্ধকারে থেকেও ভাল চোরের মত একটা অভিজ্ঞতার ফলে একটি মুহূর্তে জীবন আলোতে উদ্ভাসিত হতে পারে। যারা বিশ্বাস করে তাদের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব, এমনকি কারা অন্তরীণে অন্ধকারেও একটি আশার বাণী শোনতে পায়  “কারণ পরমেশ্বরের অসাধ্য কিছুই নেই” (লুক ১:৩৭)।আসুন তাদের খ্রিস্ট যিশুর অভিজ্ঞতা শুনি। 

২. যাবজ্জীবন কারদণ্ড প্রাপ্ত একজন বন্দি ২৯ বছর যাবৎ কারা অন্তরীণে। তার অনুধ্যান- ‘ওকে ক্রুশে দাও, ক্রুশে দাও’ এ চিৎকার যখন আমাকে আদালত-কক্ষে আনা হয়েছে তখন শুনেছি, আবার খবরের কাগজে ও টেলিভিশন সংবাদে একই শ্লোগান আমি শুনতে পেয়েছি। আমি দোষী আর যিশু নির্দোষী ছিলেন। বাবার সাথে আমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আছি। কিন্তু শৈশবে বাসে, শ্রেণিকক্ষে ধণীর ছেলেরা আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে কারণ আমি গরীব।  আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।তাদের দণ্ড হয় না। স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যা ছিল তাই প্রচুর অবজ্ঞা পেতে হয়েছে। তাই শৈশব থেকেই আমি ক্রুশবিদ্ধ। যিশুর যাতনাভোগের কাহিনী পড়ে ২৯ বছর পরেও আমি চোখের জল ফেলে কাঁদতে পারি। আমার সৌভাগ্য- আমার চোখের জল শেষ হয়ে যায়নি, লজ্জাবোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলিনি। যিশুর ক্রুশ যাতনাভোগ কাহিনী পড়ে আমি কখনও নিজেকে বারাব্বাস, কখনও পিতর এবং কখনও যুদাস অনুভব করে থাকি।

৩. একটি পরিবারের মা যাদের মেয়ে নির্দয়ভাবে হত্যার শিকার হয়েছে। সে অনুধ্যান করেছে- অন্যমেয়েটি কোনোভাবে প্রাণ রক্ষা পেয়েছে কিন্তু মিষ্টি হাসি বিনষ্ট করে দিয়েছে। খুনী এখন কারাগারে বন্দি। সময় চলে যায় কিন্তু ক্রুশের ভার কমে না। কন্যাকে ভুলতে পারি না, সে আমার সাথে থাকতে পারত কিন্তু এখন নেই। আমরা এখন বৃদ্ধ, বাড়িতে দিন দিন বিপদাপন্ন সময় আসছে। তবে হতাশাগ্রস্থ সময়ে যিশু বিভিন্ন উপায়ে আমাদের কাছে এসেছেন।স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে আরো ভালবাসতে, আরো সমর্থন করতে অনুগ্রহ পেয়েছি।যিশু আমাদের বাড়ির দরজা দরিদ্র ও হতাশাগ্রস্থদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে আহ্বান করেন। আমরা সাড়া প্রদান করি, আবার মানবকল্যাণ কাজ করতে শুরু করি। আমরা মন্দের কাছে আত্ম-সমর্পণ করতে চাই না। ঈশ্বরের ভালবাসায় সত্যই জীবন পুনর্নবীকরণ সম্ভব। তাঁর পুত্র যিশু মানুষের দুঃখ লাঘব করতে যন্ত্রণা সহ্য করেছেন।

৪. একজন বন্দি যিশুর মাটিতে পতন অনুধ্যান করেছে- আমার প্রথম পতনটি ছিল আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলাম যে পৃথিবীতে ভাল বলতে কিছু আছে।দ্বিতীয়টি আমি বুঝিনি খুনের একটি পরিণতি আছে কারণ আমি ইতিমধ্যে বিবেকের ভিতরে মারা গিয়েছি। আমি বুঝতে পারিনি ধীরে ধীরে  আমার ভিতরেও মন্দতা বাড়ছে। অন্ধকার আমার জীবনে ছড়িয়ে পরছে এবং তা বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে। ক্রোধ আমার দয়াশীলতা মেরে ফেলে, আমি বড় মন্দ কাজ করে ফেলি।কারাগারের অন্যের খারাপ আচরণ আমাকে আত্ম-বিশ্লেষণ করতে শেখায়- আমার পরিবারকে আমি নষ্ট করে দিয়েছি।আমার কারণে তারা সুনাম ও সম্মান হারিয়েছে। খুনির পরিবারে চিহ্নিত হয়েছে।এখন আমার শাস্তিটি শেষ পর্যন্ত ভোগ করতে চাই। কারণ কারাগারে আমি এমন লোকদের খুঁজে পেয়েছি যারা আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। 

৫. অন্য একজন বন্দি অনুধ্যান- আমার প্রথমবার পতন হয়েছে যেদিন মন্দ আমাকে আকৃষ্ট করেছে, মাদকদ্রব্যগুলো বাবার প্রতিদিন ১০ ঘন্টা পরিশ্রমের চেয়ে বেশী মূল্যবান ছিল।দ্বিতীয় পতন ছিল- যখন পরিবারকে ধ্বংস করেছি। মায়ের চোখে তাকিয়ে দেখেছি মা সবার লজ্জা নিজে গ্রহণ করেছে।বাবা মুখে তাকিয়ে দেখেছি বাবা গোপনে ঘরে একা বসে কেঁদে কেঁদে সময় পার করছে। 

৬. একজন বন্দির মায়ের অনুধ্যান- আমার ছেলের পাপের জন্য আমি নিজে দোষী। আমি আমার নিজের দায়বন্ধতার জন্যও ক্ষমা চাচ্ছি। আমি প্রার্থনা করি আমার সন্তান অপরাধের মূল্য পরিশোধ  করে আমার কাছে নবজীবনে ফিরে আসবে। আমি অবিরাম প্রার্থনা করি- একদিন আমার সন্তান অন্য রকম মানুষ হয়ে উঠবে, নিজেকে এবং অন্যদের ভালবাসতে শিখবে। মা মারীয়ার মতো আমি নিজেই কালভেরির পথে অভিজ্ঞতা করেছি, সন্তান যখন প্রেপ্তার হয় সেদিন আমাদের পরিবারের পুরো জীবনটা বদলে গেছে। তার সাথে আমরাও কারাগারে আছি। মানুষের মন্তব্য একটি ধারালো ছুরির মতো হৃদয়কে বিদীর্ণ করে, হৃদয়ে সবকষ্ট সহ্য করছি কিন্তু তাকে কখনও ত্যাগ করিনি।

৭. একজন বন্দির অনুধ্যান- আমি যেদিন কারাগারে প্রবেশ করেছি আর সেদিন কারাগার আমার বাড়িতে প্রবেশ করেছে। আমি আমার শহরে সমাজের জঘন্য ব্যক্তি হয়েছি। সকলে আমাকে খুনি হিসেবে ডাকে, কি দুর্ভাগ্য আমার নামটিও হারিয়েছি। আমি কারাগারে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, আমি স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যস্থতায় আবার বাচঁতে শিখেছি। আমার বন্দি সঙ্গিরা আমার ক্রুশ বহন করে সাইরিনির সিমোনের মত সাহায্য করেছে। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমি অন্যকে বিশ্বাস করতে সক্ষম হব। কাউকে না কাউকে সুখী করে সাইরিনির সিমোন হয়ে উঠব।  

৮. একজন বন্দির কিশোরী কন্যার অনুধ্যান- আমি একজন বন্দির মেয়ে, আমি বাবার ভালবাসার অভাব অনুভব করি। আমার মা হতাশার শিকার কারণ অনেক বছরপূর্বে বাবা কারাবন্দি, সংসার ভেঙে পড়েছে, খুব বেশি আর্থিক সংকট। আমি অল্প বেতনের কাজ শুরু করি, পরিস্থিতি প্রাপ্তবয়স্কের অভিনয় করতে বাধ্য করেছে। বাবার পরিণতির জন্য বাড়িতে সমস্ত কিছু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে আছে।যাদের বাবা যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ হয়েছে কেবল তারাই বুঝে। যতদূরের কারাগারেই স্থানান্তর করা হোক সেখানেই গিয়ে বাবার সাক্ষাৎ করি। তা যদি কয়েকশ কিলোমিটার দূরেও হয়। আমি এখন বলি-‘এটাই জীবন’ শুধু বাবার ভালবাসার কারণে আমি তার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। এই আশা করাটা আমার অধিকার।

৯. অন্য একজন বন্দির অনুধ্যান- আমি কারাগার থেকেই ঠাকুরদাদা হয়েছি। আমার মেয়ের বিয়ে, গর্ভাবস্থা কিছুই দেখেনি। একদিন নাতনীকে আমার জীবনের গল্প শোনাব। আমার মন্দ কাজের গল্প নয়, হতাশার গল্প নয়, দুর্ভোগের গল্প নয়। তবে আমার বিশ্বাসের গল্প। আমি যখন বিশ্বের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলাম, একাকী মনে করেছি, ভেবেছি জীবনে অর্থ নেই, প্রায় যিশুর মত বারে বারে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম। নাতনীকে বলব- এমন সময় তোমার জন্ম সংবাদ আমাকে ঈশ্বরের নিকট ফিরে আসতে সাহায্য করেছে। আমি বুঝতে আরম্ভ করেছি ঈশ্বর আমাকে এখনও কত ভালবাসেন। জীবনটা কত সুন্দর, তিনি কত সুন্দর উপহার আমাকে দিয়েছে। আমি ঈশ্বরের দান নাতনীকে সত্যিই কোলে জড়িয়ে নিব একদিন, এমন আশা আমি করতেই পারি। তুমি আমার দেবদূত।

১০. আট বছর বন্দি অবস্থায় থাকা একজন যাজক অনুধ্যান করেছেন- যত লজ্জাই আসুক না কেন, এক মুহূর্তের জন্য আমি সব শেষ হয়ে যেতে দেইনি। আমি স্থির করেছি আমি সর্বদা যাজক থাকব। আইনের মাধ্যমে আমি আমার ক্রুশ কমাতে পারতাম কিন্তু আমি চেয়েছি সবটুকু ক্রুশ বহন করতে।আমি নিয়মিত বিচারকের কাজে সহযোগিতা করেছি। আমি যাজক হিসেবে কয়েক বছর ধরে যাদের  সেমিনারীতে পাঠিয়েছি তারা ও পরিবার আমার পাশে থেকে ক্রুশ বহন করতে সাহায্য করেছে। তারা নিয়মিত প্রার্থনা করেছ্, আমার চোখের অনেক অশ্রু মুছে দিয়েছে। আমি যেদিন পুরোপুরি মুক্তি পাই, আমি নিজেকে দশ বছর আগের চেয়ে বেশি সুখী মানুষ মনে করেছি। আমি আমার জীবনে প্রথম ঈশ্বরের কাজের অভিজ্ঞতা করেছি। ক্রুশে ঝুলন্ত অবস্থায় আমি যাজকত্বের অর্থ আবিষ্কার করেছি।

(ছবি: ভাটিকাননিউজ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন