রবিবার, ২৯ মার্চ, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে কর্মস্থল ফিরে দেখা


বর্তমান সংকট মানুষের জীবনচক্রের একটি দুর্যোগপূর্ণ অধ্যায়, যা অতি গুরুত্বসহ মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমরা জানতে পারছি এমন পরিস্থিতি বিশ্বে বহুবার হয়েছিল এবং বিশ্ব অতিক্রমও করেছে আমাদের আতঙ্কিত হওয়া ঠিক হবে না, প্রতিটি কঠিন সময়ের পরে একটা স্বস্তির সময় রয়েছে আমরা কঠিন সময়ে ধৈর্য ধরতে পারি, আবার আতঙ্কিত হয়ে এটি বিশ্বের সমাপ্তি হিসেবে দেখতে শুরু করতে পারি সমবেতভাবে ভবিষ্যতের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব জাতি হিসেবে সংকট, দুর্যোগ অতিক্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে আমার বিশ্বাস সেই একই চেতনায় আমরা আবারো জেগে উঠবো আমাদের দেশের দুর্যোগ, সংকটে সেদিনগুলোতে আমাদের একতা ছিল আমাদের বল বর্তমান বিশ্বসংকটে আমাদের বিজয়ী করবে আমাদের মানসিক ঐক্য- ঘরবন্দী জীবন, সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্ন থাকা, বন্ধাবস্থা এবং নিজের যত্নবান হয়ে  এটা করছি বিশ্বের সংকট নিরাময়ের কারণে, ভাল ফল পাওয়ার জন্যই তা আমরা গ্রহণ করছি

আমরা আবারও ফিরে যাব চিরচেনা কর্মব্যস্ত সময়ে, পুরোনো কর্মপরিবেশে বর্তমান অবরুদ্ধ সময়ে আমরা ফিরে তাকাতে পারি আমাদের কর্মস্থল কর্মপরিবেশ আমরা কতটা যত্নবান হয়ে অভিন্ন বসতবাটির রূপান্তরশীল পরিবর্তন আনতে পারি রূপান্তরিত কর্মপরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে নিজের অংশগ্রহণের কিছু বিষয় অনুধাবন করতে পারি

. নিজের আচরণে শিষ্টাচার অনুশীলন: আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন তিনি নারী বা পুরুষকে অসীম মর্যাদা দান করেছেন আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, পেশা, ধর্ম, আর্থিক অবস্থা, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অথবা আমরা কতটা বিখ্যাত হিসেবে পরিচিতির চেয়ে বরং নির্বিশেষে আমরা সবাই মানুষ সব মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী আমাদের দেশে কর্মস্থলে পুরুষদের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, নারীদের অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি পাওয়া দরকার কর্মস্থলে নারীদের প্রতি কথাবার্তা, আচার-আচরণে শিষ্টাচার অনুসরণে আমরা সুন্দর কর্মপরিবেশ উপভোগ করতে পারি

. সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা: ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেবক বা রূপান্তশীল নেতৃত্বের ভাবাদর্শে উদ্দীপিত হলে সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে কর্মক্ষেত্রের দৃশ্যমান স্থানে প্রতিষ্ঠানের লিখিত দর্শন-কর্মপ্রচেষ্টা, সুস্পষ্ট  পরিচালন নিয়ম-নীতি, জবাবদিহিতা স্বচ্ছতার প্রক্রিয়া সহজ কার্যকর থাকলে কর্মীরা সমদায়িত্ববোধ প্রেরণায় উদ্দীপিত হয়ে উঠে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষতা সুস্পষ্টতা কর্মপরিবেশ সহকর্মীদের সুরক্ষিত রাখতে পারে

. ঐশ অনুগ্রহে নবায়িত কর্মজীবন: কর্ম সম্পাদনে কর্মীদের মন পরিতৃপ্তি লাভ করে কাজে মানুষের কল্যাণ সাধিত হয় এবং সৃষ্টিকর্তা মহানুভবতা প্রকাশিত হয় তাই দিনের আরম্ভে সকলে নির্দিষ্ট জায়গায় সমবেত হয়ে ক্ষুদ্র প্রার্থনায় সৃষ্টিকর্তার কৃপা গ্রহণের মাধ্যমে দিন আরম্ভ করা যায় কর্মীদের মনের নবায়নভিত্তিক এক ঘণ্টার অনুধ্যান নিয়মিতভাবে প্রতিমাসে আয়োজন এবং নিয়মিত আধ্যাত্মিক পরিচালন ব্যবস্থা করা যেতে পারে ভাল বইয়ের ক্ষুদ্র লাইব্রেরি ব্যবস্থা করে কর্মীদের বাড়িতে বই নিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করা যায়

. কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: খ্রিস্ট বিশ্বাসী হিসেবে, তাঁর খাতিরেই আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুগত থাকি, অনুগত থাকার মাধ্যমে নিজের জীবনে কর্মস্থলে খ্রিস্টবাণীর মূল্যবোধ প্রকাশ করি এমনকি যারা দরদী কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের নয় বরং কর্তৃপক্ষ যদি বদমেজাজী হন তাদেরও ( পিতর :-২৫) প্রতি অনুগত থাকি কারণ আমরা কাজকে ভালবেসে পরমেশ্বরের সেবকের মতোই কাজকর্ম করি তিনি আমাদের একাজ করার দক্ষতা ক্ষমতা দিয়েছেন আর আমরা তাঁর আহ্ববানে সাড়া দিয়েছি এমন কর্মজীবন অন্যদের দৃষ্টি খোলে দিতে এবং খ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাসী হতে সহায়ক হতে পারে

. চাটুকারিতা পরিহার করা: প্রতিষ্ঠানের ভালমন্দ বিষয় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তা করা সুন্দর বিষয় কিন্তু অযাচিত তোষামোদপ্রিয়  স্বভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন কাজের সময় অযথা কর্তৃপক্ষের নিকট বসে সময় নষ্ট না করে বরং তাকে কাজ করতে সহায়তা করা এবং নিজে ভাল কাজ করার অভ্যাস সৃষ্টি করা যায় কাজে সৃজনশীল চিন্তা করে এবং অবসর সময়ে উদ্দীপনামূলক লেখা পড়ে নতুন চিন্তা আহরণ করে নিজের দক্ষতা বাড়ানো যায়

. কঠোর পরিশ্রমই ঐশ কর্মশক্তির প্রকাশ: বিশ্বাসী মানুষ কাজ করে নিজের কর্মশক্তিতে নয় বরং অন্তরে জাগ্রত সৃষ্টিকর্তার ঐশ কর্মশক্তিই তার কাজের মূল চালিকা শক্তি তাই আপ্রাণ সাধনা, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা অন্তরে জাগ্রত রাখা মানে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ (কলসীয় :২৭-২৯)

. পারস্পরিক যত্নশীলতা চর্চা: সহকর্মীদের পারস্পরিক যত্নশীলতা সম্পর্ক বৃদ্ধি করে একসাথে টিফিন দুপুরের খাবার গ্রহণ করা যায় একত্রে সময় কাটানোর মাধ্যমে একে অন্যকে ছোট ছোট সেবা সহভাগিতা করে নিজেদের যত্নশীলতার মনোভাব প্রকাশের সুন্দর সুযোগ সৃষ্টি হয়

. উৎসাহমূলক উপহার: সহকর্মীদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন-তারিখে (জন্মদিনে, বিবাহ বার্ষিকী, বিশেষ সম্মান অর্জন) ক্ষুদ্র কার্ড, কার্ডে সুন্দর অর্থপূর্ণ শুভেচ্ছা উক্তি বা পবিত্র বাইবেলের কথা নিজ হাতে লিখে পাঠানো যায় অনেক কর্মজীবী-পেশাজীবী ব্যক্তি প্রতিদিন অনেক চিঠিপত্র পান কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ে নিজে যখন এমন কিছু পাবে তখন অনেক উৎসাহ নিয়ে গ্রহণ করে উদ্দীপিত হবে

. সান্ত্বনামূলক আচরণ:  সহকর্মী যখন সংকটময় সময় (দুর্ঘটনা, পারিবারিক দুঃসময়, অসুস্থতা) অতিক্রম করে তখন দেখতে যাওয়া, পাশে থাকা, খোঁজ-খবর নেয়া, সহযোগিতা করা, কার্ডে সান্ত¡না বাণী প্রেরণের  মাধ্যমে খ্রিস্টের সান্ত¡না প্রদান করা যায়

১০. অতিথিবৎসল মনোভাব পোষণ: সমমনা সহকর্মীরা একত্রে নিজের বাড়িতে চিত্তবিনোদন সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে একত্রে খাবার আয়োজন বেড়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারি কোনো খেলাধুলার আয়োজনের মাধ্যমে অন্যের জীবনকে আনন্দময় করার উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করা যায়

১১. সৌজন্যমূলক শব্দ ব্যবহার: অন্যের নিকট থেকে কোনো প্রাপ্তির জন্যধন্যবাদ  স্বাগতএমন সৌজন্যসূচক শব্দ ব্যবহার নিজেদের সম্পর্ক সুন্দর করে ইতিবাচক কথা বলা, ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার আচরণে শিষ্টাচার প্রকাশ পায় নোংরা শব্দ পরিহার, সমালোচনামূলক কথা না বলা, বিচারকি কথা-বার্তা পরিহার কর্মপরিবেশ সুন্দর রাখতে সহায়ক পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ার সেতুবন্ধন হিসেবে নিজেকে বিনিয়োজিত রাখতে সচেতন হওয়া যায়

১২. দলীয়করণ মনোভাব ত্যাগ: সহকর্মীদের মাঝে পেশাগত বিষয় নিয়ে দলীয়করণ মনোভাব প্রকাশ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে না দিয়ে বরং সমদায়িত্ববোধ প্রেরণাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণে কর্মপরিবেশ সুন্দর হয়ে উঠে খ্রিস্টই আমাদের আহ্বান করেছেন যেন পুনর্মিলিত হই, আর আমরা যেন পুনর্মিলনের জন্য কাজ করি ( করিন্থীয় :১৮-২১)

১৩. ধৈর্যশীলতা চর্চা করা: কর্মস্থলে কোনো সংকট, কোনো সংকটমূলক কাজ সমাধান করতে সৃষ্টিকর্তার নিকট বিশেষ কর্মশক্তি অনুপ্রেরণা কামনা করুন যেন অতিরিক্ত চাপ গ্রহণ করতে পারেন সহকর্মীরা আপনার জীবনের ভিন্নতা উপলব্ধি করতে শুরু করবে

১৪. সক্রিয় শ্রোতা হয়ে অনুধাবন করা: প্রথমে আপনার পরিচালনাকারী পবিত্র আত্মার পরিচালন বাক্য অন্তরে শ্রবণ করতে চেষ্টা করা এবং সহকর্মীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার অভ্যাস করতে অনুশীলন করা যায় সহকর্মীদের যেকোনো সংকটকালীন সময়ে সহভাগিতা মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করুন এবং চিন্তাশীল সঠিক পরামর্শ দিন সংকট উত্তরণমূলক বই, লেখা উপহার দেয়া যায়

১৫. গাড়ীতে ভ্রমণ সময় সহভাগিতা: সহকর্মীদের সাথে একই গাড়ীতে ভ্রমণ সময়টি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে সহভাগিতা বা মতামত প্রকাশের একটি অপূর্ব সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা যায়

১৬. সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস: আপনার কর্মজীবনে প্রতিটি পদক্ষেপে খ্রিস্টের বাণীর মূল্যবোধ অনুসরণ করা যায়  আপনার বিশ্বাস অন্যদের দৃষ্টি খোলে দিবে বিশ্বাসী হতে সাহায্য করবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাত বিশ্বাস জীবনের সংকট নিরসনে শক্তি পাওয়া যায়

১৭. নিয়মিত প্রার্থনার অভ্যাস অনুশীলন: সহকর্মীরা যখন সমস্যা নিয়ে সহভাগিতা করে তখন প্রার্থনা করতে অনুপ্রাণিত করা যায় প্রার্থনার কার্ড থেকে একত্রে প্রার্থনা করতে পারলে সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত হবে প্রার্থনা কার্ড উপহার দিয়ে প্রার্থনা করতে সহায়তা করা যেতে পারে উপাসনালয়ে গিয়ে তার জন্য প্রার্থনা করুন এবং কিছুদিন পর তার সমস্যার বর্তমান অবস্থার খোঁজ নিন

১৮. দয়ার মানুষ হওয়া: আমাদের কাজে তিনটি ঐশগুণ- বিশ্বাস, আশা ভালবাসা প্রকাশকে দয়া বা দয়াশীলতা বলে থাকি দয়ার কাজসমূহ দুই ভাগে চিন্তা করে থাকি- () দৈহিক দয়ার কাজ- যা অন্যের বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণে সহায়ক () আধ্যাত্মিক দয়ার কাজ- যা অন্যের মন-হৃদয়-আত্মার প্রয়োজন পূরণ করে থাকে অসুস্থ, বৃদ্ধ বিপদাপন্নদের পাশে বসে থাকা, ফোন করে খোঁজ-খবর নেয়া, ভাল পরামর্শ দেয়া-নেয়া, কারো দুঃখ-কষ্টের কথা মনোযোগসহ শোনা সবই  আধ্যাত্মিক দয়ার কাজ কর্মস্থলে প্রতিদিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দয়ার কাজ আমাদের খ্রিস্টবিশ্বাসী জীবন অর্থপূর্ণ করে দয়ার কাজ আমাদের অন্তরে ঈশ্বর প্রেম মানব প্রেমের প্রকাশ ঘটায়

আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ, আগ্রহ অনুশীলন মহৎ কিছু অর্জনে সহায়ক হতে পারে আমাদের কর্মস্থল, কর্মপরিবেশ, আমাদের সামাজিক জীবনে রূপান্তর এনে দিতে পারে এইজন্যই আমরা হয়ে উঠেছি বিশেষ মানুষ স্বয়ং পরমেশ্বরের জাতি, তিনি আমাদের প্রতিনিয়ত আহ্ববান করছেন যেন আমাদের জীবন কাজ দিয়ে তাঁরই সমস্ত মহাকীর্তির কথা প্রচার করি ( পিতর : -১০)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন