মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে তাঁর অনুগ্রহে থাকি


. অবরুদ্ধ সময় শুরুর প্রথম পর্যায়ের একটি ঘটনা ছাত্র-ছাত্রীরা সুরক্ষিত থেকে ঘরে বসে পড়ালেখা করতে পারে সেই বিবেচনায় সবেমাত্র ক্লাস বন্ধ ঘোষণা হয়েছে তখন চালক প্রকৃতির এককর্মী রাতে তার বসকে ফোন করে ফোনে বসকে জানায়- তার মহল্লায় একজন লোক মারা গেছে ব্যক্তিটি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিল এমন সন্দেহ করা হচ্ছে সকলের সুরক্ষা চিন্তা করে স্বেচ্ছায়  ‘একা অন্তরীণ’ অবস্থায় থাকতে চাই চৌদ্দ দিন পর টেস্ট করে করোনাভাইরাস নেগেটিভ বা পজেটিভ নিশ্চিত হওয়া যাবে সুতরাং আমি আগামীকাল অফিসে আসবো? বস উত্তর দিল- ভালই হয়েছে ফোন করেছ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমিসহ সকলে আগামীকাল থেকে ঘরে বসে অফিসের কাজ করবে তোমার অফিসে আসাটা দরকারী, তুমি ছাড়া অফিসের অনলাইন কার্যক্রম চলবে না সমস্যা হবে না তুমি অফিসে  ‘একা অন্তরীণ’ থাকবে

. আফ্রিকার এক দেশে করোনা সম্পর্কে একটি ইতিবাচক খবর প্রকাশ হয়েছে সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের কোন রোগী সনাক্ত হয়নি এমন দারুন খবর সম্পর্কে জানতে পৃথিবীর বিখ্যাত মিডিয়া সাংবাদিকরা দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইল যথারীতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেন শুরুতে সবার পক্ষে একজন মন্ত্রী মহোদয়কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে পরে একজন  জানতে চেয়েছে- বিশ্ব যখন করোনা নিয়ে দিশেহারা তখন আপনাদের ইতিবাচক খবরের রহস্যটি দয়াকরে আমাদের বলুন প্রথমে মন্ত্রী মহোদয় বললেন- পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের খবর আপনাদের দিতে পারিনি জন্য আমি দু:খিত তারপর বললেন- কারণ পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় টেস্টকিট এখনও আমাদের হাতে এসে পেীঁছেনি 

. রাজ্যের নির্দেশিত অবরুদ্ধ সময় কাটাতে খেটে খাওয়া সাত দিনমজুর যুবক গাছের ওপর আশ্রয় নিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর ব্লকের ভঙিডি গ্রামের ঘটনা কারণ অবরুদ্ধ সময় কাটাতে বাড়িতে পৃথক ঘর নাই সাত যুবক সাত মাস আগে কাজের খোঁজে চেন্নাই গিয়েছিল করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় তারা ট্রেনে যাত্রা করে বাড়িতে ফিরে আপনজনেরা আগেই গাছের ওপর বিভিন্ন ডালে মাচা করে খাটিয়ে চাপিয়ে ‘অন্তরীণ খুপরি’ তৈরি রাখে কাউকেই যেন বাড়িতে ঢুকতে না হয় সে জন্য গাছের নিচেই আলাদা রান্না খাবারের ব্যবস্থা করা হয় আপনজনেরা রান্না উপকরণ গাছের তলায় রেখে যায়, যুবকরা রান্না করে খেয়ে গাছের ওপর শুয়ে-বসে দিন কাটায় বান্দরবন পাহারে ম্রো  পাড়ার প্রধানফটক পাড়াপ্রধান কর্তৃক বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কেউ আর বাইরে যেতে পারবে না বা বাইরের লোক ভিতরে ডুকতে পারবে না অবরুদ্ধ সময় কাটানোর এসবই বহু যুগের প্রচলিত প্রথা, করোনা অবরুদ্ধ সময়ে কাজে লেগে যায়

. অবরুদ্ধ সময় বিশ্বের একটি সুন্দর প্রথা হঠাৎ করে বদলে গেছে কারো সাথে দেখা হলে আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরা, হাতমেলানো, কোলকোলি কারা, চুমু খাওয়া, আর্শিবাদ নিতে বা দিতে কপালে হাত ছোঁয়ানো, প্রণাম জানাতে পা স্পর্শ করার রীতি-নীতি হঠাৎ করে করোনা ধামিয়ে দিয়েছে অবশ্য হাত জোড় করে নমস্কার নিবেদনের প্রথাটা আমাদের পূর্বেই প্রচলিত ছিল করোনা তা বিশ্বে প্রচলন করে দিয়েছে

. অবরুদ্ধ সময় গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধসমূহ হঠাৎই স্থবির হয়ে গেছে যুদ্ধারা জেনে গেছে মিসাইল দিয়ে চাইলেই মানুষ মারা যায় কিন্তু করোনা মারা যায় না নাগরিকত্ব আইনে অপছন্দের মানুষদের দেশতাড়া করা যায় কিন্তু করোনা তাড়ানো যায় না অনেক সীমানা প্রাচীরে ধারে মানুষ হত্যা বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু করোনা প্রবেশ বন্ধ হয়নি এটি ভাবনার বিষয় যে দেশে দেশে নির্মিত কংক্রিটের প্রাচীরগুলো মিথ্যা সীমানা এগুলোর মূল্য খুবই কম কারণ করোনার কোন পাসপোর্টের প্রয়োজন পরে না, করোনা কোন সীমান্ত মানছে না যুদ্ধগুলো মিথ্যা শক্তি, যা শান্তি আনতে পারে না অভিবাসী বিষয়ক বাণীতে পোপ মহোদয় বলেছেন- সীমানা প্রাচীর মানুষ দ্বারা নির্মিত তবে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন এক বিশ্বমন্ডল, এক অভিন্ন বসতবাটি একটু অনুভব করি, অসংখ্য অসহায় মানুষ সাড়া জীবন নিপীড়িত অত্যাচারিত অন্যদিকে ভাইরাসটি আমাদের সকলের উপর সমানভাবে খুব অল্প সময় অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে নিপীড়িত মানুষের তুলনায় আমাদের কষ্ট ক্ষণিকের

. অবরুদ্ধ সময়ে আমরা শান্ত সময় অতিক্রম করছি শব্দদূষণ আমাদের কাছে সহনশীল ব্যাপার হয়ে পরেছে বিকট শব্দে হাইটেক সাউন্ডসিস্টেম বেশীরভাগ সময়ে উচ্ছ্বাস নয় উচ্ছৃঙ্খলতাই প্রকাশ করে পাশের বাড়ির অসুস্থ ব্যক্তিটাকে উপেক্ষা করে, বৃদ্ধ-বিপদাপন্নকে কষ্ট দিয়ে, পরীক্ষার্থীদের অবহেলা করে, শব্দদূষণ করে বিকট আওয়াজের হাইটেক সাউন্ডসিস্টেম পরিবেশদূষণ ছাড়া কী হতে পারে? করোনা আমাদের জীবনকে নীরবতায় স্থবির করে দিয়েছে, নিজেদের কল্যাণেই শব্দদূষণ রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে

. করোনা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সকল উৎসব থামিয়ে দিয়েছে।সমাজে ঋণের টাকা দিয়ে বিয়ে, জন্মদিন, ছেলেমেয়েদের সাক্রামেন্ত গ্রহণ দিনে ব্যয়বহুল আনন্দ-উৎসব আয়োজনের একটা প্রচলন আরম্ভ হয়েছে তারপর খেলাপী ঋণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে সভা-সেমিনারে অনেকবার সমাজের বহুলোকের ঋণগ্রস্ত হওয়ার দিকটি আলোচনায় উঠে আসে সাময়িক আনন্দ উৎসবে আমরা যতটা তৎপর, তার চেয়ে বেশী তৎপর হতে হবে পারিবারির আর্থিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে আমাদের আপৎকালীন আর্থিক অবস্থা কতটা মজবুত তা করোনা অতিক্রমনে পরের দিনগুলোতে প্রমান হবে

. করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ে ব্রেইন স্টোকের পর একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়, তার আত্মার চিশান্তি কামনা করছি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরেও আপনজনেরা তাকে ভর্তি করতে পারেনি অনেকটা বিনা চিকিৎসায়ই  তার মৃত্যু ঘটেছে বলে পারিবারের অভিযোগ নিকটতম একজন সহযোদ্ধা আক্ষেপ করে বলেছে“সবাই যদি এভাবে ভাগ ভাগ বলে তাহলে এই সংকটে রোগীর কী হবে।”  চিকিৎসা ক্ষেত্রে ধরনের বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি হলে মানুষ আরো অসহায় হয়ে যাবে যদিও চিকিৎসকগণ সংক্রামিত হওয়ার পর ভীতিটা বেড়ে গেছে সাড়া বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও চিকিৎসক, নার্স চিকিৎসায় জড়িত ব্যক্তিরা রাতদিন অক্লান্ত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি রইল সম্মান কৃতজ্ঞতা

. অবরুদ্ধ সময়ে জীবনের কঠিন ধাপে অনুভব করছি- আমাদের অতি দরকারী বিষয়সমূহ হল আমাদের নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী যেমন- খাদ্য, জলJla ইত্যাদি সময়ে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট সৃষ্টির মাধ্যমে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী যেমন মজু করছে, একইভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে মজু প্রবণতা বেড়ে গেছে নিজের প্রকৃত প্রয়োজনের চেয়ে মানসিক চাহিদা পূরণে অতিরিক্ত কিনে গচ্ছিত রাখছে, ফলে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে সরকার দিক থেকে অতিরিক্ত মজু করা থেকে বিরত থাকতে বলছে আমাদের নিজের পরিমিত আচরণ দিয়ে সমাজকে সুরক্ষা দিতে পারি

১০. অবরুদ্ধ সময়ে যারা বৃদ্ধ বা বার্ধক্যজনিত দুর্বল অথবা যারা একাকী সেবাকেন্দ্রে আছে অথবা হাসপাতালে অসুস্থ অথবা নিজেদের বাড়িতে বিপদাপন্ন - তাদের ভয় তারা জানে না আগামীকাল তাদের জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে আবার যারা বেকার অথবা যাদের স্থায়ী কোন আয়ের উৎস নেই তাদের ভয় কীভাবে সন্তান আপনজনদের মুখে খাবার যোগান দিবে অন্যদিকে রাষ্ট্রনেতাদের ভয় উপযুক্ত সময়ে সঠিক নীতি নির্ধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সচল রেখে নাগরিকদের সর্বাধিক সুরক্ষা কতটুকু সুনিশ্চিত হচ্ছে অবরুদ্ধ সময়ে আমাদের সকলেরই নিজেস্ব ভয় আছে, আমাদের ভয় আমরা জানি পোপ মহোদয় আহ্বান করেছেন- যেন ভয়কে জয় করতে সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখি এবং নিয়মিত প্রার্থনা করি

১১. গত রবিবারের খ্রিস্টযাগের অনুধ্যানে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- করোনা আক্রান্তে ক্ষতবিক্ষত বিশ্ব কাঁদছে, আক্রান্তদের আপনজনেরা কাঁদছে, যারা আক্রান্ত তারা কাঁদছে  লাজার মারা যাবার পরে তার বোন মার্থা, মারীয়া ও উপস্থিত লোকেরা কাঁদছে দেখে যিশু অন্তর থেকে কেঁদে ফেললেন (যোহন ১১:৩৩-৩৫),  খ্রিস্ট যিশু আজ আমাদের সাথে কাঁদছেন। পোপ মহোদয় জানিয়েছেন- তিনিও আমাদের সাথে আছেন, সকলের কান্নার সাথী হয়ে আছেন। প্রতিদিন তিনি গভীরভাবে আমাদের জন্য চিন্তিত এবং নিয়মিত প্রার্থনা উৎসর্গ করছেন। পোপ মহোদয় আহ্বান করেছেন- আমরা সকলে যেমন কাঁদছি তেমনি আমাদের কান্না যেন পরস্পরের প্রতি ভালবাসায় পরিনত হয়। অন্যদের জন্য প্রার্থনা করি, দয়ার কাজ, মঙ্গল কাজ করি। পোপ মহোদয়  “খ্রিস্ট জীবন্ত” পত্রে যুবকদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে যা বলেছেন আজ সকলের জন্যও তা  অর্থপূর্ণ- ক) ভালবাসা বিহীন জীবন শুষ্ক বা আকর্ষণহীণ জীবন; ) ভবিষ্যতের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব; ) পাওয়ার চেয়ে দেওয়াতে আনন্দ বেশী; ) ভালবাসা শুধুমাত্র কথায় নয়, কাজেও দেখাতে হয় মার্ক লিখিত মঙ্গলসমাচের (:৩৫-৪১) শিষ্যদের মতো আমাদেরও খ্রিষ্ট যিশু বলছেন এতো ভয় কিসের, আমি তোমাদের সাথে আছি, বিশ্বাস জাগাও, পরম পিতার অনুগ্রহে থাক অবরুদ্ধ সময়ে আমরা নিজেরা যত্নবান হয়ে সমাজকে সুরক্ষিত রাখি

(সহায়ক সূত্র: ভাটিকান নিউজ, বিডিনিউজ২৪.কম)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন