বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে মানবিক আচরণ করি


১. এ দুর্যোগ সময়ে আমরা দেখছি- কিছু লোকজনের আচার-আচরণে মানবিক বিপর্যয়ের পদচিহ্ন অন্যদিকে অনেক হৃদয়বান লোকজনের দায়িত্বশীল মানবিক আচরণ। সংবাদ থেকে নেয়া কিছু ঘটনা আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারি এবং সদ্বিবেচনা ব্যবহার করে যা সঙ্গতিপূর্ণ, বাস্তবধর্মী ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারি। দেশের দক্ষিণ এলাকা গোপালগঞ্জের একজন স্বাস্থ্যকর্মী যুবতীনারী; সে হাওড় এলাকার সাধারণ, সহজ, সরল, অতি দরিদ্র পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যা। আপনজনদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ঢাকা শহরে একটি অ-সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে একসময় হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ ঘোষণা করে, কিছুটা বাধ্য হয়ে সে লকডাউন উপেক্ষা করে অনেক কষ্টে গ্রামে আপনজনদের কাজে চলে আসে। দুর্গত সময়ে মেয়েকে কাছে পেয়ে আপনজনরাও খুশী। কিন্তু সামাজিক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের কাছে তারা হেরে যায়, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার হুকুমে লকডাউন হিসেবে তালপাতার 'ঝুপড়িবন্দি' হয় মেয়েটি। বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি ও কাদাময় পুকুরধারে ভয়ে আতঙ্কে মেয়েটির লকডাউন জীবন শুরু হয়। পরিবারের আপনজনদের জীবন বাঁচাতে যুবতী মেয়ে ঝুঁকি নিয়ে শহরে কাজে গিয়েছে, এখন দুর্যোগে নিজের জীবন বাাঁচাতে ঝুঁকিপূর্ণ এ দুর্গতি গ্রহণ করেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সময়ে সৃষ্টিকর্তা পরমকরুণা দেখিয়েছেন,  মেয়েটিকে বড় ক্ষতির আশংকা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রক্ষা করেছে। মেয়েটির জন্য আপনজনদের পাশে স্থানীয় প্রশাসন টিনের একচালা তৈরি করে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একদিকে সমাজের কিছু মানুষের নিষ্ঠুর অবস্থান অন্যদিকে একই সমাজের মানুষদের দয়াশীল মানবিক আচরণ; এসব আমরা প্রত্যক্ষ করছি এ দুর্যোগ মুহূর্তে।

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাগড়াছড়ির একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে কোথাও চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে। তার ভাই জানিয়েছে- দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিল তার ভাই। ভারতেও সে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল। দেশে ফিরে আবারও ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে কোথাও চিকিৎসা না পেয়ে খাগড়াছড়ির আগাশিলং পাড়ার নিজ ঘরে তার মৃত্যু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়টি খোঁজখবর নিয়েছেন, ডাক্তারদের জবাবদিহিতা চেয়েছেন।

৩. আমরা খবরে পড়েছি চাঁদপুরের অতি দরিদ্র বৃদ্ধ অভিবাসী শ্রমিক ঢাকা কেরানিগঞ্জে কারখানা মজুর ছিল। অসুস্থতা অনুভব করলে নিজ গ্রামে বাড়িতে ফিরে যায়। তার গ্রামের বাড়িতে কেউ বসবাস করে না; স্ত্রী  আগেই মারা গেছে। কিন্তু সামাজিক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের কারণে নিজের ঘরে আশ্রয় নিতে পারেনি। অবশেষে পাশের গ্রামে একমাত্র মেয়ে শশুরবাড়িতে যায়, কিন্তু মেয়ের আপনজনরা তাকে আশ্রয় দিতে রাজি হননি। অবশেষে তারা বৃদ্ধকে পাশের ঈদগাহ্ মাঠে ফেলে আসে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণা, স্থানীয় প্রশাসন বৃদ্ধকে তাদের আশ্রয়ে নিয়েছে।  অন্য আরেকজন বাবার মৃত্যু হলে তার মৃত্যুর সনদ নিয়ে মৃতদেহ হাসপাতালে ফেলেই চলে এসেছে আপন সন্তানরা। বাবার পেনশনের টাকা তোলার জন্য ছেলেমেয়েরা হয়তো মৃত্যুর সনদ তুলে নিয়েছে।  

৪. মা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে শেরপুরের নালিতাবাড়ি যাবার পথে সখিপুরের জঙ্গলে অসুস্থ মাকে ফেলে আসে মেয়ের জামাইসহ অন্যরা। সারারাত সেই মায়ের আর্তচিৎকার পথের কুকুর আর গাছের পাখি ছাড়া আর কারও কানে পৌঁচ্ছেনি। পরদিন এলাকাবাসী ও পথচারীরা চিৎকার শুনে খবর দিলে পুলিশ উদ্ধার করে বিপদাপন্ন নারীকে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে পটুয়াখালির রাঙ্গাবালির এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে রাস্তায় ফেলে যায় আপনজনরা। স্বামী পরিত্যক্তা অতি বিপদাপন্ন নারী সারারাত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত কাটায় খোলা আকাশের নীচে। উপজেলা কর্মকর্তা এবং ওসি খবর পেয়ে নারীকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে; পরে তার স্বজনদের কাছেই ফেরত পাঠায়।

৫. করোনাভাইরাস আক্রান্ত না হয়েও পাঁচ হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন এক প্রকৌশলী। পারিবারিক সূত্র জানায়- তার বংশগত হাপানি ও অ্যাজমা রোগ ছিল। সাভার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ পাঁচ হাসপাতালে সে চিকিৎসার জন্য ঘুরেছে। আত্মীয়স্বজন অভিযোগ করেছে- সাভার উপজেলা এলাকায়  করোনাভাইরাস সন্দেহে চিকিৎসা না দিয়ে আনসার ডেকে জোর করে এক হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। তার মৃত্যুর পর তার এক প্রতিবেশীসহ তার বাড়ি প্রশাসন লকডাউন করে দেয় ।

৭. সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের এক ইটভাটা শ্রমিক জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যান। তার মরদেহ দাফনের জন্য গ্রামের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের খাটিয়া নিতে বাধা দেয়  গ্রামবাসী। বাধ্য হয়ে মৃতের বাবা ও দুই ভাই মৃতদেহ নিজেদের কাঁধে বয়ে নিয়ে যায় এবং দাফনের ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের ভয়ে মৃত ব্যক্তির সৎকারে যখন ছেলেমেয়েসহ অন্য আত্মীয় স্বজন আসেনি এবং কেউই ধর্মীয় আচার পরিচালনা করতে রাজি হননি;  তখন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী নিজ কাঁধে খাটিয়া তুলে সহকর্মীদের সাথে নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেছেন। 

৮. তাঁর মতই দয়ালু হতে সৃষ্টিকর্তা আমাদের আহ্বান করেন; এই অভিন্ন বসতবাটির সকল জীবনের রক্ষণাবেক্ষণ করা তাঁর প্রদত্ত দায়িত্ব। আমাদের মানবিক আচরণ ও কাজসমূহের ভিত্তি তিনটি ঐশগুণের সমন্বয়; এগুলো হলো- বিশ্বাস, আশা ও ভালবাসা। আমাদের কাজে বিশ্বাস, আশা ও ভালবাসা প্রকাশকে দয়া, দয়ার কাজ বা দয়াশীলতা বলে থাকি। দয়ার কাজসমূহ দুই ভাগে চিন্তা করতে পারি- (ক) দৈহিক দয়ার কাজ: যেসব দয়ার কাজ অন্যের বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণে সহায়ক; যেমন- অতি দরিদ্র-বৃদ্ধ-বিপদাপন্নদের সাহায্য করা, অনাথদের ভরণপোষণ করা, মৃতের সৎকার করা ইত্যাদি এবং (খ) আধ্যাত্মিক দয়ার কাজ: যেসব দয়ার কাজ অন্যের মন ও হৃদয়ের অভাব প্রয়োজন পূরণ করে থাকে; যেমন- প্রার্থনা করা, সৎ জীবন যাপন করা, সুপরামর্শ দেওয়া, অন্যের দুঃখ-কষ্টে একাত্মতা প্রকাশ করা ইত্যাদি। প্রতিদিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দয়ার কাজ আমাদের মানবজীবন অর্থপূর্ণ করে; দয়ায় মানুষ হতে সহায়তা করে, আমরা দয়ালু হয়ে উঠি। আমাদের কিছু কিছু দয়াশীলতা আমাদের পরিবার, পরিবেশ, কর্মস্থল, আমাদের সমাজবদ্ধ জীবনে রূপান্তর এনে দিতে পারে। এইজন্যই আমরা হয়ে উঠেছি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম। এ দুর্গতিতে শুধুই মানবিক লোকজনে ও তাদের দয়ার কাজে ভরে উঠুক দেশ।


(ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি কিছু সুপারিশ


১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন- আপাতত কোনো স্কুল-কলেজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না, তবে জীবনযাপনের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করা যেতে পারে। সোমবার সকালে (বিডিনিউজ২৪.কম, এপ্রিল ২৭, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ) গণভবন থেকে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেন- "স্কুল এখন আমরা খুলব না। স্কুল কেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটাও খুলব না।"  তিনি আরো বলেছেন- "অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই স্কুল কলেজ সবই বন্ধ থাকবে যদি না করোনাভাইরাস তখনও অব্যাহত থাকে। যখন এটা থামবে আমরা তখনই খুলব। বেশি জনসমাগম যেন না হয়।"

২. ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন- পাঠদানের ধারাবাহিকতা রাখতে ২৯ মার্চ থেকে সংসদ টিভিতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়েছে, আর গত ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের ক্লাস শুরু হয় । এই ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে এসব বাড়ির কাজ দেখাতে হবে। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজের উপর প্রাপ্ত নম্বর তাদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং নিয়মিত ক্লাশ অনুসরণ করলে, খাতায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নোট নিতে থাকলে এবং তারিখভিত্তিক নিজেদের বাড়ির কাজ করে নির্দিষ্ট ফাইলে রাখলে ক্লাশ শুরু হলে সুবিধা হবে।

৩. সুতরাং শিক্ষার্থীরা কিছুদিন যাবৎ লেখাপড়ার প্রচলিত পদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন তবে শিক্ষাগ্রহণ থেকে কিন্তু পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন নয়। ইতোমধ্যে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় অনেকেই শিক্ষার আগ্রহটা চলমান রেখেছে। করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালীন সময়ে বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া চলমান রাখা দরকার। পোপ মহোদয় বলেছেন- এমন পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রা সচল রাখার জন্য মনোযোগিতা ও সৃজনশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ দুর্যোগে বদলে যাওয়া ‘নতুন স্বাভাবিক’ পরিস্থিতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতে হবে।

৪. বাসা, স্কুল, পড়া, বন্ধু এবং খেলাধুলা এসব স্বাভাবিক ছন্দময় জীবনের করোনাভাইরাসের কারণে ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থা শুরু হয়েছে ।  ছুটি ঘোষণা হলে প্রথমে বিষয়টা যতটা আনন্দের ছিল, তবে দিন গড়ানোর সাথে সাথে ততটা দখল করছে অস্থিরতা। বিশ্বজুড়ে পরিবার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য দিনের বেলা জীবনের ছন্দ বদলানো কঠিন হয়ে পরেছে,  বিশেষত যখন স্কুলের পাঠসমূহ ঘরে বসে চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মহামারীর দুর্যোগে বাবা-মা সন্তানকে জীবনের খুব মূল্যবান একটি দর্শনের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিতে পারে- প্রত্যেকের জীবনে বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন অনিশ্চয়তা আসবে এবং সেই অনিশ্চয়তার ভিতরেও জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

৫. শিক্ষার্থীদের অন্তরের ‘আশা’ সব সময় জাগ্রত রাখতে হবে, নিরাশ হওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে একদিকে করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বকে একটি বিরাট ট্র্যাজেডি ও বিঘ্নের মধ্যে ফেলেছে অন্যদিকে বিশ্বকে ট্র্যাজেডি জয় করতে একত্রিত করেছে। করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করতে বিশ্বজুড়ে মহামারী নিয়ে ‘একটা যুদ্ধ’ চলছে। এসময়ে বিশ্বের সব জ্ঞান, সব বিজ্ঞান, সকল পরামর্শ নিয়ে মানুষকে রক্ষা করার লড়াই চলমান আছে; মানবতার পক্ষে বিশ্ব একত্রে একমাত্র লক্ষ্য তৈরি করেছে। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য আশার আলো ও অনুপ্রেরণামূলক।

৬. প্রথমেই লেখাপড়ার নতুন অবস্থাটার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে, এজন্য একটি নিয়মিত সময়সূচী থাকলে খুবই সহায়ক হবে। বড়দের সহযোগিতা নিয়ে ‘একটি সৃজনশীল রুটিন’ প্রস্তুত করলে উপকার হবে। রুটিন মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও উঠা, নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস,  প্রার্থনা এবং বিষয়ভিত্তিক পড়ায় নিজেকে অভ্যস্ত করলে উপকার হবে। অবসর সময়ে সখের বিষয়সমূহ- ছবিআঁকা, গান-নাচ অনুশীলন, বইপড়া, খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার অভ্যাস করা যেতে পারে। নিজের একটা শৃঙ্খলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বাড়িতে অবস্থান করে কিছু শিখতে আরও বেশি শৃঙ্খলা প্রয়োজন। অভিভাবকবৃন্দ পাশে থেকে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সহযোগিতা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বিষয়াদি সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হবে। 

৭. পরিবারের একত্রে অনেকজন একসাথে সময় কাটছে তাই একে অপরকে পড়ালেখায় সহযোগিতা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষককে টেলিফোন বা অনলাইনে যোগযোগ করে কিছু সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে। তাছাড়া অনলাইনে সহপাঠীদের কাছ থেকে পড়াশুনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়তা প্রদান ও গ্রহণ করা যেতে পারে। 

৮. যাদের ঘরে কম্পিটার আছে তারা ঘরে বসে পরিবারের সদস্যদের সাথে কম্পিউটার সহভাগিতা করতে পারে। একে অন্যকে আরো বেশী সাহায্য করতে পারে। অনলাইনে যাদের সুযোগ আছে এই নতুন পদ্ধতিটার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে, অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যাদের কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুযোগ নাই তাদের জন্য অনেক অসুবিধা হবে। অনলাইন ক্লাশ ও সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি  হতে পারে, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য। এক্ষেত্রে যাদের সুযোগ আছে তারা বন্ধুদের মধ্যে যারা সুবিধা-বঞ্চিত তাদেরকের সহযোগিতা করার নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে পারে। একটাও একটি দয়ায়কাজ, তাতে বঞ্চিত অনেকে সুযোগ পাবে।

৯. এসময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভ্রান্ত ও বিচলিত হলে লেখাপড়া বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। টিভির খবর নির্দিষ্ট সময় ধরে দিনে শুধু এক-দুইবারের বেশি দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সেইসাথে এই মুহূর্তে স্মার্টফোন থেকে নেতিবাচক কোনো প্রচার শেয়ার না করাই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নেতিবাচক কোনো কিছু এলে সেটাকে আমরা ভাইরাসের মতো মুছে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। পড়ালেখা ও জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে মাত্র ফেসবুক ব্যবহার করা যায়, নির্ভরযোগ্য উৎস ব্যতিত বিভ্রান্তকর বার্তা মুছে পরিষ্কার করতে হবে। 

১০. শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ করছে একটি সাধারণ ভাইরাস নিয়ে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান একত্র করে দুর্দান্তভাবে গবেষণা করে যাচ্ছে। একটি বড় বিজয় দেখার জন্য বিশ্বের বিজ্ঞানীদের একসাথে কাজ করার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য একটা অনুপ্রেরণা হতে পারে। কখনও কখনও কঠিন বিষয়ে শেখার জন্য 'দলীয় পদ্ধতি' সত্যই কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ যা শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করতে পারে।

১১. নিজের তরফ থেকেই শিক্ষার্থীদের একটা উদ্যোগ নিতে হবে।  কেননা যেকোন রোগ থাকুক, খারাপ জিনিস থাকুক বা অসুস্থতা থাকুক সেটার ব্যাপারে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। বাসায় থেকে প্রথমেই নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, কেননা প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরছেন। তবুও ঘরে থাকতে হবে, সাবধানে থাকতে হবে।

১২. এমন সময় পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন-  আমরা আজ সেই শিক্ষকদের জন্য প্রার্থনা করছি যাদের ইন্টারনেট এবং অন্যান্য ডিজিটাল উপায়ে পাঠদানের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আমরা এমন শিক্ষার্থীদের জন্যও প্রার্থনা করি যাদের অভ্যাস না থাকা সত্ত্বেও বিকল্পভাবে পরীক্ষা দিতে হবে।  তিনি আহ্বান করেছেন- আমরাও যেন নিজেদের জন্য প্রার্থনা করি। তিনি আরো বলেছেন- আমরা খ্রিস্ট যিশুর নিকট প্রার্থনা করি তবে যিশুও আমাদের জন্য পিতা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করছেন। পোপ মহোদয় আরো বলেছেন- মে মাসে পরিবারের সকলে যখন একত্রে আছি তখন একত্রে রোজারীমালা প্রার্থনা করার একটা সুযোগ আছে; মা মারীয়ার মত অন্তর নিয়ে খ্রিস্টের মুখচ্ছবি ধ্যান করলে আমাদেরকে আরও আধ্যাত্মিক পরিবার হিসাবে একীভূত করে তুলবে এবং পরীক্ষার এই সময়টাকে কাটিয়ে উঠতে আমাদের সহায়তা করবে। মৌলিক প্রার্থনাসমূহ একত্রে আবৃত্তি ও বাইবেল পাঠ করতে করতে ছোটরা কিন্তু শিখার পাঠেই সম্পৃক্ত থাকবে। অভিভাবকদের একটু সৃজনশীল মনোযোগের কারণে করোনা প্রাদুর্ভাব সমাপ্ত হলেও আধ্যাত্মিক ফলটা রয়ে যাবে।

রবিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে সেবা ও সুরক্ষা- উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ


১. এই দুর্যোগ সময়ে একজন বিশপ মহোদয়ের সাথে ফোনে আলাপ হয়েছে। বিশপ হাউজের কাছাকাছি কিছু অভিবাসী দিনমজুর পরিবারের সাথে আমি আগে থেকে পরিচিত। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়ে পরিবারের লোকদের প্রসঙ্গে আসলে তিনি জানালেন- বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামাগ্রী নিজেরা প্যাকিং করে ঘরে ঘরে পৌঁচ্ছে দিচ্ছেন। এভাবে দুর্যোগ মুহূর্তে খাদ্য ও সুরক্ষাসামগ্রী পথশিশুদের কাছেও নিয়ে যাচ্ছেন। নিজেই জড়িত থেকে তাঁর হাউজের আসেপাশে প্রতিবেশী অভাবী ভাইবোনদেরও এভাবেই খাদ্য ও সুরক্ষাসামাগ্রী পৌঁচ্ছে দিচ্ছেন। এমন কঠিন সময়ে অভাবী লোকদের সাথে কিছু সহভাগিতা করাটা ভীষণ আনন্দ ও পরিতৃপ্তির বিষয়। বাইবেলে খ্রিস্ট যিশু শিষ্যদের বলেছেন- তোমরা নিজেরা বরং ওদের খেতে দাও, তোমাদের ক’খানা রুটি আছে, একবার দেখে এসো তো। তিনি উত্তম মেষ পালক, শিষ্যদেরও পালক হতে নির্দেশ দিয়েছেন। একজন পালক নিজ হাতে খাদ্যসামগ্রীর ঝুড়ি অভুক্ত মেষদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, এটাই এ সময়ের অন্যতম পালকীয় সেবাকাজ।

২. পোপ ফ্রান্সিস নিজের উদ্যোগে দুর্গত এলাকা ও দেশে আক্রান্ত মানুষের জন্য ঔষধ, সুরক্ষাসামগ্রী ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পাঠাচ্ছেন। কারিতাস কিংবা ভাটিকান দাতব্য সংগঠন থাকা সত্ত্বেও নিজেই জড়িত থাকছেন। ভাটিকান সংবাদ সূত্র থেকে জেনেছি- গতকাল তিনি স্পেন দেশে সেবারত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য যথেষ্ট পরিমান চকোলেট পাঠিয়েছেন। পোপ মহোদয়ের এমনসব উপহার পেয়ে ভীষণ পরিশ্রম ও কষ্টের মাঝে তারা নিশ্চয় প্রচুর আনন্দ পাবে। সেবাকর্মীদের পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত মনে তিনি হয়তো এই আনন্দটুকুই দিতে চেয়েছেন। অনেকেই নিজেদের অবস্থানে থেকে অভাবী লোকজনের পাশে থাকছেন। যখন দেখি ছোট ছোট সংগঠন, যুবক্লাব, কয়েকজন বন্ধু মিলে অথবা একটি পরিবার অভাবী বস্তিপরিবার, জেলেপরিবার, বেদেপরিবার, অভিবাসী শ্রমিক ও দিনমজুর পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে তখন মনটা আনন্দে ভরে যায়। 

৩. লকডাউন সময়ে আমরা দেখেছি হাট-বাজারগুলোতে বহুলোকের ভীড়। অনেকেই বলছি- করোনাভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হাট-বাজার। হাট-বাজারে জনসমুদ্র  হ্রাসের জন্য সরকার ত্রাণ হিসেবে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে। তবে দেশে ক্ষুদ্র, মাঝারি  বৃহদায়তন অ-সরকারি সাহায্য সংস্থাগুলো দেখছি কোটি কোটি নগদ টাকা অভাবী লোকজনের নিকট বিতরণ করছে। কিছু কিছু সংস্থা কর্মীদের নিরাপত্তা বিষয়টি চিন্তা করে ‘বিকাশ’, ‘নগদ’ এসব অনলাইন ব্যাংকিং সেবার আশ্রয় নিয়েছে। একটি সিটির একজন কর্মকর্তাও নগদ টাকা ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করতে গিয়ে জনসেবায় হুড়াহুড়ি পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন, যা আমরা সংবাদে পড়েছি। ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে ত্রাণ হিসেবে নগদ টাকা হাতে পেয়ে অভাবী লোকেরা যখন তখন হাট-বাজারে যাচ্ছে। নিজের এলাকায় লকডাউন থাকায় পাশের হাট-বাজারে যাচ্ছে; ফলে করোনাভাইরাস বিস্তারের একটা সুযোগ থেকেই যাচ্ছে, সংকটের ক্ষত আরো গভীরতর হতেই পারে। 

৪. খবরের কাগজ থেকে জেনিছি- ভারতের কেরালারাজ্যে অভাবী জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় সরকার স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় রাজ্যজুড়ে ১,২০০এর বেশি কমিউনিটি কিচেন কার্যক্রম শুরু করেছে। যেখানে প্রতিদিন আড়াই লাখ মানুষকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করছে। কিচেন থেকে ৯০ শতাংশের বেশি খাবার বিনামূল্যে দিচ্ছে, বাকী ১০ শতাংশ খাবার মাত্র ২৫ রুপিতে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। সেখানে প্রতি ১৫দিন পরপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি প্যাকেট ৮৭ লাখ পরিবারকে পৌঁছে দিচ্ছে। যার মধ্যে বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় ১৭ রকমের পণ্যসামগ্রী রয়েছে। তাছাড়া ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি ছিন্নমূল এবং গৃহহীন মানুষদের এই দুর্যোগ সময়ে পুনর্বাসন ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে । স্বেচ্ছাসেবকরা সামাজিক দূরত্ব ও নিজেদের সুরক্ষানীতি মেনেই সেবাকাজ করছে।যার ফলে জনগণ ত্রাণ নিতে বাসার বাইরে আসছে না, তারা ঘরেই থাকছে, না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। সমাজের  সুরক্ষা নিশ্চিত থাকছে শতভাগ, সংক্রমণের হার খুবই কম। 

৫. এ দুর্যোগ সময়ে স্থানীয় সরকার, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির সমন্বিত সহায়তায় রাজ্যজুড়ে কাজ করছে। একাজে স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে গ্রাম পঞ্চায়েত পর্যন্ত একসাথে কাজ করছে। কাজটি করতে সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষদের নিয়ে ৪ লাখ স্বেচ্ছাসেবক গঠন করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যকর্মী, ধর্মীয় নেত্রীবৃন্দ ও সমাজকর্মীরা একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লকডাউন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, সঙ্গনিঃরোধ, চিকিৎসা, সৎকার, জীবন রক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে। বিশ্বের মানুষ করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকানোর তাদের কর্মকৌশলকে দেখছে ‘কেরেলা মডেল’ হিসেবে। তারাতো মাণ্ডলিক ক্ষুদ্র সমাজের সমদায়িত্ববোধ চেতনায় ‘দেখা, বিশ্লেষণ করা ও কাজ করা’ এ কর্মনীতিই অনুসরণ করছে।  এই সদ্বিবেবচনা এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে যা সঙ্গতিপূর্ণ, বাস্তবধর্মী ও দায়িত্বশীল। কেরালার প্রায় তিনকোটি জনগণের মধ্যে  ১৮% শতাংশ জনগণ খ্রিস্টবিশ্বাসী; নাগরিকরা কেরালাকে ‘ঈশ্বরের আপন নগরী’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। অন্যদের ভালকাজ দেখে ও শুনে স্থানীয়ভাবে একসাথে সমন্বিত পদ্ধতিতে কাজ করার সময়টা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সেটা হতে পারে নিজের এলাকা, পাড়া, গ্রাম, উপজেলা, জেলা বা অঞ্চল হিসেবে। পোপ মহোদয় বলেছেন- দুর্যোগ সময়ে সেবাকাজে থাকতে হবে গভীর দরদবোধসহ মনোযোগ ও সৃজনশীল কর্মকৌশল। তবুও সেবাকাজ ও সুরক্ষা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হউক।


(লেখাটিতে পোপ ফ্রান্সিস এর অনুধ্যান বাণীসমূহ এবছর পাস্কা পর্বের সময়কালে তাঁর ধর্মোপদেশে প্রদত্ত ভাটিকান নিউজ ওয়েবপেইজ থেকে সংগৃহীত হয়েছে)

বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে তাঁর উপস্থিতি এবং কিছু উপলব্ধি


১. দুষ্টরা চিৎকার করছে যখন ভালো লোকেরা  নীরব: প্রদেশপাল পিলাত যখন যিশুর কোন অপরাধ খুঁজে পেলেন না তখন সে জিজ্ঞেস করলেন- “বল, তোমরা কী চাও।” শত্রুরা চিৎকার করে ‘বারাব্বাস’ এর মুক্তি দিয়ে যিশুর শাস্তি দাবী করল। বারাব্বাস একজন কুখ্যাত বন্দি ছিল। পিলাত জিজ্ঞেস করলেন- ‘তাকে (যিশু) নিয়ে আমি এখন কী করব’। শত্রুরা আবার চিৎকার করে বলে উঠল- “তাকে ক্রুশে দাও।” যিশুর শিষ্যরা, আপনজনেরা ও তাঁর অনুসারীরা তখন নীরব ছিল আর এ সুযোগে দুষ্টলোকেরা চিৎকার করে নিজেদের কু-মতলব বাস্তবায়িত করল। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- সমাজে সৎ ও ভাল লোকেরা যখন নীরবতা সংস্কৃতি, ঔদাসীন্যের সংস্কৃতি আশ্রয় নিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করতে চায় তখনই দুষ্টলোকেরা চেঁচামেচি করে,  তাদের কু-মতলব হাসিল করে নেয়। নিকটতম আত্মীয়-স্বজন, নেতানেত্রী এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও অনেক মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। কারণ যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তাদের অনেকের মমতা নেই, মমতা থাকলে সমাজ সুরক্ষিত হবেই। অন্যদিকে ভাললোকেরা নীরব তাই নিপীড়ন ও নির্যাতন বেড়েই চলছে।

২. লুক্কায়িত ভক্তজনগণ: বাণীপ্রাচারের সময় অনেক ইহুদি ও অ-ইহুদি জনগণ যিশুর লুক্কায়িত অনুসারী ছিল। ভিন্ন ভিন্ন কারণে তারা প্রকাশিত হতে পারেনি অথবা প্রকাশিত হতে চায়নি। শিষ্যদের অন্যতম পিতর দৃঢ়ভাবে বলেছেন- যিশুর সাথে জেলে যেতে রাজি আছেন, মরতে যেতেও রাজি আছেন। কিন্তু যিশু যখন শত্রুদের দ্বারা নির্যাতিত হলেন তখন পিতর ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন এবং তিনবার তাঁকে অস্বীকার করেছেন। যিশুর শত্রুদের হাতে সমর্পিত অবস্থায় অন্য শিষ্যরাও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সবকিছু দেখেছেন। কিন্তু পরক্ষণে যিশুর বাণী স্মরণ করে অনুতপ্ত হয়ে  আবার ফিরে এসেছেন। পিতর একসময় ভয়ে তিনবার যিশুকে অস্বীকার করেছেন, পরক্ষণে পবিত্র আত্মায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হাজার হাজার জনগণের সামনে নির্বিঘ্নে যিশুর সম্পর্কে সাক্ষী  দিয়েছেন। ঐশ দয়া ও অনুগ্রহই তাঁর অন্তর রূপান্তরিত করেছে ফলে যিশুর সক্রিয় অনুসারী হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে যুদাস ঐশ অনুগ্রহ গ্রহণ করতে অপারগ ছিল ফলে তার পরিণাম ছিল ধ্বংস। আমরা হয়তো কেউ কেউ এ দুর্যোগ সময়ে ভয়ে লুক্কায়িত, যদি তাঁর অনুগ্রহের দিকে মনোযোগ দেই তবে বুঝতে পারব আমাদের অনেকেরই হয়তো সুযোগ আছে অভাবীদের পাশে দাঁড়াবার। এমন দুর্যোগ সময়ে একজন ধর্মীয় ও সামাজিক নেতা যখন জনগণের পাশে থাকেন তখন দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে তারা জনগণকে তাদের পাশে পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারেন।

৩. আপনজনেরা কাছেই থাকবে: জেরুশালেমে যিশুর প্রবেশের সময় যারা চিৎকার করে তাঁকে রাজা হিসেবে স্বীকার করেছিল তাদের অনেকেই যিশুর যাতনাভোগ ও ক্রুশমৃত্যুর সময় দূরত্ব নিয়েছে। কিন্তু তাঁর মা, মায়ের সাথে কয়েকজন নারী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্যরা যিশুর সাথে সাথেই ছিলেন। তারাই যিশুর পুনরুত্থানের প্রথম সাক্ষী হয়ে উঠেছেন। করোনাভাইরাসের দুর্যোগের সময়ে আমরা পরিবারের আপনজনদের সাথেই আছি। অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দেয়- পরিবার ও পারিবারিক জীবন আমাদের কাছে কতটা মূল্যবান। আমরা খুজঁছি- পরিবার তুমি কোথায়? অথচ এটিকে আমরা কতটা অবহেলা করে থাকি। করোনা আমাদের নিজ ঘরে অবরুদ্ধ করছে, বুঝেছি পরিবারই আশ্রয়স্থল। আমরা পরিবারকে গুরুত্ব দিচ্ছি এবং আপনজনদের সাথেই আছি। পরিবারই প্রার্থনার গৃহ হয়ে উঠেছে, সৃষ্টিকর্তা পরিবারে নীরব অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন।

৪. যত্নবান হওয়াটাও একপ্রকার আহ্বান: এ বছরের আমাদের পুনরুত্থান পর্বটি শিষ্যদের অভিজ্ঞতার মতই। একদিকে করোনাভাইরাসের ‘ধ্বংস ও মৃত্যুর আক্রমণ’ অন্যদিকে আমাদের মনে অনিশ্চয়তা ও সংশয় বেড়ে চলছে। যিশুর মৃতদেহ সমাধিস্থানে রেখে শিষ্যরা একই অভিজ্ঞতা করেছে। যিশুর পুনরুত্থানের পরে কয়েকজন নারীদলটি  সক্রিয় ছিল,  যিশুর মৃত্যু তাদের মন হতাশায় পঙ্গু করে ফেলেনি। বরং তারা একটি সাধারণ কাজ অসাধারণভাবে করেছে। তারা যিশুর দেহ লেপনের জন্য সুগন্ধি-মশলা প্রস্তুত করেছে, যা সামাজিক একটি প্রচলিত প্রথা ছিল। নিস্তার জাগরণীর ধর্মোপদেশে পোপ ফান্সিস বলেছেন- “তারা তাদের ভালবাসার দুয়ার বন্ধ করেনি; তাদের অন্তরের অন্ধকারে দয়ার শিখা প্রজ্জলিত রেখেছে।” আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কি ভয়ে ভালবাসার দূয়ার বন্ধ রেখেছি? ছোট ছোট সেবাকাজেই যিশুর সাক্ষাৎ পেতে পারি। এ সময় অনেকেই নিজের ও পরিবারের প্রতি আরো বেশী যত্নবান হয়ে উঠেছি। কারোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সময়ে যারা ভয়ে পঙ্গু না হয়ে সেবাকাজে আত্মনিয়োগ করেছে পোপ মহোদয় তাদের সেবাকাজে অভিভূত হয়ে বলেছেন- ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মিশনারি, স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশসহ সকল সেবাকর্মীরা দুর্যোগ সময়ের বীরসেনা ও সাধুসম সেবাকর্মীদল।

৫. তাঁকে জীবন্ত দেখতে মা প্রার্থনারত: যিশুর মা মারীয়া আজ আমাদের সকলের 'মা' । যিশুকে যখন সমাধিতে রাখা হয়েছে মা মারীয়া আরেকটি নতুন জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে গভীরভাবে প্রার্থনারত ছিলেন। পোপ মহোদয় বলেছেন- “যিশু মাটিতে শোয়ানো বীজ যিনি পৃথিবীকে নতুন জীবন দান করবেন এবং মা মারীয়া প্রার্থনা ও ভালবাসা দ্বারা এই আশাটি প্রস্ফুটিত হতে সহায়তা করেছেন।” প্রার্থনা আমাদের জন্য একটি অন্যতম আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন সময় দেখি ও অভিজ্ঞতা করছি। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সময় একটি অন্ধকার ও বিরক্তকর অভিজ্ঞতা যা আমাদের কাছে অভিশাপের মত হতে পার। ঐ মুহূর্তে প্রার্থনা আমাদের জীবনে গভীর অভ্যন্তরীণ রূপান্তর আনে, শান্তির সূচনা করে। মা মারীয়ার আদর্শ অনুসরণ করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নতুনজীবনের জন্য আমরা প্রার্থনা করতে পারি। সকলে সুরক্ষা পেতেও গভীর বিশ্বাস নিয়ে পরিবারে প্রার্থনারত সময় কাটাতে পারি।  এমন কী কিছু সময় পরে অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আশীর্বাদের অভিজ্ঞতা করতে পারি।  

৬. সত্য গোপন করাও একপ্রকার দুর্নীতি: যাজক ও ফরিসিরা একদল প্রহরী নিয়ে গিয়ে যিশুর সমাধির পাথরখানির ওপর সীলমোহর করল ও প্রহরী মোতায়েন করে সমাধিটি সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করল। যিশু যখন পুনরুত্থান করলেন, খবরটি চাপা দেওয়ার জন্য যাজকেরা তখন প্রবীনদের পরামর্শে প্রহরীদের কিছু টাকা দিল এবং বলতে বলল তারা ঘুমিয়ে গেলে যিশুর শিষ্যরা তাঁর দেহটাকে লুকিয়ে তুলে নিয়ে গেছে। প্রহরীরা টাকা নিয়ে তাদের নির্দেশ মতোই কাজ করল। নিজেদের মধ্যে বুদ্ধি পরামর্শ করে সত্যকে গোপন করতে সব চেষ্টাই করল। সত্যকে গোপন করাও একপ্রকার দুর্নীতি, যা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে।

৭. দুঃখ-কষ্টের পাথরটা সরিয়ে দেবে কে? যিশুর দেহে গন্ধদ্রব্য লেপন করার জন্য রবিবার দিন খুব সকালে মাগদালার মারীয়া, যাকোবের মা মারীয়া, আ সালোমে সমাধিস্থানে এলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন- তাদের জন্য কে এতভোরে সমাধিগুহার মুখ থেকে বিশাল আকৃতির পাথরখানা একপাশে সরিয়ে দেবে।তাদের জন্য যিনি ছিলেন আশা, ভালবাসা ও বিশ্বাস তিনিই আজ গুহাবন্দি আছেন । আর একখানা বিশাল আকৃতির পাথর গড়িয়ে দিয়ে গুহার মুখটি বন্ধ ক’রে দেয়া হয়েছে। পাথরখানা হল হতাশার প্রতীক, দুঃখকষ্টের প্রতীক, বেদনা-নিপীড়নের প্রতীক যা জীবনকে অন্ধকারে ফেলে রাখে। এই অন্ধকারে আলোর সন্ধান দিবে কে? তখনই অবাক হয়ে তাঁরা দেখলেন মস্তবড় পাথরখানা একপাশে গড়িয়ে দেওয়াই হয়েছে। দীর্ঘ শুভ্র পোশাক-পরা একটি যুবক ডান দিকে বসে আছেন। তাদের মনের অন্ধকার ভেদ করে আশা, ভালবাসা ও বিশ্বাসের আলো আবার প্রজ্বলিত হয়েছে। পোপ মহোদয় বলেছেন- আমাদের জীবনের কষ্টের পাথর সরিয়ে দেবে কে? আমরা বিশ্বাস করি স্বয়ং যিশু খ্রিস্ট, যিনি জীবন্ত। খ্রিস্ট যিশু এখনও আমাদের মাধ্যে আছেন, পিতা ঈশ্বর যা যা অঙ্গিকার করেছেন তিনি সবই রক্ষা করেছেন। এখনও তিনি তাঁর অঙ্গিকার রক্ষা করবেন। আমরাও অভাবী ভাইবোনদের জীবনের কষ্টের পাথর সরিয়ে দিতে পারি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে। অভাবীদের নিকট আমরা তো অপর খ্রিস্ট হয়ে উঠতে পারি।

৮. মানুষ সেবাকর্মী, মানুষ ধ্যানীও: শোকাচ্ছন্ন দু’জন শিষ্য হতাশা নিয়ে পায়ে হেঁটে এম্মাউসের  রাস্তায় গ্রামাঞ্চলের দিকে যাচ্ছিলেন। যিশু তখন তাঁদের দেখা দিলেন। যিশু বললেন- কি নির্বোধ তোমরা। প্রবক্তাদের কথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে তোমাদের দেরী হচ্ছে কেন? যিশু তাঁদের শাস্ত্রের কথা বুঝিয়ে দিলেন। খ্রিস্টবিশ্বাসী হিসেবে আমরা একদিকে যিশুর সেবাকর্মী আবার অন্যদিকে বাইবেলের কথা  অন্তরে বুঝতে ধ্যান করার জন্যও আহুত। কাজ হল ধ্যান-প্রার্থনার ফল, ব্যক্তিগত ধ্যানে তাঁর বাণীর প্রকৃত অর্থ আমরা বুঝতে পারি।

৯. কাউকেই পিছনে ফেলা যাবে না: পুনরুত্থিত যিশু যখন শিষ্যদের সাক্ষাৎ দেন তখন টমাস সাথে ছিলেন না। সে যিশুকে নিজের চোখে দেখে তবেই বিশ্বাস করতে চাইলেন। যিশু টমাসের জন্য অপেক্ষা করেন, পিছিয়ে থাকা শিষ্যকে বঞ্চিত করেননি। যিশু টমাসকে দেখা দিলেন এবং টমাস বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। যিশু যেমন শিষ্যদলে টমাসকে সম্পৃক্ত করলেন তেমনি আমাদের সমাজে যারা বিশ্বাসে দুর্বল তাদেরকেও বিশ্বাসীদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ দুর্যোগে অতি দরিদ্র, বিপদাপন্ন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সকলকে সহায়তার মাধ্যমে দুর্গতি জয় করতে পারি। পোপ মহোদয় বলেছেন- অনুদান প্রদানের সময় স্বজনপ্রীতি বা কারো কারো প্রতি ভিন্ন নীতি অনুসরণ করা ঠিক হবে না, সকল গরিবরাই ন্যায্য পাওনার অধিকারী।

১০. সাক্ষাতে সাক্ষাতে সাক্ষ্যদান: যিশু মাগদালার মারীয়াকে দেখা দিলেন, মায়ে সাথে সাক্ষাৎ করলেন, এম্মাউসের পথে দু’জন শিষ্যকে দেখা দিলেন। এভাবে পুনরুত্থিত যিশু ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের সাথে সাক্ষাৎ করতে করতে শিষ্যদের অন্তরে বিশ্বাস সুদৃঢ় করেছেন। খ্রিস্টভক্তগণ একে অন্যের সাথে নিজেদের বিশ্বাসের অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করতে করতে যিশুকেই প্রচার করার সুযোগ পায়। পোপ ফ্রান্সিস বিভিন্ন দেশে তীর্থযাত্রায় ঠাকুরদাদা, ঠাকুরমা, নানা-নানীদের বলেছেন- তাদের নাতী-নাতনীদের খ্রিস্টবিশ্বাসের গল্প শুনাতে যেন তারাও বিশ্বাসে সুদৃঢ় হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে। যাজক ও মিশনারিগণ খ্রিস্টভক্তদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাদের সাথে বিশ্বাস সহভাগিতা করার মধ্য দিয়ে খ্রিস্টবিশ্বাস আরও সুদৃঢ় করতে পারে। সামাজিক দূরত্ব থেকেও কিছু কিছু যাজক ঘরবন্দি খ্রিস্টভক্তদের সাথে পবিত্র সাক্রামেন্তের আশির্বাদ ও নিজেদের উপস্থিতির মাধ্যমে ভক্তজনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন। পোপ মহোদয় তাদেরকে 'পাশের দরজার বীর বা সাধু' হিসেবে প্রশংসা করেছেন।

১১. স্বাভাবিক তবে ‘নতুন স্বাভাবিক’: পুনরুত্থিত খ্রিস্ট জীবন্ত, তবে তিনি নতুনজীবন এনেছেন। তাঁর প্রতি বিশ্বাসী হয়ে আমরা স্বর্গীয় জীবনের অংশীদার হয়ে উঠি। করোনাভাইরাস মহামারীর পর সমাজে ও পরিবেশে রূপান্তর হওয়ার একটা সুযোগ রয়েছে। ইংলন্ডের বিশপ জন আরনল্ড বলেছেন-  করোনা দুর্যোগের পর আমরা আগের 'স্বাভাবিক' অবস্থায় আর ফিরে যেতে নাও পারি তবে আমরা যেখানে ফিরে যাব সেটা ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থা বলা যায়। অর্থাৎ আমরা দুর্যোগের পর সব পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে পাব না । একদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশে একটা নবায়ন দেখতে পাব অন্যদিকে আর্থিকভাবে, ব্যবসায়িক দিক থেকে অনেক পরিবর্তন মোকাবেলা করতে হবে। আমরা একটা 'নতুন স্বাভাবিক' পরিবেশে ফিরে যাব, আমরা কীভাবে আামাদের 'নতুন স্বাভাবিক' অবস্থাটা দেখতে চাই তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।

(লেখাটিতে পোপ ফ্রান্সিস এর অনুধ্যানবাণীসমূহ এবছর পাস্কা পর্বের সময়কালে তাঁর ধর্মোপদেশে প্রদত্ত ভাটিকান নিউজ ওয়েবপেইজ থেকে সংগৃহীত হয়েছে)

মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে প্রকৃতি ফিরেছে শহরে


১. বৃষ্টিস্নাত শান্ত-নীরব একটি সকালে বাতাসে ভেসে আসা কোকিলে প্রাণভরা কোলাহল মনকে ছুঁয়ে যায়। এই দুর্যোগ সময়েও প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখছি- পাম গাছে সবুজ টিয়া পাখিদল অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত। ভাবছি, এই দুর্যোগে প্রতিটি মানুষের খাবারের নিশ্চয়তা থাকলে তবুও মানুষকে ঘরবন্দি রাখা সম্ভব হত। সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারত।একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে খেলার মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ূই পাখির বিচরণ, ভাত শালিক, পাতি কাক, হলদে পাখি, দোয়েল, ঘুঘু, জালালী কবুতর, ময়না, টুনটুনিসহ নানারকম পাখির দূরন্ত কোলাহল দেখতে ভালই লাগছে। গাছে গাছে আম, কাঁঠাল, লিচু, বেল, পেপে, কালো জাম, নারিকেল, লেবু আর কলা এই ব্যস্ততম আঙ্গিনায় সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব উপহার । সেই সাথে ডাটা, কপি, কচুশাক, কলমিশাক, পুদিনা পাতা, ধনে পাতা,  পালংশাক, লেটুস, টমেটো, ঢেড়স, শিম, বাধাকপি, গাজর ও পুঁইশাক এই অবরুদ্ধ দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রকৃতির এক অসীম ভালবাসা। পলাশ ফুলে রাঙ্গানো গাছগুলো এখন সবুজ পাতায় নবসাজে সেজেছে, কৃষ্ণচূড়ার সবুজ সমাহার ফুলেফুলে লাল হতে শুরু করেছে। ধূলিময় বৃক্ষলতা বৈশাখী বৃষ্টিতে বিশুদ্ধতা আর সবুজে ছেয়ে গেছে। এসবই কিন্তু প্রকৃতিতে এখন এক অনন্য পরিবেশ। শহর জীবনে এমন সব সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্য মাত্র এই অবরুদ্ধ সময়ই সম্ভব।  করোনাভাইরাস দুর্গতির দিনেও এমন অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসম্ভারে ঢাকা শহরের মতিঝিলে নটর ডেম কলেজ আঙ্গিনা শোভিত।। 

২. বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণে শহুরে পরিবেশ একমাস আগেও বিপর্যস্ত ছিল। এখন মানুষ করোনায় বিপর্যস্ত আর পরিবেশ তার আপন মহিমায় শোভিত। ব্যবসা এবং ভ্রমনের উপর বিধিনিষেধগুলি বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের স্তরটিকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে। দেশে কারখানা ও যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকাতে যানজট, ধূলিবালি, তাপদাহ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ অনেক হ্রাস পেয়েছে।পৃথিবীব্যাপক ‘লকডাউন’ অবস্থার কারণে পরিবেশ দূষণ অনেক কমে গেছে, দূষণে বিপর্যন্ত অন্যত ঢাকা শহর এখন বায়ুদূষণের দিক থেকে ৬ষ্ঠ স্থানে নেমে এেসেছে। নদীর জল হয়ে উঠেছে স্বচ্ছসলিল ওদিকে সবুজে ঢাকছে বনাষ্ণল আর আকাশ হয়ে উঠেছে আরও নীল। এই অন্তরীণ সময় মাত্র একমাস, যুগের পর যুগ ধরে যাকে করেছি ক্ষতবিক্ষত সে মাত্র একমাসে সেড়ে উঠতে শুরু করেছে। বনের পশুরা স্বস্তি পেয়েছে, মুক্ত মনে কখনও কখনও মানুষের চলাচলের স্থবির রাস্তায় এসে হামাগুড়ি দিচ্ছে। পর্যটকশূণ্য কক্সবাজার সৈকতে ডলফিন দলের সাথে গোলাপী ডলফিনও ফিরে এসেছে, সেন্ট মার্টিন সৈকতের বালিভূমিতে হরেক রকম কচ্ছপ ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে যাচ্ছে। একারণে পরিবেশবাদীরা হয়তো কারোনাভাইরাসকে পারিবেশের জন্য আর্শিবাদ হিসেবে দেখছে।

৩. অবরুদ্ধ সময়ে প্রকৃতি আবার শহরে ফিরে এসেছে, প্রকৃতির আপন সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভালই লাগছে। ভাবছি আমরা এখন কোথায় আছি, আর কোথায় ছিলাম। দিনের পর দিন আমরা এই অপূর্ব প্রকৃতিকে বিসর্জন দিয়ে আসছি। করোনাভাইরাসের কারণে পরিবেশগত বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের পুরো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা ভুলে যেতে চাই না।

৪. পরিবেশদূষণে মানুষের জীবন কষ্টকর হয়ে উঠেছে, দীর্ঘসময় যাবৎ আমরা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি । মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে, প্রকৃতির যত্ন নিতে হবে। নিজের সুস্থতা ও জীবনের জন্য নিজের মৌলিক পরিচ্ছন্নতার বিকল্প কিছুই নেই। বর্তমান অভিজ্ঞতা মানুষ ভুলতে পারবে না, বরং ক্ষতিকর ও সংক্রমক রোগ থেকে মুক্ত থাকতেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। পরিবেশবান্ধব হওয়া, পরিবেশের প্রতি যত্নবান হওয়া, রোগ প্রতিরোধে সর্বদা সচেতন হওয়া মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।

৫. পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- করোনাভাইরাস মহামারী অভিজ্ঞতায় উৎপাদন ও ভোগের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার একটা সুযোগ এসেছে (লাউদাতো সি-১৯১)। প্রয়োজনে উৎপাদন ও ভোগ কমিয়ে দিতে হবে। সেই সাথে প্রাকৃতিক বিশ্ব গভীরভাবে অবলোকন ও চিন্তা করতে হবে। আমাদের চারিপাশের পরিবেশের সাথে আমাদের আবার সংযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানুষ সম্পর্কযুক্ত। করোনাভাইরাস এই রূপান্তরটা উপলব্ধি করার ও পদক্ষেপ গ্রহণের একটা সুযোগ দিয়েছে। তিনি আরো বলেছেন- এই অভিজ্ঞতাটা ভুলে থাকা ঠিক হবে না। শুধু ফাইলবন্দি করে রাখাও ঠিক হবে না, আমরা যে দূষণে ছিলাম সেখানে যেন ফিরে না যাই। প্রকৃতি ব্যবহার ও অপব্যবহারের বিষয়টি গভীর ধ্যানে মনোনিবেশ করে সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করি। আমরা প্রকৃতির প্রতি গভীর মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি, আমাদের এখনই এটি ফিরে পেতে করোনাভাইরাস দুর্যোগ সময়টি সুযোগ দিয়েছে।

৬. করোনাভাইরাস মহামারী পরিবেশে রূপান্তর হওয়ার একটা সুযোগ রয়েছে। ইংল্যান্ডের বিশপ জন আরনল্ড বলেছেন-  করোনা দুর্যোগের পর আমরা আগের 'স্বাভাবিক' অবস্থায় আর ফিরে যেতে নাও পারি তবে আমরা যেখানে ফিরে যাব সেটা ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থা বলা যায়। অর্থাৎ আমরা দুর্যোগের পর সব পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে পাব না, কারণ আর্থিকভাবে, ব্যবসায়িক দিক থেকে অনেক পরিবর্তন মোকাবেলা করতে হবে।  আমরা একটা 'নতুন স্বাভাবিক' পরিবেশে যাব, আমরা কীভাবে আামদের 'নতুন স্বাভাবিক' অবস্থাটা দেখতে চাই তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।  

৭. আমাদের ছোট ছোট উদ্যোগ, সামাজিক কর্মসূচি বিশ্বজুড়ে পরিবেশকে প্রভাবিত করতে পারে। আমাদের বসতবাড়ির প্রতি আমরা আরেকটু যত্নবান হতে পারি। প্রকৃতির সাথে আমরা কী ব্যবহার করেছি তার প্রতি সচেতন হয়ে উঠতে পারি। পরিবেশের ক্ষতিরোধ করার জন্য আমরা কী করতে পারি সে সম্পর্কে কিছুটা আত্মমূল্যায়নও করা যেতে পারে। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো হারিয়ে না ফেলে, আমাদের জীবন পরিবর্তন করতে পারি। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতির প্রতি যত্নবান হওয়ার দায়িত্বও আমাদের দিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস অনুশীলনের সাথে পরিবেশ সুরক্ষাও সম্পর্কযুক্ত। পরিবেশ অরক্ষিত থাকায় আমাদের আধ্যাত্মিক অনুশীলনেও স্থবিরতা এসেছে। আমাদের ছোট ছোট সেবাযত্ন প্রকৃতি সুরক্ষায় বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা প্রকৃতির মাঝে থাকব, সৃষ্টিকর্তা আমাদের মধ্যে আছেন। 

শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে সামাজিক অস্থিরতা এবং করণীয়


১. বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ‘লকডাউন’ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের দেশে রপ্তানি আয়ের প্রাধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভে নেমেছে (১৬ এপ্রিল, বিডিনিউজ২৪.কম)। বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা ঢাকার মালিবাগ, কমলাপুর, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে। এতে শ্রমিকদের ওপর সাধারণ জনগণ বিরক্ত প্রকাশ করছে, সরকারের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে  জনগণ বিরক্ত কারণ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিস্তার ঠেকানোর বৈজ্ঞানিক উপায় ‘লকডাউন’ অবস্থান, যার একটু ব্যত্যয় ঘটলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। জনগণ বিভ্রান্ত কারণ সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে ‘লকডাউন’ সকল জনগোষ্ঠীর জন্য বাধ্যতামূলক। আর শ্রমিকদের বেতন দিতে সরকার এ খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ।  কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমএ’র তথ্য অনুযায়ী তাদের সদস্যভুক্ত কারখানা রয়েছে ২,২৭৪টি, এরমধ্যে মার্চ মাাসের বেতন পরিশোধ করেছে ১,৬৬৫টি কারখানা। যা মোট করাখানার ৭৩ শতাংশ এবং ৮৭ শতাংশ শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করেছে (১৬ এপ্রিল)। এখনও ৬০৯টি কারখানার শ্রমিকরা মজুরি পায়নি। 

২. করোনাভাইরাস মহামারী বিস্তার ঠেকাতে মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে, ফলে নিজেরা শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। একদিকে মধ্যবিত্ত, বাস্তুহারা ও অভিবাসী শ্রমিকরা নিজেদের উৎপাদিত শ্রমের ফল থেকে নিজেরাই দিনদিন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে নিজের স্বার্থ, নিজের লোভ এবং নিজের মুনাফা মালিকদের সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্ট মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে শ্রেণি বিভাজন, তা ক্রমে ক্রমে মানুষকে অপর মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। ফলে শ্রমিক মনে নিঃসঙ্গতাবোধের কারণে নিজে বেঁচে থাকার তাগিদে করোনাভাইরাস দুর্গতি জেনেও রাস্তায় নেমেছে। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধেই দেশের সুরক্ষার সম্ভব, অন্যথায় শ্রমিকরা রাস্তায় থাকলে মাশুল দিতে হবে খুব শীঘ্রই। পোপ মহোদয় বলেছেন, করোনা দুর্যোগে উৎপাদন, ভোগ ও মুনাফা নিয়ে সঠিক সমন্বয় আবশ্যক। পোপ মহোদয় আরও বলেছেন-- করোনাভাইরাস মহামারী দরিদ্রদের 'দেখার' এবং উৎপাদন ও ভোগের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার একটা সুযোগ এসেছে। এই অভিজ্ঞতাটা ভুলে থাকা ঠিক হবে না।  

৩. নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বাড়ির মালিক এক নারী চিকিৎসককে ‘দুর্ব্যবহার’ করে ভাড়াবাড়িতে ঢুকতে বারণ করেছে। তিনদিন উপজেলা সদরে একটি অসরকারি ক্লিনিকে অবস্থান করে পুলিশ সহায়তায় নারী চিকিৎসক বাড়িতে উঠেছে (১৭ এপ্রিল, বিডিনিউজ২৪.কম)। ঢাকায় সবুজবাগে এক বাড়ির মালিক এক চিকিৎসককে ভাড়াবাড়ি ছাড়তে নোটিশ দিয়েছে, চিকিৎসক টাঙ্গাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত। মালিক টেলিফোনে একজন কর্মরত নার্সকে রাত ১০টার পর ভাড়াবাড়িতে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছে । কর্মস্থলের কর্তৃপক্ষ বাড়ির মালিকের সাথে যোগাযোগ করলে উল্টো নার্সের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। অবশ্য দুদক ইতিমধ্যে বাড়ির মালিকদের এমন সব আচরণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর বাড়ির মালিকরা দুর্ব্যবহার করছে, যখন তখন হেনস্থা করছে ।  যা আমরা ইন্টারনেট সংবাদ থেকে জানতে পারছি। 

৪. পৃথিবীর অনেক দেশ ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের করোনাভাইরাস দুর্যোগ মুহূর্তের অবদান বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছে, আমাদের মাননীয় প্রাধানমন্ত্রীও একই মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের সহযোগিতা পাচ্ছে, জাতির বীরসেনা সম্মানে খ্যাতি পাচ্ছে। এ দুর্গতি সময়ে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, “আমি এই মুহুর্তে আপনাদের সাথে স্মরণ করতে চাই  সেইসব নারীদের, যারা এই স্বাস্থ্য সংকটকালে অন্যদের দেখাশোনা করছেন, নারী ডাক্তার, নার্স, প্রশাসনিক কর্মী,  জেলখানার প্রহরী, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানকর্মী এবং মা-বোনেরা যারা পরিবারে সন্তান, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের সাথে নিজেরাও বন্দি হয়ে আছেন।”  পোপ আশংকা  প্রকাশ করে আরো বলেছেন- এই গৃহবন্দি সময়ে নারীরা গৃহসন্ত্রাসের শিকার হতে পারে। পোপ ফ্রান্সিস আরো বলেছেন, “নারীরা যে সব সংকট মোকাবেলা ক’রে এমন অবস্থায় বসবাস করছেন, তা তাদের জন্য অত্যন্ত ভারী দায়িত্ব, ফলে তাদের উপর সন্ত্রাসের একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।” পোপ মহোদয় তাদের সেবাকাজে অভিভূত হয়ে বলেছেন- ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মিশনারি ও পুলিশসহ সকল সেবাকর্মীরা দুর্যোগ সময়ের বীরসেনা ও সাধুসম সেবাকর্মীদল।

৫. ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিদিন প্রত্যেক থানায় ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ি থানা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক খাবার দেয়ার পরও বাইরে ছিল বহু মানুষের ভিড়। সংবাদ থেকে জানা গেছে ছোট, বড়, বৃদ্ধ সবাই লাইনে দাঁড়ানো, কিন্তু ছিল না কারও কোন করোনাভাইরাস সচেতনতা (সূত্র: একই)। একই দিনে জেনিছি ভারতের কেরালারাজ্যে অভিবাসী শ্রমিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় সরকার, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি এবং সরকারের দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির সমন্বিত সহায়তায় রাজ্যজুড়ে ১,২০০এর বেশি কমিউনিটি কিচেন কার্যক্রম শুরু হয়েছে । যেখানে প্রতিদিন আড়াই লাখ মানুষকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করছে। কিচেন থেকে ৯০ শতাংশের বেশি খাবার বিনামূল্যে দিচ্ছে, বাকী ১০ শতাংশ খাবার মাত্র ২৫ রুপিতে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। সেখানে প্রতি ১৫দিন পরপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি প্যাকেট ৮৭ লাখ পরিবারকে পৌঁছে দিয়েছে। যার মধ্যে বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় ১৭ রকমের পণ্যসামগ্রী রয়েছে। যার ফলে জনগণ ত্রাণ নিতে ঘরের বাইরে আসছে না, তারা ঘরেই থাকছে, না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। সমাজের  সুরক্ষা নিশ্চিত থাকছে শতভাগ। পোপ মহোদয় বলেছেন, দুর্যোগ সময়ে সেবাকাজে থাকতে হবে সেবাকর্মীর গভীর দরদবোধসহ মনোযোগ ও সৃজনশীল কর্মকৌশল । 

৬.  প্রতিদিন বিকালে কলেজের প্রধান ফটকে এসে দেখি ১০/১৫জনের পথশিশু দলটি রাস্তায় ছুটাছুটি করছে। টহলরত পুলিশের তাড়া পেলে বিচ্ছিন্নভাবে লুকিয়ে থাকে নিজ নিজ কৌশলে, আবার সেনাবাহিনীর গাড়ি এলে ওদের ফুটপাতে সামাজিক দূরত্বে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে রেখে যায়। কিছুক্ষণ পরে এরা নিজেদের মতই ছুটাছুটি করে, কখনও কখনও হৈচৈ করে ক্রিকেট খেলে সময় অতিবাহিত করে। ভারতের কেরালারাজ্যে সরকার বিশেষ গুরুত্ত্ব দিয়ে অতি দরিদ্র এবং গৃহহীনদের এই দুর্যোগ সময়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। শুধু তা নয় তাদের বিনামূল্যে খবারের ব্যবস্থাও করেছে। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আড়াই মাসে ৬৫ হাজারের বেশি অতি দরিদ্র ও ছিনমূল মানুষকে সহায়তা দিয়েছে রাজ্য সরকার। একাজে স্থানীয় সরকার ও গ্রাম পঞ্চায়েতের সাহায্য নিয়েছে। এ দুর্যোগ মোকাবেলায় রাজ্যসরকার সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষদের নিয়ে ৪ লাখ স্বেচ্ছাসেবক গঠন করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যকর্মী ও সমাজকর্মীরা একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লকডাউন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, সঙ্গনিঃরোধ, চিকিৎসা, সৎকার, জীবন রক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে। বিশ্বর মানুষ করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকানোর ( আড়াই মাসে আক্রান্ত রোগী মাত্র ৩৯৪ জন, সুস্থ হয়েছে ২৪৫ জন আর মারা গেছে ৩ জন)  তাদের কর্মকৌশলকে দেখছে ‘কেরালা মডেল’ হিসেবে। তারাতো মাণ্ডলিক ক্ষুদ্র সমাজের সমদায়িত্ববোধ প্রেরণায় ‘দেখা, বিশ্লেষণ করা ও কাজ করা’ এ কর্মনীতিই অনুসরণ করেছে। এটি এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে যা সঙ্গতিপূর্ণ, বাস্তবধর্মী ও দায়িত্বশীল। কেরালার প্রায় তিনকোটি জনগণ মধ্যে  ১৮% শতাংশ জনগণ খ্রিস্টবিশ্বাসী, অভিবাসীরা কেরালাকে ‘ঈশ্বরের আপন নগরী’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। 

৭. অন্যদেরটা দেখে ও শুনে স্থানীয়ভাবে একসাথে সমন্বিত পদ্ধতিতে কাজ করার সময়টা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সেটা হতে পারে নিজের এলাকা, পাড়া, গ্রাম, উপজেলা, জেলা বা অঞ্চল হিসেবে। তবুও সামাজিক অস্থিরতা বন্ধ করতে হবে, সেটা যত ছোট পরিসরেই থাকুক না কেন। অন্যথায় করোনাভাইরাস বিপর্যয় দীর্ঘায়িত হওয়ার ভয় থেকে যায়।

বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে সংকট ও সম্ভাবনা


১. অবরুদ্ধ সময়ে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস ছোবলের বিপর্যয় থেকে সুরক্ষার জন্য পুরো বিশ্ব লড়ছে। যারা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত তারা ভীত সন্ত্রস্ত, যারা আপনজনদের হারিয়েছে তারা কাঁদছে আর পুরো বিশ্বের মানুষ ভীষণভাবে আতঙ্কিত। অতি অল্প সময়ে অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে, আমরা নিজ এলাকায় ঘরবন্দি হয়েছি। মানুষের সব জ্ঞান, সব বিজ্ঞান, যত থিওরি, যত উপদেশ, যত পরামর্শ শত্রুটিকে পরাস্ত করতে ব্যস্ত। এ যেন ধ্বংস ও মৃত্যু মুখোমুখি মানুষ জীবন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিজয় লাভের প্রাণপন চেষ্টা করছে। সকলের অন্তরে এমন গভীর এক ঐক্যমত, যা আমাদের জন্য প্রাণবন্ত এক আশার আলো।

২.  আমরা দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের বিজয় হবেই। একবার ভেবে দেখি- ভাইরাসটি যদি বাতাস বাহিত সংক্রমণ হয়ে মানুষকে আক্রান্ত করতো অথবা পানি বাহিত হয়ে মানুষের দেহে প্রবেশ করত, তবে মানুষের আর রক্ষা ছিল না। আমরা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতাম। তাই আমাদের অবস্থা একেবারেই বিপদাপন্ন নয়, সুরক্ষিত থাকার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।

৩. এই অদৃশ্য শত্রুকে পরাস্ত করার অস্ত্র ব্যয়বহুল হতে পারত। কিন্তু সাধারণ  কম খরচের সাবানেই বিশ্বব্যাপক সংক্রমক ভাইরাসটি পরাস্ত। আমরা জানতে পেরেছি কাপড় পরিষ্কারের ‌বাজারে 'পচা' ব্র্যান্ডের মত সাবান আরো কার্যকর। আমরা অতি কম খরচে মাস্ক ব্যবহার করেও সুরক্ষায় থাকতে পারি। সামাজিক দূরত্ব বজায়ে রেখেও অন্যকে সুরক্ষা দিতে পারি। ভাইরাসটি শিখিয়ে যাচ্ছে- দুর্যোগ সময়ে ধনী-গরীব সকল মানুষের বেঁচে থাকাটাই একটা অধিকার।

৪. আমরা জেনেছি ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে ও বংশবৃদ্ধি করতে মানুষকেই বেছে নেয়। যদি ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া অনুসরণে মশা, মাছি, পোকামাকড় আর কীটপতঙ্গকে বাহক হিসেবে বেছে  নিত তবে বাঁচার লড়াইটা আরো কষ্টকর হত। যদি ভাইরাসটি এইচআইভি ভাইরাসের মতো দীর্ঘ জীবনকাল ধরে রাখত তবে বহুসংখ্যক মানুষ বেঁচে থাকত ভাইরাস বহন করে। আমরা জেনে গেছি মাত্র ঘরবন্দি জীবন যাপন করে নিজেকে সুরক্ষা দিতে পারি। সময় অতিক্রমণে আক্রান্তরা আবার আপনজনদের স্বাভাবিক সান্নিধ্যে যেতে পারবে, জীবন আগের মতই হবে। তাই সংক্ষিপ্ত  ঘরবন্দি সময়ের বিচ্ছিন্নতা তো মিলনের তাগিদেই।

৫. অবরুদ্ধ সময়ে বৃদ্ধ, অতিদরিদ্র, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন, বিপদাপন্ন মানুষ আমাদর সমাজে আছে। আবার উদ্বাস্তু শ্রমিক, বাস্তুহারা, দৈনিক হাজিরা শ্রমিক তাদের হাজিরা দিনে খাবার নিশ্চিত, গরহাজিরা দিনে উপোস নিশ্চিত । তাছাড়া গরীবদের বিরাট অংশ আমরা চোখে দেখি না; তারা লুকানো গরীব মানুষ। এদের সকলেরই কার্যকর আরেকটা অদৃশ্য ভয় ‘খিদে’ সারাক্ষণ তাড়া করে। ঘরবন্দি, লকডাউন, অবরুদ্ধ, অন্তরীণ, সামাজিক দূরত্ব  তাদের জন্য বেদনার সময় এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী তাদের সাধ্যের বাইরের বিষয়। শুধু সরকারের ত্রাণ তাদের ভরসা, তাও তাদের পর্যন্ত অনেক সময় অপর্যাপ্ত ও অসময়ে পৌঁচ্ছে । তাই অসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানসহ অনেক ব্যক্তিগত ও ক্ষুদ্রদল এসব অভুক্ত মানুষদের কাছে যাচ্ছে। তাদের হাতে খাবার পৌঁচ্ছে দিচ্ছে, সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করছে। বস্তি, গণবাহন, স্টেশন ও রাস্তাঘাট জীবণুনাশক স্প্রে দিয়ে সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। এই দুর্যোগ সময়ে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা প্রকাশের এমন নিত্যনতুন দয়ার কাজ আমরা দেখছি। এটাই তো একটা মানবিক সমাজের নিদর্শন, দয়ার কাজে বিশ্বাসের প্রকাশ । 

৬. বিগত দিনে জাতি, ধর্ম, প্রাচীর রক্ষা এমনকি শান্তি রক্ষার নামে যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে। ভাইরাসটি সকল যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়েছে, অস্ত্রের শব্দ বন্ধ হয়ে পুরো বিশ্ব স্থবির হয়ে গেছে। নেতারা শিখেছে অস্ত্র দিয়ে মানুষ মারা যায়, ভাইরাস মারা যায় না। প্রাচীর দিয়ে মানুষের চলার পথ বন্ধ করা যায়, কিন্তু ভাইরাসটি প্রাচীর মানে না। কঠোর আইন করে সংখ্যালঘুদের দমিত করা যায়, কিন্তু ভাইরাসটি বিস্তার দমন করা যায় না। ভাইরাসটি শিখিয়েছে-  সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন এক বিশ্বমণ্ডল, এক অভিন্ন বসতবাটি। এটিকে রক্ষণাবেক্ষণ ও চাষবাস করে জীবনযাপন করতে তাঁর অনুগ্রহে আমরা দায়িত্ব পেয়েছি। ঘরবন্দি সময়ে এমন ভাবনা আমারদের মন সৃষ্টিকর্তার প্রতি  অফুরন্ত কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে।  

৭. অবরুদ্ধ সময়ে ইন্টারনেট সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি- স্ত্রীকে খুনের ঘটনা ফেসবুক লাইভস্ট্রিমিংয়ে এসে প্রচার করেছে। এমনসব নিষ্ঠুরতা, দুর্নীতি, চালচুরি, ডালচুরি, অন্যায় আমরা দেখছি; অন্যদিকে মনুষত্বের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ অসংখ্য ডাক্তার, নার্স, স্বেচ্ছাসেবক, ধর্মগুরু, মিশনারী এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষাবাহিনী মানবিক কাজে একাত্ম হয়েছে। একটু উপলব্ধি করি- এভাবে অসংখ্য অসহায় মানুষ সাড়া জীবন নিপীড়িত ও অত্যাচারিত; অন্যদিকে ভাইরাসটি আমাদের সকলের উপর সমানভাবে খুব অল্প সময় অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। নিপীড়িত মানুষের তুলনায় আমাদের কষ্ট ক্ষণিকের। মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার যুদ্ধটা আরো বেগবান করতে হবে, সেই চেতনা অন্তরে নিয়ে আমাদেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এটাই সাম্য, তখনই সমাজে আসবে শান্তি।

৮. ধর্ম পবিত্র, বিশ্বাস জীবন্ত, জীবন সুন্দর। সেই জীবন রক্ষার যুদ্ধে পুরো বিশ্বের মানুষ সক্রিয়। আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনিই আদি, তিনিই অন্ত। তিনিই সবের সূচনা, তিনিই সবের সমাপ্তি। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টির সেরা করেই সৃষ্টি করেছেন। তাই বেঁচে থাকাটা মানুষের একটা অধিকার। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার লড়ায়ে, তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। ঘরবন্দি সময়ে এটাই আমাদের আশা। 

রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে তিনি জীবন্ত- এটাই আমার আশা ও মনোবল

১. এ বছরের পুনরুত্থান পর্বটি শিষ্যদের অভিজ্ঞতার মতই। করোনাভাইরাসের ‘ধ্বংস ও মৃত্যুর আক্রমণ’ এবং আমাদের মনে অনিশ্চয়তা ও সংশয় বিদ্যমান। যিশুর মৃতদেহ সমাধি স্থানে রেখে কয়েকজন শিষ্য একই অভিজ্ঞতা করেছে। তবে কয়েকজন নারীদলটি  সক্রিয় ছিল,  যিশুর মৃত্যু তাদের হতাশায় পঙ্গু করে ফেলেনি। বরং তারা একটি সাধারণ কাজ অসাধারণভাবে করেছে। তারা যিশুর দেহ লেপনের জন্য সুগন্ধি-মশলা প্রস্তুত করেছে। নিস্তার জাগরণীর ধর্মোপদেশে পোপ ফান্সিস বলেছেন- “তারা তাদের ভালবাসার দুয়ার বন্ধ করেনি; তাদের অন্তরের অন্ধকারে দয়ার শিখা প্রজ্জলিত রেখেছে।” আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কি ভয়ে ভালবাসার দূয়ার বন্ধ রেখেছি? 

২. মা প্রার্থনারত সময় কাটিয়েছেন। তিনি আজ আমাদের সকলে ‍‌‍'মা' । পোপ মহোদয় বলেছেন- “যিশু মাটিতে শোয়ানো বীজ যিনি পৃথিবীকে নতুন জীবন দান করবেন এবং মা মারীয়া প্রার্থনা ও ভালবাসা দ্বারা এই আশাটি প্রস্ফুটিত হতে সহায়তা করেছেন।” প্রার্থনা আমাদের জন্য একটি অন্যতম আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন সময় দেখি ও অভিজ্ঞতা করছি। একটি অন্ধকার ও বিরক্তকর অভিজ্ঞতা যা আমাদের কাছে অভিশাপের মত হতে পার। ঐ মুহূর্তে প্রার্থনা আমাদের জীবনে গভীর অভ্যন্তরীণ রূপান্তর আনে, শান্তির সূচনা করে। এমন কী কিছু সময় পরে অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আর্শীবাদের অভিজ্ঞতা করতে পারি।  

৩. এই দিনেই ‘আশা’ পৃথিবীতে প্রবেশ করে। ব্যক্তি যিশুর সাথে নারীদলটির সাক্ষাৎ ঘটে। পোপ ফান্সিস বলেছেন- ‘ভয় করো না, ভয় পেও না’ -এই আশার বার্তাটি আজ আমাদের কাছেও এসেছে। একই বাক্য ঈশ্বর আমাদের জন্য দিয়েছেন। পোপ মহোদয় আরো বলেছেন- আশা করাটা আমাদের অধিকার। ভোরের আলোর সাথে সাথেই ‘আশা’ পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে।

৪. পুনরুত্থানেরই একটি ঐশদান- 'আশা'। সবকিছুর শেষে অশুভকে পরাজিত করে শুভ জয়ী হবে এমন আশাবাদ এটি নয়। বরং এটি ঈশ্বরের কাছ থেকে আগত অনুগ্রহদান ‘আশা’। এটি একটি ঐশদান যা আমরা নিজেরা অর্জন করিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বলে থাকি আগামী সপ্তাহ বা কয়েকদিনের মধ্যে করোনাভাইরাস তাণ্ডবলীলা সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিগত সপ্তাহগুলোতে আমরা অভিজ্ঞতা করেছি, সময় অতিবাহিত হয়েছে তথাপি আমাদের এমন আশাবাদ অর্থহীন প্রমাণিত। যিশুর প্রদত্ত আশা ভিন্ন সংবাদ দেয়। তিনি আমাদের অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস দিয়েছেন, ঈশ্বর সমস্ত কাজের সমাপ্তিতে ভালো কিছু সমাধান দিবেন। কারণ ‘কবর’ থেকেও তিনি ‘জীবন’ ফিরিয়ে এনেছেন। এই দুর্যোগের পরে পরিবেশ আরো ভাল হবে, তিনি আমাদের পরিচালনা করবেন।

৫. তিনি হৃদয়ের পাথরও সরিয়ে দিতে পারেন। একটি কবর থেকেই জীবন আবির্ভূত এটাই আমাদের আশা। যিনি এমন এক স্থান থেকে আবির্ভূত হয়েছেন, সেখান থেকে কেউ কখনও আবির্ভূত হয়নি- এটি কবর। যিনি সমাধির প্রবেশদ্বার বন্ধ করার পাথরটি সরিয়ে দিয়েছেন, এই দুর্যোগ সময়ে তিনি আমাদের ভারাক্লান্ত হৃদয়ের পাথরও সরিয়ে দিতে পারেন। তিনি আমাদের ত্যাগ করেননি, তিনি আমাদের সাথে আবার সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি আমাদের বেদনা, যন্ত্রণা এবং মৃত্যুর মধ্যে প্রবেশ করেছেন। তাঁর আলো সমাধির অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আজ তিনি চান সেই আলো আামদের জীবনের অন্ধকারময় স্থানেও প্রবেশ করুক। 

৬. দুর্গতিতে ‘মনোবল’ পুনরুত্থানের একটি অনুগ্রহদান। আমাদের হৃদয়ে রাখা পাথরটি সরিয়ে দিয়েই আমরা যিশুর মনোবল গ্রহণ করতে পারি। পুনরুত্থিত খ্রিস্ট আমাদের মনের গভীরের ভয়টি অনুভব করতে পারেন। পোপ মহোদয় বলেছেন- খ্রিস্ট আমাদের সাহস দিচ্ছেন, তিনি আমাদের জীবন এবং আমাদের মৃত্যুতেও আমাদের সামনেই চলছেন। তিনি আমাদের আগে গালিলেয়া যাচ্ছেন, সেখানে তাঁর ও শিষ্যদের প্রতিদিনের জীবন, পরিবার ও কাজের স্মৃতি স্মরণ করে দেন। তিনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কাজ-কর্মে আশা নিয়ে আসতে চান। শিষ্যদের জন্য গালিলেয়া স্মৃতিময় স্থান কারণ এখানেই তাদের প্রথম আহ্বান করেছেন। গালিলেয়া ফিরে আসার অর্থ তিনি আমাদের প্রথম ভালবেসেছেন ও আহ্বান করেছেন। 

৭.  তিনি আমাদের আজ প্রেরণ করছেন। পোপ মহোদয় বলেছেন- তিনি আমাদের শুধু পবিত্র স্থান গালিলেয়া নয় বরং পৃথিবীর সর্বত্র প্রেরণ করছেন ।  আমরা যেখানে বসবাস করি সেখানেই তিনি আমাদের প্রেরণ করছেন। তিনি চান তাঁর প্রতি বিশ্বাসী যারা সকলের নিকট আমরা ‘জীবনের গান’  পৌঁছে দেই। আমরা যারা জীবন বাণী অভিজ্ঞাতা করেছি তারা যদি জীবনের কথা না বলি তবে কে বলবে? খ্রিস্ট জীবন্ত। জয় মৃত্যুঞ্জয়, জয় তোমারই জয়।

শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে নিজের এলাকা ‘লকডাউন’- নিজের করণীয়


১. করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে অনেকে স্বেচ্ছায় নিজের এলাকা ‘লকডাউন’ করেছে। যা সামাজিক মাধ্যম দ্বারা সহজেই প্রকাশিত হচ্ছে। গ্রামের একটি এলাকার  দুইদিকে প্রবেশ পথ প্রচলিত প্রথায় বাঁশ বা গাছের ডালা দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। এলাকার সকলের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে ‘লকডাউন’ করে ‘সামাজিক সুরক্ষা’ নিশ্চিত করা হয়েছে। এটা স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে সাথে সমন্বিত পরিবেশ- মানবিক, প্রাত্যহিক জীবনের পরিবেশ, প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়। কারণ সবকিছুই যেহেতু পরস্পরের সাথে গভীর যোগসূত্র রয়েছে।

২. লকডাউন আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া নয় বরং এটাই সংক্রমণ কমানোর বৈজ্ঞানিক লড়াই। এতে আগত এবং নিজের লোকদের সমন্বিত স্বাস্থ্য সচেতনার পরিবেশ নিশ্চিত হয়। আগতরা সাবান, পানি ও জীবাণুনাশক স্প্রে দিয়ে সমাজে বসবাসরত সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। বাজারে যাওয়ার মুহূর্তে একই নিয়ম অনুসরণ করবে। যারা ভিতরে আছে তারাও একই ভাবে সুরক্ষিত থাকবে। 

৩. এ দুর্যোগ মুহূর্তে অসুস্থদের দ্রুত ডাক্তারের নিকট নিতে হতে পারে এবং  খাদ্য, জল ও ঔষধের জন্য বাইরে যেতে হবে। এছাড়া সরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের যখন তখন সামাজিক সুরক্ষা দায়িত্ব পালনের জন্য যাতায়াত করতে হয়। এই বিষয়সহ অন্যান্য প্রাত্যহিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ ভাবতে হবে। এটা স্থায়ী পদ্ধতি নয় বরং জরুরী অবস্থা বা আপদকালীন ঝুঁকি মোকাবেলা করার বিষয় অগ্রিম ভাবতে হবে। এটি সাধারণত জনসচেতনতামূলক একটি উদ্যোগ।

৪. নিজের এলাকার জনগণ চলমান বিষয় নিয়ে আলাপ করে মিথ্যা গুজব বা আতঙ্ক ছড়ানো থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। প্রয়োজনে এলাকার নেতা-নেত্রীবৃন্দ সরকারি নির্দেশনামূলক তথ্য ঘরে ঘরে পৌচ্ছে দেয়া নিশ্চিত করতে পারে।

৫.  এলাকায় সকলকে মাস্ক পড়ে থাকার জন্য সচেতন করা দরকার। প্রতিদিন স্নান করার আগে নিজের ঘরবাড়ি ও চারিপাশের পরিবেশ ব্লিচিং স্প্রে করে পরিষ্কার রাখার অভ্যাস সৃষ্টি করা যায়। নিজের বাড়ির পাশের চলাচলের পথটি সকলের সুরক্ষা চিন্তা করে একইভাবে পরিষ্কার নিশ্চিত করতে পারলে অনেকে উপকৃত হবে। নিজ এলাকার গৃহিনী বা সেলাই মেশিন ব্যবহারে দক্ষ ব্যক্তিরা নিজের উদ্যোগে গরীবদের জন্য মাস্ক বানিয়ে বিতরণ করতে পারে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময় এটা একটা বিশেষ দয়ার কাজ হতে পারে।

৬. নিজের এলাকায় হয়তো অনেক লুক্কায়িত গরীব মানুষ আছে। সৃষ্টিকর্তা যাদের যথেষ্ট দিয়েছে তারা অভাবী পরিবারের সাথে সহভাগিতা করতে পারে। অনেকে পরিস্থিতির কারণে অভাবী, তারা প্রকাশ করতে লজ্জা পায় তাদের খুঁজে বের করা একটা দয়ায় কাজ হতে পারে। এসময়ে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এবং সকলের জন্য ভাবতে পারলেই সমাজিক সুরক্ষা পুরোপুরি হবে। 

৭. যারা এখনও সচেতন না তাদের নিরন্তর সচেতনতা দান করা দরকার। সাধু পল বলেছেন- ভাল কাজে ক্লান্তি নেই।  যারা সুরক্ষা সামগ্রী কিনতে পারে না তাদের জন্য সরবরাহ করা যেতে পারে। নিজ এলাকায় বৃদ্ধ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, সুবিধাবঞ্চিত ও বিপদাপন্নদের পাশে থাকা ও নিয়মিত খোঁজখবর রাখাও দয়ার কাজ। এটা নিজের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের কথা ভেবেই করতে হবে। 

৮. সকলে যেন ঘরে বসে প্রার্থনা করতে পারে সে বিষয়ে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। ইন্টারনেট ব্যবহারে অক্ষম বা ব্যবস্থায় অপারগ এমন পরিবারকে সহযোগিতা করা যায়। তারাও যেন আধ্যাত্মিক একাত্মতায় থাকতে পারে। যাদের ধর্মীয় বই যথেষ্ট নাই বা দৈনিক বাইবেল পাঠ খোঁজতে অপারগ তাদের জন্য ফেইসবুক মেসেঞ্জারে সহভাগিতা করা যেতে পারে।

৯. পোপ ফান্সিস এর সর্বজনীন প্রেরণ পত্র “লাউদাতো সি” প্রকাশের পাঁচ বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। পোপ মহোদয় মে মাসের ১৬ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত ‘লাউদাতো সি সপ্তাহ’ ঘোষণা দিয়েছেন । পরিবেশের অনেক ক্ষতি আমরা করে ফেলেছি, এখনও করে যাচ্ছি। আমরা যদি ঘরে থেকেই নিজের ঘর ও প্রাত্যহিক জীবনের পরিবেশ সুরক্ষা করি তবে আমাদের অভিন্ন বসতবাটি এ ধরিত্রির যত্মই করছি। 

১০. খাবার সময় অথবা অবসর সময়ে পরিবারে একসাথে পবিবেশ সুরক্ষা বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে পারি। আমরা অবাক হয়ে যাব ছোটরা কত সুন্দর সুন্দর নতুন নতুন প্রস্তাব দিয়ে ফেলছে। শুধু মাত্র বিষয়টি তাদের মননে প্রবেশ করার দায়িত্ব বড়দের। আমরা ঘরে থেকেই পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়সমূহ চিহ্নিত করে নিজেদের প্রতি আরো যত্নবান হয়ে উঠতে পারি। আমাদের পানি অপচয় রোধ, প্লাস্টিক ব্যবহার হ্রাস ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় ফেলা, পরিত্যাক্ত স্থান পরিচ্ছন্ন রাখা, নিজের খাবার তালিকা স্বাস্থ্যসম্মত বিষয় গুরুত্ব প্রদান, শাক-সবজ্জি উৎপাদন, গাছ রোপন, মুরগী, কবুতর, গরু-ছাগল প্রতিপালন, খাল ও ডোবার যত্ন করা, পুরাতন কাপড় দিয়ে বাজার ব্যাগ তৈরি করার মাধ্যমে আমরা পরিবেশের যত্ন নিতে পারি। এসব বিষয়ে আমরা চাইলেই করতে পারি, আমাদের শুধু মন থেকে চাইতে হবে। এভাবেই আমরা পোপ মহোদয়ের সাথে পরিবেশ সুরক্ষা ও আমাদের বসতবাটির যত্নের আহ্বানে সাড়া প্রদান করতে থাকব।

১১. তবুও আমরা যেন বাইরে না যাই, ঘরেই থাকি। লকডাউন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার নির্দেশনা মেনেই যেন সব উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও মহা ব্যস্ততা থেকে বাধ্য হয়ে ‘লকডাউন’ আছি যেখানে আমরা ‘বিশ্বটা অবরুদ্ধ’ বা ‘পৃথিবীটা মনেস্টারি’ ভাবছি। এমনও হতে পারে অবশেষে সৃষ্টিকর্তা বিশ্বের এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হুমকি স্বরূপ ঘাতক ভাইরাসটি দুনিয়া থেকে নির্মুল করবেন। আমাদের বিশ্ব, আমাদের সমাজ, আমাদের এলাকা হয়ে উঠবে পুনর্নবীকরণ, ব্যাপক রূপান্তরিত যা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। 

(ছবি: ইন্টারনেট সংগৃহীত)

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে তারাও পাবে তাঁর দয়া


১. পুণ্য শুক্রবারে পোপ ফান্সিস কারাবন্দিদের সাথে আধ্যাত্মিক একাত্মতায় ক্রুশের পথ ধ্যান করেছেন। পোপ মহোদয় যিশুর ক্রুশের পথের অনুধ্যান লেখার জন্য  আঠারোজনকে আমন্ত্রণ করেছেন। তারা নিজের জীবন অভিজ্ঞতা অনুধ্যান করেছে। আমন্ত্রিতদের মধ্যে পাঁচজন বন্দি, একটি পরিবার যারা হত্যার শিকার হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত একজন বন্দির কন্যা, কারাগারের একজন শিক্ষক, একজন সিভিল ম্যাজিস্ট্রেট, একজন বন্দির মা, একজন কারা ধর্মশিক্ষক, একজন স্বেচ্ছাসেবক, একজন কারারক্ষী এবং একজন যাজক যিনি অভিযুক্ত ছিলেন কিন্তু আট বছর পর মুক্তি পেয়েছেন। কারা অন্ধকারে থেকেও ভাল চোরের মত একটা অভিজ্ঞতার ফলে একটি মুহূর্তে জীবন আলোতে উদ্ভাসিত হতে পারে। যারা বিশ্বাস করে তাদের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব, এমনকি কারা অন্তরীণে অন্ধকারেও একটি আশার বাণী শোনতে পায়  “কারণ পরমেশ্বরের অসাধ্য কিছুই নেই” (লুক ১:৩৭)।আসুন তাদের খ্রিস্ট যিশুর অভিজ্ঞতা শুনি। 

২. যাবজ্জীবন কারদণ্ড প্রাপ্ত একজন বন্দি ২৯ বছর যাবৎ কারা অন্তরীণে। তার অনুধ্যান- ‘ওকে ক্রুশে দাও, ক্রুশে দাও’ এ চিৎকার যখন আমাকে আদালত-কক্ষে আনা হয়েছে তখন শুনেছি, আবার খবরের কাগজে ও টেলিভিশন সংবাদে একই শ্লোগান আমি শুনতে পেয়েছি। আমি দোষী আর যিশু নির্দোষী ছিলেন। বাবার সাথে আমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আছি। কিন্তু শৈশবে বাসে, শ্রেণিকক্ষে ধণীর ছেলেরা আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে কারণ আমি গরীব।  আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।তাদের দণ্ড হয় না। স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যা ছিল তাই প্রচুর অবজ্ঞা পেতে হয়েছে। তাই শৈশব থেকেই আমি ক্রুশবিদ্ধ। যিশুর যাতনাভোগের কাহিনী পড়ে ২৯ বছর পরেও আমি চোখের জল ফেলে কাঁদতে পারি। আমার সৌভাগ্য- আমার চোখের জল শেষ হয়ে যায়নি, লজ্জাবোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলিনি। যিশুর ক্রুশ যাতনাভোগ কাহিনী পড়ে আমি কখনও নিজেকে বারাব্বাস, কখনও পিতর এবং কখনও যুদাস অনুভব করে থাকি।

৩. একটি পরিবারের মা যাদের মেয়ে নির্দয়ভাবে হত্যার শিকার হয়েছে। সে অনুধ্যান করেছে- অন্যমেয়েটি কোনোভাবে প্রাণ রক্ষা পেয়েছে কিন্তু মিষ্টি হাসি বিনষ্ট করে দিয়েছে। খুনী এখন কারাগারে বন্দি। সময় চলে যায় কিন্তু ক্রুশের ভার কমে না। কন্যাকে ভুলতে পারি না, সে আমার সাথে থাকতে পারত কিন্তু এখন নেই। আমরা এখন বৃদ্ধ, বাড়িতে দিন দিন বিপদাপন্ন সময় আসছে। তবে হতাশাগ্রস্থ সময়ে যিশু বিভিন্ন উপায়ে আমাদের কাছে এসেছেন।স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে আরো ভালবাসতে, আরো সমর্থন করতে অনুগ্রহ পেয়েছি।যিশু আমাদের বাড়ির দরজা দরিদ্র ও হতাশাগ্রস্থদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে আহ্বান করেন। আমরা সাড়া প্রদান করি, আবার মানবকল্যাণ কাজ করতে শুরু করি। আমরা মন্দের কাছে আত্ম-সমর্পণ করতে চাই না। ঈশ্বরের ভালবাসায় সত্যই জীবন পুনর্নবীকরণ সম্ভব। তাঁর পুত্র যিশু মানুষের দুঃখ লাঘব করতে যন্ত্রণা সহ্য করেছেন।

৪. একজন বন্দি যিশুর মাটিতে পতন অনুধ্যান করেছে- আমার প্রথম পতনটি ছিল আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলাম যে পৃথিবীতে ভাল বলতে কিছু আছে।দ্বিতীয়টি আমি বুঝিনি খুনের একটি পরিণতি আছে কারণ আমি ইতিমধ্যে বিবেকের ভিতরে মারা গিয়েছি। আমি বুঝতে পারিনি ধীরে ধীরে  আমার ভিতরেও মন্দতা বাড়ছে। অন্ধকার আমার জীবনে ছড়িয়ে পরছে এবং তা বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে। ক্রোধ আমার দয়াশীলতা মেরে ফেলে, আমি বড় মন্দ কাজ করে ফেলি।কারাগারের অন্যের খারাপ আচরণ আমাকে আত্ম-বিশ্লেষণ করতে শেখায়- আমার পরিবারকে আমি নষ্ট করে দিয়েছি।আমার কারণে তারা সুনাম ও সম্মান হারিয়েছে। খুনির পরিবারে চিহ্নিত হয়েছে।এখন আমার শাস্তিটি শেষ পর্যন্ত ভোগ করতে চাই। কারণ কারাগারে আমি এমন লোকদের খুঁজে পেয়েছি যারা আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। 

৫. অন্য একজন বন্দি অনুধ্যান- আমার প্রথমবার পতন হয়েছে যেদিন মন্দ আমাকে আকৃষ্ট করেছে, মাদকদ্রব্যগুলো বাবার প্রতিদিন ১০ ঘন্টা পরিশ্রমের চেয়ে বেশী মূল্যবান ছিল।দ্বিতীয় পতন ছিল- যখন পরিবারকে ধ্বংস করেছি। মায়ের চোখে তাকিয়ে দেখেছি মা সবার লজ্জা নিজে গ্রহণ করেছে।বাবা মুখে তাকিয়ে দেখেছি বাবা গোপনে ঘরে একা বসে কেঁদে কেঁদে সময় পার করছে। 

৬. একজন বন্দির মায়ের অনুধ্যান- আমার ছেলের পাপের জন্য আমি নিজে দোষী। আমি আমার নিজের দায়বন্ধতার জন্যও ক্ষমা চাচ্ছি। আমি প্রার্থনা করি আমার সন্তান অপরাধের মূল্য পরিশোধ  করে আমার কাছে নবজীবনে ফিরে আসবে। আমি অবিরাম প্রার্থনা করি- একদিন আমার সন্তান অন্য রকম মানুষ হয়ে উঠবে, নিজেকে এবং অন্যদের ভালবাসতে শিখবে। মা মারীয়ার মতো আমি নিজেই কালভেরির পথে অভিজ্ঞতা করেছি, সন্তান যখন প্রেপ্তার হয় সেদিন আমাদের পরিবারের পুরো জীবনটা বদলে গেছে। তার সাথে আমরাও কারাগারে আছি। মানুষের মন্তব্য একটি ধারালো ছুরির মতো হৃদয়কে বিদীর্ণ করে, হৃদয়ে সবকষ্ট সহ্য করছি কিন্তু তাকে কখনও ত্যাগ করিনি।

৭. একজন বন্দির অনুধ্যান- আমি যেদিন কারাগারে প্রবেশ করেছি আর সেদিন কারাগার আমার বাড়িতে প্রবেশ করেছে। আমি আমার শহরে সমাজের জঘন্য ব্যক্তি হয়েছি। সকলে আমাকে খুনি হিসেবে ডাকে, কি দুর্ভাগ্য আমার নামটিও হারিয়েছি। আমি কারাগারে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, আমি স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যস্থতায় আবার বাচঁতে শিখেছি। আমার বন্দি সঙ্গিরা আমার ক্রুশ বহন করে সাইরিনির সিমোনের মত সাহায্য করেছে। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমি অন্যকে বিশ্বাস করতে সক্ষম হব। কাউকে না কাউকে সুখী করে সাইরিনির সিমোন হয়ে উঠব।  

৮. একজন বন্দির কিশোরী কন্যার অনুধ্যান- আমি একজন বন্দির মেয়ে, আমি বাবার ভালবাসার অভাব অনুভব করি। আমার মা হতাশার শিকার কারণ অনেক বছরপূর্বে বাবা কারাবন্দি, সংসার ভেঙে পড়েছে, খুব বেশি আর্থিক সংকট। আমি অল্প বেতনের কাজ শুরু করি, পরিস্থিতি প্রাপ্তবয়স্কের অভিনয় করতে বাধ্য করেছে। বাবার পরিণতির জন্য বাড়িতে সমস্ত কিছু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে আছে।যাদের বাবা যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ হয়েছে কেবল তারাই বুঝে। যতদূরের কারাগারেই স্থানান্তর করা হোক সেখানেই গিয়ে বাবার সাক্ষাৎ করি। তা যদি কয়েকশ কিলোমিটার দূরেও হয়। আমি এখন বলি-‘এটাই জীবন’ শুধু বাবার ভালবাসার কারণে আমি তার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। এই আশা করাটা আমার অধিকার।

৯. অন্য একজন বন্দির অনুধ্যান- আমি কারাগার থেকেই ঠাকুরদাদা হয়েছি। আমার মেয়ের বিয়ে, গর্ভাবস্থা কিছুই দেখেনি। একদিন নাতনীকে আমার জীবনের গল্প শোনাব। আমার মন্দ কাজের গল্প নয়, হতাশার গল্প নয়, দুর্ভোগের গল্প নয়। তবে আমার বিশ্বাসের গল্প। আমি যখন বিশ্বের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলাম, একাকী মনে করেছি, ভেবেছি জীবনে অর্থ নেই, প্রায় যিশুর মত বারে বারে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম। নাতনীকে বলব- এমন সময় তোমার জন্ম সংবাদ আমাকে ঈশ্বরের নিকট ফিরে আসতে সাহায্য করেছে। আমি বুঝতে আরম্ভ করেছি ঈশ্বর আমাকে এখনও কত ভালবাসেন। জীবনটা কত সুন্দর, তিনি কত সুন্দর উপহার আমাকে দিয়েছে। আমি ঈশ্বরের দান নাতনীকে সত্যিই কোলে জড়িয়ে নিব একদিন, এমন আশা আমি করতেই পারি। তুমি আমার দেবদূত।

১০. আট বছর বন্দি অবস্থায় থাকা একজন যাজক অনুধ্যান করেছেন- যত লজ্জাই আসুক না কেন, এক মুহূর্তের জন্য আমি সব শেষ হয়ে যেতে দেইনি। আমি স্থির করেছি আমি সর্বদা যাজক থাকব। আইনের মাধ্যমে আমি আমার ক্রুশ কমাতে পারতাম কিন্তু আমি চেয়েছি সবটুকু ক্রুশ বহন করতে।আমি নিয়মিত বিচারকের কাজে সহযোগিতা করেছি। আমি যাজক হিসেবে কয়েক বছর ধরে যাদের  সেমিনারীতে পাঠিয়েছি তারা ও পরিবার আমার পাশে থেকে ক্রুশ বহন করতে সাহায্য করেছে। তারা নিয়মিত প্রার্থনা করেছ্, আমার চোখের অনেক অশ্রু মুছে দিয়েছে। আমি যেদিন পুরোপুরি মুক্তি পাই, আমি নিজেকে দশ বছর আগের চেয়ে বেশি সুখী মানুষ মনে করেছি। আমি আমার জীবনে প্রথম ঈশ্বরের কাজের অভিজ্ঞতা করেছি। ক্রুশে ঝুলন্ত অবস্থায় আমি যাজকত্বের অর্থ আবিষ্কার করেছি।

(ছবি: ভাটিকাননিউজ)

বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে অনেক গরিবরা লুক্কায়িত


১. করোনাভাইরাসে পৃথিবী আক্রান্তের আজ ১০০ দিন। আমাদের অবরুদ্ধ বা লকডাউন আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া নয় বরং আমরা শিখেছি- এটাই সংক্রমণ কমানোর বৈজ্ঞানিক লড়াই। ভাইরাসটির সংক্রমণের শিকার হয়েছে ১৪ লাখের বেশি মানুষ, প্রাণ গেছে ৯০ হাজারের বেশি মানুষের। সংখ্যাগুলো বাড়ছে প্রতি মিনিটে। পাল্টে গেছে পৃথিবীর চেহারা- অচল করে দিয়েছে যোগাযোগ, অর্ধেক মানুষকে বন্দি করে ফেলেছে ঘরের মধ্যে। থামিয়ে দিয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। বাড়ছে গরীব মানুষের দুর্গতির দিন। এমন দুর্যোগের দিনে দেশের সরকার গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু অসৎ কর্মকর্তার দুর্নীতি এ দুর্যোগ সময়েও অব্যাহত রয়েছে। যা সংবাদ মাধ্যমসমূহের সুবাদে মানুষ জানতে পারছে (৯ এপ্রিল, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ, বিডিনিউজ২৪.কম)। এ সময়ে (৭ এপ্রিল) পোপ ফ্রান্সিসের কিছু ধর্মোপদেশ আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে।  

২. গরীব লোকেরা সব সময়ই আমাদের মাঝে আছে। পবিত্র বাইবেলে লাজারের বোন বিশুদ্ধ ব্যয়বহুল সুগন্ধযুক্ত তেল যিশুর পায়ে মাখিয়ে দিয়েছিলে। তখন যুদা ইস্কারিয়োৎ ক্ষোভ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে যিশু বিনম্র কন্ঠে বলেছেন “গরিব লোকদের তোমরা তো সব সময়ই কাছে পাবে” (যোহন ১১২:৮)। পোপ ফ্রান্সিস যিশুর এই কথার গভীরে মনোনিবেশ করে বলেছেন- “আপনারা সর্বদা গরীবদের সাথে থাকবেন।” তারা আমাদের মধ্যেই বসবাস করছে।

৩. অবিশ্বস্ত কর্মকর্তা বর্তমানেও আমাদের মাঝে আছে। আমরা শুনছি এমন দুর্গতির দিনে কিছু কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের অপকর্মের চিত্র। গরীরদের জন্য সরকারি অনুদান চাল-ডাল আত্মসাৎ করছে। বাইবেলে যুদাস গরীবদের কথা বলেছে, তবে তার নিকট গরীবরা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যুদাসের নিকট টাকাকড়ির গুরুত্ব বেশী ছিল। সে টাকাকড়ির যত্ন নিত। সকলের সম্মিলিত টাকার থলিটা সে রাখত, আসলে সে ছিল চোর। পোপ মহোদয়  বলেছন- সব সময়ই এমন মানুষ আছে যাদের মধ্যে একই বৈশিষ্ট্যসমূহ আছে। তিনি আরও বলেছেন, “অবিশ্বস্ত কর্মকর্তার (যুদাসের) গল্পটি বর্তমানেও বিদ্যমান আছে। তারা আমাদের আশেপাশে আছে, এমনটি উচ্চ স্তরেও। আমরা যদি দাতব্য বা মানবকল্যাণ সংস্থার কথা ভাবি যাদের অনেকগুলিতে, কিছু কর্মকর্তা রয়েছে যারা কৌশলে ৪০% অনুদান গরীবদের জন্য বিতরণ করে আর ৬০% নিজেদের বেতনভাতা গ্রহণ করে থাকে। এটি গরীবদের নিকট থেকে টাকা নেয়ার একটা উপায়।” মানবকল্যাণের টাকাকড়ি বিভিন্ন কৌশলে কর্মকর্তাদের খ্যাতি, আত্মতুষ্টি, বিনোদন, উৎসব বা স্বার্থে ব্যবহার করাটাও অন্যদের অংশ আত্মসাৎ করা। মানবকল্যাণের নামে নিজের পদ-পদবির আকর্ষণ, গরিবদের জন্য সংগৃহীত টাকা বিতরণ না করে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা, আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানসমূহ জাগতিক ভোজ-উৎসবে পরিণত করাও এক প্রকার পৌত্তলিকতা, ঈশ্বরকে রেখে বস্তুবাদে আসক্ত হয়ে যাওয়া। যেমনটি  ইস্রায়েল জাতি মরুপ্রান্তরে  ঈশ্বরকে ভুলে তাঁরই অনুগ্রহের স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে তৈরি বাছুরের মূর্তিপূজা করেছিল (যাত্রাপুস্তক ৩২)।  

৪. গরীবরা আমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে। অবরুদ্ধ সময়ে মধ্যবিত্তদের দুর্গতি ও অসহায়ত্বের চিত্র কখনও কখনও প্রকাশিত হচ্ছে। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- গরীবরা সব সময় আমাদের সাথে আছে যিশুর এ কথা খুবই সত্য। পোপ মহোদয় আরও বলেছেন- আমরা রাস্তার পাশে যে গরীব মানুষ দেখি তা একটা বৃহৎখন্ডের ক্ষুদ্রতম অংশমাত্র। গরীবদের বিরাটঅংশ আমরা চোখে দেখি না; তারা লুকানো গরীব মানুষ।  আমরা দেখতে পাই না কারণ আমরা ‘ঔদাসীন্য সংস্কৃতি’ চর্চা করি। যা তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। প্রায়ই আমরা বলি, ‘না, তারা সংখ্যায় অনেক নয় বা সমাজে এখন আর গরীব মানুষ নাই।’ এমন মনোভাব কারও কারও আছে। তার মানে আমরা কেউ কেউ গরীবদের চোখে দেখতে পাই না।  আমরা গরীবদের বাস্তবতা হ্রাস করে থাকি, এমনকি তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করি। কিন্তু তারা সংখ্যায় আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। পোপ মহোদয় বলেছেন- এমনকি যারা গরীবদের উপস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন নয় তারাও গরীবদের গণ্য করে- “একটি শহরের অলংকার বা মূর্তিগুলোর মতো, একটা সাধারণ বিষয় হিসেবে।” 

৫. কিছু মানুষ আর্থিক বৈষম্যের শিকার। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, অনেক দরিদ্র মানুষ অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থার বৈষম্যের শিকার। তবে তারা আর্থিক সাহায্য চাইতে খুব লজ্জা পায়। তাদের চাকুরি থাকলেও মাসের শেষে আর্থিক সংকট মোকাবেলার লড়াই করতেই হয় । পোপ মহোদয় আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের আর্চবিশপ থাকার সময়কালের একটি ঘটনা বলেছেন- একবার একজন লোক তাঁকে একটি পরিত্যাক্ত কারখানার কথা বলেছে। সেখানে ১৫টি পরিবার কয়েক মাস যাবৎ বসবাস করে আসছে। তিনি একদিন সেখানে  গেলেন এবং দেখলেন কারখানার একটি অংশে বাচ্চাদের নিয়ে পরিবারগুলো বসবাস করছে। তিনি তাকিয়ে দেখলেন প্রতিটি পরিবারে টেলিভিশন ও ভাল আসবাবপত্র রয়েছে যা মধ্যবিত্তের পরিচয় বহন করে। আর্থিক সংকটের লড়াই তাদের নিঃশেষ করেছে ফলে ঘরভাড়া দিতেও অপারগ ছিল। এরা নতুন ধরনের গরীব যারা আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় ঘর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যায্য অর্থনীতি বা আর্থিক ব্যবস্থা তাদের এ অবস্থায় ফেলেছে। আমরা হয়তো তাদেরই মধ্যবিত্ত হিসেবে জানি, তারা আমাদের মাধ্যে লুক্কায়িত গরীব। বহুবিধ আর্থিক সংকট কিংবা দুর্যোগে কিংবা অর্জিত মুনাফার অসময় বন্টনের কারণে এদের সংখ্যা দেশে বাড়তেই থাকে।

৬. তিনি সব সময় গরীবদের মাঝে উপস্থিত আছেন। শেষবিচারের দিনে সৃষ্টিকর্তা প্রশ্ন করবেন- ‘গরীবদের সাথে কেমন ব্যবহার করেছি? তাদের কি খেতে দিয়েছ? তুমি কি কারাগারে বন্দিদের ও যারা অসুস্থ তাদের হাসপাতালে দেখতে গিয়েছ? তুমি কি বিধবা এবং এতিমদের সাহায্য করেছ?’ কারণ আমি সেখানেই ছিলাম। আমরা যদি আজ গরীবদের উপেক্ষা করি, তাদের একপাশে ফেলে রেখে এমন আচরণ করি যে তাদের অস্তিত্বই নেই। তবে তিনি বিচারের দিন আমাদেরও অগ্রাহ্য করবেন। যিশু যখন বলেছেন, “গরিব লোকদের তোমরা তো সব সময়ই কাছে পাবে।”  পোপ মহোদয় বলেছেন- যিশু তখন বলেছেন, আমি সব সময় গরীবদের মধ্যে তোমাদের সাথে থাকব। আমি সেখানে উপস্থিত থাকব, আমাকে কাছে পাবে। আমরা গরীবদের সাথে থাকলে আমরাতো মঙ্গলসমাচারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছি। আসুন, নিজের সামর্থ অনুযায়ী এই দুর্যোগ ও অবরুদ্ধ সময়ে অন্যকে সাহায্য করি। যাদের দেখতে পাই শুধু তাদের নয় বরং যারা লুকানো গরীব অর্থাৎ মধ্যবিত্তদেরও সাথে থাকি। আমরা যিশুর সাথেই পথ চলি।

(ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

মঙ্গলবার, ৭ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ যাচনা



১. বিচ্ছিন্নতা, অবরুদ্ধ থাকা বা  অন্তরীণ সময় খুব সহজেই আমাদের ভিতরে ভয়, ক্রোধ, তিক্ততা, অভিযোগ এবং হতাশার মনোভাব প্রবলভাবে প্রতিপালন করতে পারে। শিষ্যদের অন্তরীণ থাকার কী বিশেষত্ব ছিল যা তাদের অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করেছিল। পবিত্র বাইবেলে আমরা পড়েছি কয়েকজন স্ত্রীলোক এবং যিশুর মা মারীয়ার সাথে শিষ্যরা একত্রে প্রার্থনারত ছিল’ (শিষ্যচরিত ১:১২-১৪)। ঘরবন্দি অবস্থায় আমরাও প্রেরিতশিষ্যদের ও মা মারীয়ার মত প্রার্থনারত থাকতে পারি। এমন আধ্যাত্মিক একাত্মতা অনুশীলন করে নিজে রূপান্তরিত হতে পারি ও  অন্যকে রূপান্তরিত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারি। প্রার্থনা আমাদের জন্য একটি অন্যতম আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন সময় দেখি ও অভিজ্ঞতা করছি। একটি অন্ধকার ও বিরক্তকর অভিজ্ঞতা যা আমাদের কাছে অভিশাপের মত হতে পার। ঐ মুহূর্তে প্রার্থনা আমাদের জীবনে গভীর অভ্যন্তরীণ রূপান্তর আনে, শান্তির সূচনা করে। এমন কী কিছু সময় পরে অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আর্শীবাদের অভিজ্ঞতা করতে পারি। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও মহা ব্যস্ততা থেকে বাধ্য হয়ে দূরে আছি যেখানে আমরা ‘বিশ্বটা অবরুদ্ধ’ বা ‘পৃথিবীটা মনেস্টারি’ ভাবছি। এমনও হতে পারে অবশেষে সৃষ্টিকর্তা বিশ্বের এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হুমকি স্বরূপ ঘাতক ভাইরাসটি দুনিয়া থেকে নির্মুল করবেন। আমাদের বিশ্ব, আমাদের সমাজ, আমাদের মণ্ডলী হয়ে উঠবে পুনর্নবীকরণ, ব্যাপক রূপান্তরিত যা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।  

২. বিশ্বব্যাপক করোনাভাইরাস সংক্রমনের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন গীর্জায় খ্রিস্টভক্তদের আগমন দেশের প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নির্দেশিত এবং অনলাইনে ইউটিউব ও ফেসবুক লাইভ স্ট্রিমিংয়ে উপাসনায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে এ সময় আমরা সাধু-সাধ্বীর নিকট আধ্যাত্মিক সহয়োগিতা চাইতে পারি। আমাদের প্রত্যেকের নামেই একজন সাধু বা সাধ্বীর নাম সংযুক্ত আছে তাদের নিকট আমরা প্রার্থনা করতে পারি। আমরা ঈশ্বরের সেবক আর্চবিশপ থিওটনিয়াস অমল গাঙ্গুলী, সাধ্বী মাদার তেরেজা এবং সাধু জন পল এর সহযোগিতা যাচনা করতে পারি। এখানে চারজন সাধু-সাধ্বীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের নিকট অসুস্থ ও মহামারী সময়ে খ্রিস্টভক্তগণ নিরাপদ থাকা জন্য সর্বদা প্রার্থনা করে থাকেন। 

৩. সাধু আলোইসিয়াস গনজাগা। তিনি যিশু সংঘের যাজক ছিলেন এবং রোম নগরে স্বেচ্ছায় প্লেগ সংক্রমক রোগীদের সেবাযত্নের কাজ করেছেন। পরে নিজেও প্লেগ সংক্রমণে মৃত্যুবরণ করেন।


৪. ক্ষুদ্রপুষ্প সাধ্বী তেরেজা। তিনি যুবতী বয়সে অসুস্থতা নিয়ে কষ্ট করেছেন। তিনিও আমাদের খুব পরিচিত এবং সহজেই তাঁর সাহায্য চাইতে পারি।

৫. সাধ্বী বার্ণাডেট সৌবিরস। ফ্রান্সের লুর্দ শহরের মা মারীয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা সাধ্বী বার্ণাডেট সৌবিরস। যিনি ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে মহামারী কলেরায় আক্রান্ত ছিলেন এবং সারা জীবন হাঁপানিসহ অন্যান্য রোগে কষ্ট পেয়েছেন। তাঁর নিকট লক্ষ লক্ষ মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য প্রার্থনা করেন এবং লুর্দে তীর্থ করতে যান। 

৬. সাধ্বী করোনা। করোনাভাইরাসের মহামারী সময়ে কেউ কেউ সাধ্বী করোনা’র সাহায্য কামনা করে প্রার্থনা করছেন। তবে ভাইরাস নামের মিলের কারণেই তাঁর কাছে প্রার্থনা করছেন। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়- সাধ্বী করোনা দ্বিতীয় শতাব্দীর একজন খ্রিস্টবিশ্বাসী যুবতী ১৬ বছর বয়সে বিশ্বাসের জন্য সিরিয়ায় ধর্মশহীদ হয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে মানুষ খুব কম জানে। ১৬৫ খ্রিস্টাব্দ রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের অত্যাচার চলাকালীন তিনি র্ধমশহীদ হন। বিশ্বাসের জন্য তিনি নির্যাতনের শিকার হন এবং ভয়াবহ মৃত্যুবরণ করেন। সাধ্বী করোনাকে গ্রেপ্তার করে মাটিতে বাঁকানো দু’টি তাল গাছের চূড়ায় পা বেঁধে রাখা হয়েছিল। তারপর এ অবস্থায় তাঁকে ছিঁড়ে ফেলা হয়। তাঁর ধর্মশহীদ মৃত্যুবরণের দিন ১৪ মে। তাঁর সাথে সাধু ভিক্টরকেও হত্যা করা হয়। সাধ্বী করোনা নামটি ল্যাটিন শব্দ ‘করোনা’ এর অর্থ ‘মুকুট’। অর্থাৎ যুবতী সাধ্বী করোনা বিশ্বাসে অবিচলতার কারণে ‘অনন্ত জীবনের মুকুট’ অর্জন করেছেন। বিশেষভাবে ভারী ঝড় ও প্রাণি থেকে সংক্রমিত রোগ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। করোনাভাইরাস মহামারীটি সাধ্বী করোনার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষভাবে উত্তর ইতালি, অস্ট্রিয়া, বাভারিয়া এবং দক্ষিণ জার্মানিতে মহামারী ও ঝড়ের সময়ে ঘুরে দাড়ানোর জন্য সাধ্বী করোনা’র নিকট বিশেষ প্রার্থনা করছে। সেখানে সাধ্বী করোনা’র নামে গীর্জা, চ্যাপেল ও বেশ কয়েকটি তীর্থস্থান রয়েছে।


(ছবিসমূহ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০২০

অবরুদ্ধ সময়ে একাত্মতা কিংবা বিচ্ছিন্নতা - কিছু ঘটনা



১. ছবিটি ব্যবহার করেছি তা পবিত্র ক্রুশ সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ফা. বাসিল আন্তনী মরো'র স্বেচ্ছা 'একা অন্তরীণ' ধ্যান প্রার্থনা কাটানোর ঘর। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই সেখানে আমি গিয়েছি। তিনি মাঝে মাঝে ফ্রান্সের এক নিভৃত ছোট পল্লীর এই বাড়িতে প্রার্থনারত একা থাকতেন কিছু দিন।মানুষের জীবন এখন সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্নতা এবং বন্ধাবস্থা এই চারটি পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ লেখাটি যখন লিখছি তখন ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে মাইকিং করে সতর্কমূলক ঘোষণা দিচ্ছে- প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা বাড়াতে জনগণকে মসজিদসহ কোনো ধরণের ধর্মীয় উপাসনালয়ে উপস্থিত না হয়ে ঘরে প্রার্থনা করতে বলছে সরকার। অবরুদ্ধ সময়ে ঈশ্বরের সাথে আধ্যাত্মিক একাত্মতার কিছু ঘটনা ও অনুধ্যান তুলে ধরছি। আমার বিশ্বাস অনেকের ভাল লাগবে।

২. সবেমাত্র বাংলাদেশে কারাবন্দিদের আধ্যাত্মিক পরিচর্যার দায়িত্ব পেয়েছি। একটি কারাগারে বন্দিদের সাথে সাক্ষাতের সময় একজন বন্দি পবিত্র সাক্রামেন্ত গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে তার নয় বছরের বন্দিবাস অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু মামলার বিচারকাজ এখনও চলমান আছে। দীর্ঘসময় সে সাক্রামেন্ত গ্রহণ করতে পারেনি। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালেও কারাকর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া যায়নি। অনেক আলোচনা করে বড়দিনের সাক্ষাতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া গেল। তবে ত্রিশ মিনিট সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে । এদিকে বড়দিনের কেক কাটবেন কারাকর্তৃপক্ষ, এরপর অন্যান্য বন্দিদের মাঝে বড়দিনের উপহার বিতরণ করা হবে। ইতোমধ্যে খ্রিস্টভক্ত ১৮জন বন্দি ছোট দরবার কক্ষে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমে বন্দিরা পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহণ করেছে তারপর অল্প সময়ে খ্রিস্টযাগ সমাপ্ত হয়েছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহণের সময় সকলের চোখেজল দেখেছি, অন্যদিকে খ্রিস্টকে গ্রহণ করে সকলের চেহারায় আনন্দের প্রকাশ ছিল। বিদায়ের সময় খ্রিস্টভক্ত বন্দির অনুভূতি অনেকটা এমন ছিল- “মূল্যবান কিছু পেতে পেতে হঠাৎ যখন বঞ্চিত হই তখনই গুরুত্ব বুঝতে পারি।” বিভিন্ন কারাগারে বন্দিদের সাক্ষাৎকালে প্রায় সময় একই উপলব্ধি সহভাগিতা করেছে। কারাবন্দিরা নিয়মিত আধ্যাত্মিক অনুশীলন থেকে বঞ্চিত থাকে। তারা জানে না আবার কখন খ্রিস্টকে গ্রহণ করতে পারবে। তবে আধ্যাত্মিক একাত্মতায় তারা খ্রিস্টের সাথে যুক্তই আছে। কভিড-১৯ সংক্রমণ যেন দ্রুত বিস্তারিত না হয় সেজন্য আমরা নিজ বাড়িতে অন্তরীণ আছি। যা আমরা অবজ্ঞা করে চলতে পারছি না। এ সময়টা কিছুটা কারাবন্দির মতোই আছি, তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা কিছু করছি । এ সময় নিয়মিত খ্রিস্টযাগে যোগদান করে আধ্যাত্মিক অনুশীলন আমরা করতে পারছি না, কিন্তু আমরা খ্রিস্ট ও খ্রিস্টভক্তদের সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে একাত্মই থাকতে পারি।  

৩. খ্রিস্টীয় ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে অনেক সাধুজন আধ্যাত্মিক সাধনায় সন্ন্যাস জীবনযাপন করতেন। তারা স্বেচ্ছায় মরুপ্রান্তরে ছোট ছোট ঝুপড়িতে একা একা ধ্যানমগ্ন থাকতেন। পাশাপাশি ৫/৬জন সন্ন্যাসী অবস্থান করলেও পরস্পরের সাথে অতি প্রয়োজন ছাড়া দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না। একজন পথিক যাত্রাপথে পাশের সন্ন্যাসীর ঝুপড়ির সামনে ঝুড়িতে কিছু আঙ্গুর ফল রেখে গেল, এমনটি প্রচলিত ছিল। সন্ন্যাসী তার ঝুপড়ির সামনে সুস্বাদু আঙ্গুরের ঝুলি পেয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। তিনি চিন্তা করলেন- রাস্তা থেকে আমার ঝুপড়িই প্রথম। পথিকরা আমার কাছে যখন-তখন আবারও কিছু নিশ্চয়ই রাখবে। আমি বরং পাশের সন্ন্যাসীকে আঙ্গুরগুলো দিয়ে আসি। পাশেরজন তার ঝুপড়ির সামনে লোভনীয় আঙ্গুর দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি চিন্তা করলেন- বেশ ভালই হলো পাশের সন্ন্যাসী দেখছি কয়েকদিন যাবৎ অসুস্থ, আঙ্গুরগুলো এসময় তার সুস্থস্তার জন্য উপকারী হবে। এবার অসুস্থজন আঙ্গুরের ঝুড়ি পেয়ে ভাবলেন- আমার পাশে যুবক সবেমাত্র সন্ন্যাস জীবনে যোগ দিয়েছে তার নিশ্চয়ই ভালকিছু খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি আঙ্গুরের ঝুড়ি যুবকের ঝুপড়ির সামনে রেখে গেলেন। এদিকে যুবক সন্ন্যাসী চিন্তা করল- আমার সামনে অনেক সময় আছে; আমি বরং পাশের প্রবীন সন্ন্যাসীকে আঙ্গুরগুলো দিয়ে আসি। এবার প্রথম সন্ন্যাসী দেখলেন- ঝুড়ি ভর্তি লোভনীয় আঙ্গুর ফল তার ঝুপড়ির সামনেই আছে। সন্ন্যাসীরা ধ্যান-সাধনার উদ্দেশ্যে সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্ন থাকা এবং বন্ধাবস্থা স্বেচ্ছায়  গ্রহণ করেছেন। তথাপি তারা আধ্যাত্মিক একাত্মতায় পরস্পরের কাছে আছেন। বিভিন্ন কারণে মানুষ বিচ্ছিন্ন বা দূরত্বে থাকতে পারে। তবে পরস্পরের প্রতি যখন ভালবাসা থাকে, অন্যের উপকার করার মনোভাব থাকে এবং অন্যের জন্য মঙ্গলকাজ করে তখন আধ্যাত্মিক একাত্মতায় থাকতে পারি। 

৪. করোনাভাইরাসটি নির্মুল করার যুদ্ধসময়ে বিশ্বাসের ঐতিহ্যগত ‘আধ্যাত্মিক একাত্মতা’ অনুশীলন নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমানের আহ্বান। তৃতীয় শতাব্দীর প্লেগ মহামারীর সময়টা সাধু সিপ্রিয়ান মানুষের অন্তরে বিশ্বাস ও আশা জোরদারের সুযোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি প্রচুর সাহস এবং বিপুল আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘এটা কতই না আধ্যাত্মিক মহিমা’ যা ‘ধ্বংস ও মৃত্যুর আক্রমণ এর সামনে জীবন্ত বিশ্বাস নিয়ে অবিচল থাকা। ভয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ার পরিবর্তে বিশ্বাসে শক্তিশালী হতে ‘সুযোগটি আলিঙ্গন করা’ দরকার। আধ্যাত্মিক অনুশীলন হিসেবে পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ ও খ্রিস্টের উপস্থিতি অভিজ্ঞতা করার বিকল্প কিছুই নাই। তবে মহামারী সময়ে ‘আধ্যাত্মিক একাত্মতা’ প্রথমে অর্থহীন বিকল্প হিসেবে মনে হতে পারে অবশেষে নিজেরা অভিজ্ঞতা করতে পারব যে এটি সত্যিই ঈশ্বরের একটি অসাধারণ অনুগ্রহ। অনেক শতাব্দী পর্যন্ত সাধু ও ধর্মতত্ত্ববিদরা নিজেরা অভিজ্ঞতা করেছেন ও বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। আভিলার সাধ্বী তেরেজা অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন- যখন তুমি পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করতে পার না, খ্রিস্টকে গ্রহণ করার সুযোগ পাও না, তখন খ্রিস্টের সাথে ‘আধ্যাত্মিক একাত্মতা’ অভ্যাস করবে। তখন দেখবে খ্রিস্টের ভালবাসায় দিনে দিনে তুমি আপ্লুত হতে থাকবে। একা কারাবন্দি অবস্থায় ক্রুশভক্ত সাধু যোহন একটি কবিতায় লিখেছেন- জীবন্ত জলের ঝর্ণা বিশ্বাসীর অন্তরে সর্বদা সঞ্চারিত হয়, এমনকি বিশ্বাসের অন্ধকার সময়েও।  বুলগেরিয়ার একজন বিশপ বহু বছর আগে বলেছেন- তার দেশে কমিউনিস্ট নির্যাতনের সময়কালে অনেক পুরোহিত রাজপথে প্রাণ দিয়েছে অথবা কারাগারে বন্দি ছিল। এমন অবস্থায় পুরোহিত ছিল না। বিশ্বাসী খ্রিস্টভক্তগণ যখন পাপস্বীকার করতে ইচ্ছা করত তখন তাদের পরিচিত পুরোহিতের কবরে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে পাপস্বীকার করত।  

৫. মরুভুমিতে খ্রিস্ট যিশুর একাকী অভিজ্ঞতা ও তাঁর ধর্মনিষ্ঠার পরীক্ষা (মথি ৪:১-১১) ঘটনা আমার জানি। মরুপ্রান্তরে দীক্ষাগুরু যোহনের বাণী প্রচারের গল্পটি আমাদের স্মরণ আছে (৩:১-১০)।  ইহুদী ধর্মনেতাদের ভয়ে শিষ্যরা ‘দরজা বন্ধ করে’ একত্রে ছিল এবং তারা যিশুর দেখা পেয়েছে  (যোহন ২০:১০)। তারা অন্যান্য লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, 'একত্রে অন্তরীণ'  ছিল। বাইবেল আমরা পড়ি আরও একবার শিষ্যরা কীভাবে ‘একত্রে অন্তরীণ’ অবস্থায় সেই  ‘উপরের ঘরে’ ছিল । লক্ষণীয় বিষয় এবার তারা ভয়ে তাদের হৃদয় হিমশীতল হতে দেয়নি বরং পবিত্র আত্মার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল (শিষ্যচরিত ১:১২-১৪, ২: ১-১২)। পবিত্র বাইবেলে অন্ধ বার্তিমেয় (মার্ক ১১০:৪৬), অসুস্থ মহিলা, অনিহুদী স্ত্রীলোক (মার্ক ৭:২৪-৩০) এমন অনেকে সামাজিক কারণে যিশুর কাছে যেতে পারেনি। তবে তারা ঠিকই যিশুর নিরাময় কৃপা লাভ করেছেন কারণ তাঁর সাক্ষাৎ লাভের তাদের অন্তরে গভীর ইচ্ছা ছিল। যিশুর সাথে তারা আধ্যাত্মিক একাত্মতায় ছিল। অন্যদিকে করগ্রাহক ও পাপীরা (লুক ১৫:১-১০) গভীর আগ্রহ নিয়ে যিশুকে গ্রহণ করতে অপেক্ষা করেছে, যখন সুযোগ পেয়েছে তখন যিশুর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। হারানো ছেলে ‘বিচ্ছিন্ন  জীবনযাপন’  করে বাবার ভালবাসা আবিস্কার করেছে এবং অন্তরে আধ্যাত্মিক একাত্মতা জাগ্রত হয়েছে; অন্যদিকে বড়ছেলে একসঙ্গে বাবার বাড়িতে থেকেও অন্তরে বাবার ভালবাসায় একাত্ম হতে পারেনি (লুক:১৫:১১-৩২)। 

৬. বিচ্ছিন্নতা, অবরুদ্ধ থাকা, অন্তরীণ সময় খুব সহজেই আমাদের ভিতরে ভয়, ক্রোধ, তিক্ততা, অভিযোগ এবং হতাশার মনোভাব প্রবলভাবে প্রতিপালন করতে পারে। শিষ্যদের অন্তরীণ থাকার কী বিশেষত্ব ছিল যা তাদের অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করেছিল। আমরা পড়েছি কয়েকজন স্ত্রীলোক এবং যিশুর মা মারীয়ার সাথে শিষ্যরা একত্রে প্রার্থনারত ছিল’ (শিষ্যচরিত ১:১২-১৪)। প্রার্থনা আমাদের জন্য মহা আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন সময় দেখি ও অভিজ্ঞতা করছি। একটি অন্ধকার ও বিরক্তকর অভিজ্ঞতা যা আমাদের কাছে অভিশাপের মত হতে পার। ঐ মুহূর্তে প্রার্থনা আমাদের জীবনে গভীর অভ্যন্তরীণ রূপান্তর আনে, শান্তির সূচনা করে। এমন কী কিছু সময় পরে অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আর্শীবাদের অভিজ্ঞতা করতে পারি। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও মহা ব্যস্ততা থেকে বাধ্য হয়ে দূরে আছি যেখানে আমরা  ‘বিশ্বটা অবরুদ্ধ’  বা  ‘পৃথিবীটা মনেস্টারি’  ভাবছি। এমনও হতে পারে অবশেষে সৃষ্টিকর্তা বিশ্বের এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হুমকি স্বরূপ ঘাতক ভাইরাসটি দুনিয়া থেকে নির্মুল করবেন। আমাদের বিশ্ব, আমাদের সমাজ, আমাদের মণ্ডলী হয়ে উঠবে পুনর্নবীকরণ, ব্যাপক রূপান্তরিত যা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।  

৭. ঘরবন্দি অবস্থায় আমরাও প্রেরিতশিষ্যদের ও মা মারীয়ার মত প্রার্থনারত থাকতে পারি। এমন আধ্যাত্মিক একাত্মতা অনুশীলন করে নিজে রূপান্তরিত হতে পারি ও  অন্যকে রূপান্তরিত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারি। আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের বিশ্বাসের সাক্ষ্যদান হবে তখনই যখন- প্রার্থনা, ধ্যান, উপাসনা, ধর্মশিক্ষা ও সংস্কারীয় জীবনের প্রতি আমাদের অনুরাগ ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। খ্রিস্টীয় বিবাহ, যাজকীয় ও সন্ন্যাসব্রতী জীবনের আহবান সম্পর্কে নবচেতনা ও নবজাগরণ ঘটবে। স্থানীয়, ধর্মপ্রদেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মণ্ডলীর কর্মসূচী ও কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ বাড়বে। সামাজিক জীবনের সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ বাড়বে। দয়াকর্ম, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক  কর্মকান্ডের জন্য নতুন উদ্যোগ ও চেতনা সৃষ্টি হবে। খ্রিস্টবিশ্বাসে যাদের স্খলন ঘটেছে, তারা আবার খ্রিস্টীয় জীবনে ও মণ্ডলীর মিলন-সংযোগে ফিরে আসবে। আসুন, আমরা প্রার্থনা করি, অবিরত প্রার্থনা করি এবং খ্রিস্ট ও আপনজনদের সাথে আধ্যাত্মিক একাত্মতায় থাকি।