বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে কিছু উপলব্ধি ও চেতনা

২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে আমরা করোনাাইরাস নামের সাথে পরিচিত হতে শুরু করি। এই ভয়াবহ শত্রæ মানুষকে কর্মহীন ও ঘরবন্দী হতে বাধ্য করেছে। প্রদুর্ভাব ক্রমাগত বাড়ছে, পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। উইলিয়াম হেনরি গেটস (বিল গেইট) যিনি একজন আমেরিকান ব্যবসায়িক ম্যাগনেট, বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা এবং সমাজসেবী। তিনি করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে কিছু আধ্যাত্মিক অনুধ্যান সহভাগিতা করেছেন। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয় ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস বাণী এসময়ে বিশ্বের মানুষকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করছে। মানুষের জীবন এখন সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্ন থাকা এবং বন্ধাবস্থা এই চারটি পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এমন অবরুদ্ধ সময়ে বিল গেইট ও পোপ মহোদয়ের অনুধ্যান অবলম্বনে কিছু উপলব্ধি ও চেতনা সহভাগিতা করছি যা আমাদের জীবনকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

১) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। প্রতিটি মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তার বিশেষ ভালবাসা রয়েছে, তিনি নারী বা পুরুষকে অসীম মর্যাদা দান করেছেন। আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, পেশা, ধর্ম, আর্থিক অবস্থা অথবা আমরা কতটা বিখ্যাত হিসেবে পরিচিতির চেয়ে বরং নির্বিশেষে আমরা সবাই মানুষ। সব মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। মানুষের জীবন সংহারে করোনাভাইরাস সকলের সাথে সমানভাবে উন্মত্ত আচরণ  করছে। করোনাভাইরাস মানছে না শত্রæ-মিত্র, ধনী-গরিব। শাসিতের সঙ্গে সঙ্গে শাসকও আক্রান্ত হচ্ছে। কেউ নিরাপদ নয়, কেউ দুশ্চিন্তামুক্ত নয়। যদি তা বিশ্বাস না করি তবে আমেরিকার বিখ্যাত সুপার স্টার টমাস জেফরি হ্যাস্ক, বিশ্বনেতা, ডাক্তার, নার্স, ধর্মগুরু ও জনপ্রিয় ফুটবল খেলোয়ারদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি তারাও আক্রান্ত হয়েছেন। 

২) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- মানবজীবন তিনটি মৌলিক পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যথা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে, প্রতিবেশীর সঙ্গে এবং পৃথিবীর সঙ্গে। এই তিনটি জীবনদায়ক সম্পর্কে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের একজনের উপর যা প্রভাব ফেলে তা অন্যকেও প্রভাবিত করে। এটি ভাবনার বিষয় যে দেশে দেশে নির্মিত কংক্রিটের প্রাচীরগুলো মিথ্যা সীমানা। এগুলোর মূল্য খুবই কম কারণ করোনার কোন পাসপোর্টের প্রয়োজন পরে না, করোনা কোন সীমান্ত মানছে না। অভিবাসী বিষয়ক বাণীতে পোপ মহোদয় অনেকবার বলেছেন- সীমানা প্রাচীর মানুষ দ্বারা নির্মিত তবে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন এক বিশ্বমÐল, এক অভিন্ন বসতবাটি। একটু অনুভব করি, অসংখ্য অসহায় মানুষ সাড়া জীবন নিপীড়িত ও অত্যাচারিত অন্যদিকে ভাইরাসটি আমাদের সকলের উপর সমানভাবে খুব অল্প সময় অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। নিপীড়িত মানুষের তুলনায় আমাদের কষ্ট ক্ষণিকের। 

৩) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- আমাদের স্বাস্থ্য খুবই মূল্যবান। আমরা রাসায়নিকের সাথে দূষিত পুষ্টিকর খাবার খেয়ে ও পানীয় জল পানের মাধ্যমে নিজেকে অবহেলা করে আসছি। আজ থেকে আমরা যদি আমাদের স্বাস্থ্যের প্রতি যতœবান না হই তাহলে আমরা আরো বড় রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হব ।

৪) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- মানুষ হিসেবে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি চেতনায় আনতে হবে তা হল- আমাদের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। আমাদের উচিত একে অন্যকে সহায়তা করা, বিশেষত যারা বৃদ্ধ, অসুস্থ ও বিপদাপন্ন। এ সময় টয়লেট পেপার কিনতে হুড়াহুড়ি করা একটা হাস্যকর কাজ, লজ্জিত হওয়ার বিষয়।

৫) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- বর্তমান আমরা কী ধরণের বস্তুবাদী হয়েছি। জীবনের কঠিন সময়ে বুঝতে শিখেছি যে আমাদের অতি দরকারী বিষয়সমূহ হল আমাদের নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন- খাদ্য, জল, ওষধ অথচ বিলাসিতার জন্য আমরা কখনও কখনও মরিয়া হয়ে ছুটে চলছি।

৬) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- পরিবার ও পারিবারিক জীবন আমাদের কাছে কতটা মূল্যবান। আমরা খুজঁছি- পরিবার তুমি কোথায়? অথচ এটিকে আমরা কতটা অবহেলা করে থাকি। করোনা আমাদের নিজ ঘরে অবরুদ্ধ করেছে, বুঝেছি পরিবারই প্রকৃত আশ্রয়স্থল। আমরা পরিবারকে গুরুত্ব দিচ্ছি এবং আপনজনদের সাথেই আছি। পরিবারই প্রার্থনার গৃহ হয়ে উঠেছে, সৃষ্টিকর্তা পরিবারে নীরব অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন।

৭) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- শুধু কাজে ডুবে থাকতে আমাদের সৃষ্টি করা হয়নি অথচ আমরা তা-ই করে থাকি। কাজের মাধ্যমে আমরা ধরিত্রির রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকি।পোপ মহোদয় আমাদের যতœবান হতে পরামর্শ দিয়েছেন, ধরিত্রির সুরক্ষা করা ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্ব। যতœবান হওয়টা জীবনের একটি অংশ। আমাদের অন্যতম কাজ নিজের প্রতি যতœবান থাকা, একে অপরকে দেখাশোনা করা, একে অপরকে সুরক্ষা দেয়া এবং অপরের উপকার করা।

৮) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- এখনই আমাদের নিজের ইগোসমূহ যাচাই করা দরকার। আমরা নিজেকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করি বা অন্যে আমাদের কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে তা আসল নয়। একটি মাত্র করোনা আমাদের ব্যস্ত বিশ্বকে এক স্থবিরতায় এনে দিতে পারে।

৯) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি আছে। আমরা ইচ্ছা করলেই সমদায়িত্ববোধ চেতনা জাগ্রত করতে পারি। আমরা একে অন্যকে সহায়তা করতে পারি, সহভাগিতা সংস্কৃতি জাগ্রত করতে পারি, অন্যের প্রয়োজন অনুভব করতে পারি এবং সমর্থন করতে পারি। আবার আমরা ইচ্ছা করলে স্বার্থপর হয়ে উঠতে পারি, প্রয়োজনের বেশী নিজের কাছে জমা রাখতে পারি। কেবল আমাদের নিজের যতœ নিতে ব্যতিব্যস্ত থাকতে পারি। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের কঠিনসময়টা আমাদের নিজের মুখোশ খুুলে ফেলে সঠিক পরিচয় বের করে দেয়।

১০) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- আমরা কঠিন সময়ে ধৈর্য ধরতে পারি আবার আমরা আতঙ্কিত হয়ে সমাজে গুজব ছড়াতে পারি। আমরা বুঝতে পারছি এমন পরিস্থিতি বিশ্বে বহুবার হয়েছিল এবং বিশ্ব অতিক্রমও করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিও শেষ হয়ে যাবে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে এটি বিশ্বের সমাপ্তি হিসেবে দেখতে শুরু করতে পারি। ফলস্বরূপ, আমাদের ভালোর চেয়ে বেশী ক্ষতি করতে পারি। পরে এসব ভেবে আমরা লজ্জা পেতে হবে।

১১) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- হয়তো বা এটি শেষ অথবা একটি নতুন সূচনা। এটি হতে পারে উপলব্ধি ও অনুধাবন করার একটি সময় যে, আমরা ভুলসমূহ থেকে শিখি। অথবা এটি এমন একটি চক্রের সূচনা হতে পারে যা থেকে পরিশেষে আমরা বুঝতে শিখবো যা আমাদের বুঝার দরকার ছিল।

১২) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- পৃথিবী অসুস্থ। এটি আমাদের অন্তর গভীরে সচেতন করতে চাইছে যে, আমাদের প্রয়োজনীয় বনাঞ্চলকে আমরা কী মারাতœকভাবে বিনষ্ট করে ফেলেছি, টয়লেট পেপার পেতে শপিং মলে যেমন হুমড়ি খেয়ে পরছি তেমন গুরুত্বসহ পরিবেশ ও বনাঞ্চল সংরক্ষণে যাপিয়ে পড়তে হবে। আমরা বসতবাটি অসুস্থ থাকায় আমরা অসুস্থ।

১৩) করোনা ভাইরাস আমাদের ভাবতে সুযোগ করে দিয়েছে যে, প্রতিটি কঠিন সময়ের পরে একটা স্বস্তির সময় রয়েছে। জীবন একটি চক্র। এটি জীবনচক্রের একটি গুরত্বপূর্ণ চক্রমাত্র। আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই, এটাও কেটে যাবে, সমাপ্ত হবে এক দিন। পোপ মহোদয় স্মরণ করিয়ে দেন- ভবিষ্যতের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব; পাওয়ার চেয়ে দেওয়াতে আনন্দ বেশী; ভালবাসা বিহীন জীবন শুষ্ক বা আকর্ষণহীণ জীবন; ভালবাসা শুধুমাত্র কথায় নয়, কাজেও দেখাতে হয়। 

১৪) অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- করোনা বিশ্বের জন্য বিপর্যয় হিসেবে দেখছি। অন্যদিকে এটি "বিরাট সংশোধক" হিসেবেও দেখা য়ায়। বিশ্ব পর্যায় যেমন স্থানীয় পর্যায় তেমনি আলোচনা, সভা, কর্মশালাসমূহে অর্জিত শিক্ষাসমূহ আমরা ভুলে থাকতে চাই, ছুড়ে ফেলা সংস্কৃতি, নিরবতার সংস্কৃতি, বিশ্বব্যাপক ঔদাসীন্য মনোভাব লালন করছি সেগুলো আবার স্মরণ করে দেওয়া হচ্ছে। আবারও আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর নির্ভর করে- আমরা শিখতে পারি অথবা না শিখেও থাকতে পারি। 

(সহায়ক সূত্র: বিল গেইট অনুধ্যান, এনার্জি নাও মিডিয়া বা দ্য সান, মার্চ ২০, ২০২০ খ্রিস্টবর্ষ; সর্বজনীন পত্র- খ্রিস্টোস ভিভিট এবং লাউদাতো সি, পোপ ফ্রান্সিস) 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন