শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২১

ফেব্রুয়ারী ৮ : মানবপাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক প্রার্থনা ও সচেতনতা দিবস

 সাধ্বী যোসেফিন বাকিতা’র পর্ব: মানবপাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক প্রার্থনা ও সচেতনতা দিবস

সিস্টার যোসফিন রোজারিও, এসএসএমআই

কৃতদাসী থেকে সৌভাগ্যবতী যোসেফিন: মাতামণ্ডলী ৮ ফেব্রুয়ারী সাধ্বী যোসেফিন বাকীতার পর্ব পালন করে থাকে। তিনি ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে আফ্রিকার সুদান দেশে ওলগোসা নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকালে তিনি মা বাবা ও ভাইবোনেদের ভালবাসায় বড় হচ্ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস; মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি আরব কৃতদাস-ব্যবসায়ীদের দ্বারা অপহৃত হন এবং কৃতদাসী রূপে একাধিকবার বিভিন্ন ধনীলোকদের কাছে বিক্রি হন। কৃতদাসী রূপে তার এ বিড়ম্বনাময় জীবনে এত নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্চিত ও প্রহারিত হন যে তিনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে নিজের নামটা পর্যন্ত ভুলে যান ফলেন। তার একজন মালিক তাকে 'বাকিতা' (বাংলায় 'সৌভাগ্যবতী') নাম দেন। এ ছলনাময়ী নামের সাথে তার পাওয়া বিদ্রুপ, লাঞ্চনা, গঞ্জনার কোন মিল ছিল না বটে, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি উপলব্ধি করেছেন তার নামের ভবিষ্যতবাণীর সার্থকতা। যোসেফিন বাকিতা আফ্রিকার বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকায় কাজ করেছেন এবং নির্মম কষ্ট সহ্য করেছেন। একসময় এক ইতালীয়ান  রাষ্ট্র-দূত তাকে ইতালীতে নিয়ে গিয়ে তার পরিবারকে সেখানে স্থানান্তরিত করেন এবং তার পিতামাতার কাছে ফিরিয়ে দেন। এভাবে সেখানে তিনি লাভ করেন নব জীবন আর হয়ে উঠেন তার সমগ্র পরিবারের মুক্তিদাতা এবং পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠে। 

‘স্বাধীন নারী’ সিস্টার যোসেফিন বাকিতা: ইতালীর ভেনিস শহরে কেনোসিয়ান সিস্টারদের সহযোগিতায় বাকিতা কোর্ট থেকে মুক্তি লাভের সকল কার্যক্রম শেষ করে স্বাধীনভাবে ইতালীতে বাকী জীবন কাটান। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বাপ্তিস্ম ও হস্তার্পণ সাক্রামেন্ত গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কেনোসিয়ান সিস্টার হন এবং 'সিস্টার যোসেফিন বাকিতা' নামে পরিচিত হন। তিনি ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারী এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।

পাচারকৃত ভাইবোনদের প্রতিপালিকা সাধ্বী যোসেফিন বাকিতা: মানব প্রেমিক সাধু দ্বিতীয় পোপ জন পৌল যোসেফিন বাকিতাকে সাধ্বী শ্রেণীভূক্ত করেন এবং ৮ ফেব্রুয়ারী তার পর্বদিন বলে ঘোষণা করেন। ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দে মাতামণ্ডলী তার পর্বদিনটি প্রথমবারের মত পাচারকৃত ভাই বোনদের জন্য আর্ন্তজাতিক ভাবে প্রাথর্না-অনুধ্যানের জন্য উৎসর্গ ও উদযাপন করেছেন। ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিস মানব পাচার নামক গর্হিত ও ঘৃন্যতম কাজটি সমাজ থেকে নির্মূল করে অধিকার বঞ্চিত, নিপীড়িত, বিড়ম্বিত ও বলিকৃত ভাইবোনদের মুক্তি ও এদের পাশে দাঁড়াবার জন্য বিশ্বের নেতানেত্রীদের দৃষ্টি আর্কষণ করেন ও একটি যথাযথ ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। সাধ্বী যোসেফিন বাকিতার কাছে পাচারে স্বীকার হওয়া ভাইবোনদের জন্য পোপ ফ্রান্সিস নিজে বিশেষ প্রার্থনা করেন ও খ্রীষ্ট মন্ডলীর সবাইকে প্রার্থনা করতে অনুরোধ করেন। এই সাধ্বী নিজ জীবনে মানব পাচার নামক নির্মম-যন্ত্রনাদায়ক জীবনাবস্থার শিকার হয়েছেন ও এর বেদনা নিজ জীবনে উপলব্ধি করেছেন কিন্তু পরবর্তীতে স্বহৃদয়বান ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক, মানসিক, আবেগিক ও নৈতিক সমর্থন, ভালবাসা, কাউন্সিলিং ও গ্রহণীয়তা তাকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করেছে; তার অভিজ্ঞতা সহভাগিতার মাধ্যমে অন্যদের দৃষ্টি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে তাকে "পাচারকৃত ভাইবোনদের প্রতিপালিকা" বলে অভিহিত করা হয়। 

মানব পাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক প্রার্থনা ও সচেতনতা দিবস: সভ্যতা বিবর্জিত জঘন্য অপকর্ম মানব পাচার। শোষণ করার উদ্দেশ্যে ভয় দেখিয়ে বা বল প্রয়োগ করে বা অন্য কোন জোড়পূর্বক উপায়ে অপহরণ, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্বল অবস্থা কাজে লাগিয়ে অর্থ আগান-প্রদান করা একটি অপরাধ। আবার যেকোন প্রকার লোভ দেখিয়ে মানুষ সংগ্রহ, পরিবহন, হস্তান্তর, লুকিয়ে রাখা নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক ব্যধি। ঈশ্বর সম-মর্যাদা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সমগ্র সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব দিয়েছেন সেই মানুষই আজ আরেকজন মানুষকে পণ্য হিসেবে ক্রয়-বিক্রি করছে এবং যেমন তেমন ভাবে ব্যবহার-অপব্যবহার করছে। ঈশ্বর নিজে সৃষ্টি কর্তা হয়ে মানুষের স্বাধীনতাকে সম্মান করেন কিন্তু মানুষ অন্য একজন মানুষের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। তারপর জবরদস্তি করে পরিবার থেকে, সমাজ থেকে দূরে নিয়ে এমনকি দেশান্তর করে, কঠিন শ্রম দিয়ে, পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করছে। তাদের উপর যৌন নির্যাতন বা শ্লীলতাহানি, মারধর, আঘাত বা অন্য কোনো রকম শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করে তার ক্ষতি সাধন করছে। কাথলিক মণ্ডলীতে পোপ ফ্রান্সিস এ গর্হিত কাজের তীব্র নিন্দা জানিয়ে পাচারকারী ভাইবোনের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুক্তির জন্য প্রত্যেক মানুষকে জেগে উঠতে উৎসাহিত করছেন। তাই তিনি ৮ ফেব্রুয়ারী সাধ্বী যোসেফিন বাকিতার পর্ব দিনে বিশ্ববাসীদের মানব পাচার বিরুদ্ধ দিবস হিসাবে উদ্যাপন করতে আহ্বান জানান। 

তালিথা কুম নেটওয়ার্ক: ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিস মহোদয়ের অনুরোধে বিশ্বব্যাপী সিস্টার সন্ন্যাস সংঘের মেজর সুপিরিয়রদের সম্মেলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভাটিকান কেন্দ্রিক “তালিথা কুম আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক” (Talitha Kum International Network)। এ নেটওয়ার্কের সম্পৃক্ত হয়ে সিস্টারগণ বিশ্বের বুক থেকে মানব পাচার, জোড়পূর্বক অভিবাসন, অনৈতিক ও অন্যায্য মালিক-শ্রমিক সম্পর্কযুক্ত অমানবিক কর্ম পৃথিবী থেকে নির্মূল করার জন্য সেবাকাজ করে যাচ্ছেন।  পবিত্র বাইবেলের আরাময়িক শব্দ "তালিথা কুম" (বাংলায় 'খুকু আমি তোমাকে বলছি, তুমি উঠ') গ্রহণ করা হয়েছে (মথি ৫:৪১)। International Union of Superior General (UISG) সম্মিলিত ভাবে মানব পাচার নিরোধের প্রত্যাশায় ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে  সেবাকাজ আরম্ভ করেন। ২০০৭ খ্রীষ্টাব্দে যখন কাথলিক সন্ন্যাসব্রতিনীগণ অনুভব করলেন  নারী পাচারের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমে বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন থেকে সেবাকাজের অনুপ্রেরণা আরম্ভ হয় । ২০১৩ খ্রীষ্টাব্দে মোট ৭৫টি দেশের বেশ কয়েকজন নারী সন্ন্যাসব্রতী সংঘ-প্রধানগণ সম্মেলিতভাবে সিস্টার ইষ্ট্রেল্লা কাস্টালনে এর নেতৃত্বে প্রায় ৬০০ সিস্টার একত্রে গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে শুরু করেন এবং ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৮০টি দেশের ১১০০ জন সেবাকর্মী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এশিয়া মহাদেশের ৮টি দেশ এ কার্যক্রম খুবই আন্তরিকতা সাথে কাজ করছেন্। বাংলাদেশে ন্যায় ও শান্তি কমিশন-সিবিসিবি ও বিসিআর এর যৌথ সমর্থনে এবার বাংলাদেশ মণ্ডলীও  প্রত্যক্ষভাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।

তালিথা কুমের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য: (১) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রতধারী/ধারিনী, সামাজিক সংঘটন, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতা নেত্রীদের মধ্যে মানব পাচার বিরুদ্ধ নেটওয়ার্ক তৈরী করা; (২) চলমান কার্যক্রম ও পদক্ষেপগুলো কে আরো শক্তিশালী করা, সন্ন্যাসব্রতী সংঘগুলির মানব সম্পদের অনুকূলকরণ ও তাদের সম্ভাবনাগুলির সুষ্ঠ প্রয়োগ, প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, সচেতনতা প্রদান, ভূক্তভোগীদের পূর্ণবাসন ও সংরক্ষণ, এবং পাচার বিরুদ্ধ অফিসিয়াল রির্পোট প্রদান; (৩) চলমান ঘটনা বিষয়ে সদস্যাদের জন্য সচেতনতামূলক শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম প্রনয়ন ও উন্নয়ন এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাস্তবায়ন; (৪) সদস্যাদের প্রাবক্তিক ভূমিকা বিষয়ে সোচ্চার করে তোলা, শোষনকারী-দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ভাবে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, আইনী সহায়তা দাবী পূরণে সহায়তা এবং নারীদের ক্ষমতায়নে আইনী সহায়তা প্রদান ও পাশে দাঁড়ানো।

বাংলাদেশে মানব পাচারের ভয়াবহ রূপ: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রেস রিপোর্ট অনযায়ী- মানব পাচারে জড়িতচক্রসমূহ লোভনীয় চাকরি ও সুযোগ-সুবিধার নামে ‘মিথ্যাস্বপ্ন’ দেখিয়ে বাংরাদেশের লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ ও শিশুদের এ পথে নিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক পাচার, যৌন-দাসত্ব, সংখ্যালঘু ও দুর্বল মানুষদের বেআইনী ভাবে ব্যবহার ও নির্যাতন, মানবাধিকার খর্ব, প্রতারণা ইত্যাদির মাধ্যমে এক কুচক্রীমহল কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়েই চলছে এদের দমনের উদ্যোগ না নিলে দেশ ও সমাজ এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হবে। র‌্যাবের রিপোর্ট অনুসারে শুধু মাত্র ডান্স ক্লাবের নামে গত দেড় বছরে সহস্রাধিক  নারী পাচার হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে- বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরে প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে; এদের একটি বড় অংশ পাচার হয়ে যায়। এসবের মূলে দারিদ্রতা, মিথ্যাস্বপ্ন, কর্ম সুযোগের অভাব, স্বল্প শিক্ষা, পরিবারগুলির ভাঙ্গন প্রক্রিয়া, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা, অভিবাসন নীতিমালা ইত্যাদি বিষয়কে দায়ী করা যায়। তাই বাংলাদেশ মণ্ডলী মানব পাচার মুক্ত অর্থনীতি গঠনে পোপ মহোদয়ের সাথে "তালিথা কুম নেটওয়ার্ক" এর মূলনীতি অনুসরণ করে সরকার ও মানব পাচারে শিকার ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াতে ও তাদের সেবা করতে জোড়ালো ভূমিকা রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করছে। 


(তথ্যসূত্র: তালিতা কুম ডেস্ক ইনফরমেশন ও ইন্টারনেট) 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন