সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পৃথিবীর সৃষ্টি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের যত্ন -বিশপ জের্ভাস রোজারিও

প্রিয় ভাইবোনেরা,

সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও প্রজ্ঞাবান, তাঁর মত বিচক্ষণ আর দয়ালু আর কেউ নেই। তিনি তাঁর সমস্ত ভালবাসা দিয়েই এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন, তিনি সৃষ্টি করেছেন গ্রহ-তারা আর সূর্য্য-চন্দ্র। তাঁরই দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী আর তার সকল বস্তু আর জীব-জন্তু-পশুপাখী, গাছপালা, মাছ-সরিশৃপ, পোকা-মাকড়, ইত্যাদি সবই। আর শেষে পরম মমতায় ও ভালবাসায় মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন সাগর ও নদ-নদীসহ জলাভূমি আর পাহাড়-পর্বত। বিশ্বের সবকিছু তিনি মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বরই সৃষ্টি করেছেন আকাশ বাতাস ও মাটি-জল-বায়ু সব কিছুর বিধি-বিধান বা প্রাকৃতিক নিয়ম। এই সব কিছুই ঐশবিধানেরই প্রতিফলন। ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন সবকিছুরই বিপুল অগ্রগতির সম্ভাবনা দিয়ে। আর তিনি সব কিছু মানুষের হাতে ন্যস্ত করেছেন, আর চেয়েছেন যেন মানুষ বা মানব জাতি এই তাঁর সকল সৃষ্টির যত্ন ও রক্ষা করে এবং উন্নয়ন ও সম্ভাবনার স্ফুরণ ঘটায়। এইসব বিষয় অবশ্য অনেকের কাছেই অমূলক, তারা এইসব থিওরি বিশ্বাস করে না। কোন মানুষ বিশ্বাস করুক বা না করুক ঈশ্বর তাঁর কাজ ঠিক মতোই করে যান আপন প্রজ্ঞায়। 

এখন প্রশ্ন হলো মানুষ বা মানব জাতি কি ঈশ্বরের সেই আস্থা ও দায়িত্বের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পেরেছে? পৃথিবীর আব-হাওয়ার বা জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে যে বিশ্বব্যাপী যে সকল বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও বিপর্যয় নেমে আসছে, তা নিয়ে সকলেই শঙ্কিত ও তার কারণ কি তা নিয়ে এখন সকলেই ভাবছে। এই যে এখন পৃথিবীর ওজোন স্তর ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে, কার্বনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে,  আব-হাওয়া ক্রমেই উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে যাচ্ছে, উচু পর্বত মালার বরফ ও গ্লাচিয়ার গলে যাচ্ছে, তার জল গড়িয়ে গিয়ে সমুদ্রের জল বাড়িয়ে দিচ্ছে, সুনামী-ভূমিকম্প আর ঘুর্ণিঝড়-সাইক্লোন হচ্ছে, বন্যা-খড়া, ইত্যাদির মত অযাচিত সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে, তার জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? ঈশ্বর কিন্তু তাঁর সৃষ্টির কোন অযত্ন করেন না, এইসব কিছুর জন্য তিনি নিশ্চয়ই দায়ী নন। 

এর জন্য আমরা মানুষেরাই কোন না কোনভাবে দায়ী - আমরা যারা অতিভোগবাদী ও বস্তুবাদী হয়ে এই পৃথিবী নামের গ্রহটির উপর শোষণ ও ভক্ষণ নীতি চালিয়েছি। বিগত শতাব্দীর তথাকথিত শিল্পবিপ্লবের পূর্বে মানুষের এই ভোগবাদী মনোভাব কিছুটা নিয়েন্ত্রনে ছিল; কিন্তু এর পরে ক্রমে ক্রমে বিশ্বব্যাপী মানুষ হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রনহীন বস্তুবাদী ও অতিমাত্রায় ভোগবাদী। এরই ফলে পৃথিবীর সকল সম্পদ যে যত বেশী ভোগ করতে পারে, তার একটি অশুভ প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। পৃথিবীর যত খনিজ সম্পদ অতিমাত্রায় আহরণ করা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ জীবাস্ম জ্বালানি তৈল উত্তোলন ও অতিমাত্রায় পোড়ানো হয়েছে, কলকারখানার কার্বন নি:সরণ ও বর্জ্য দিয়ে পরিবেশ দূষণ করা হয়েছে, যে গাছপালা বনভূমি পৃথিবীর ফুসফুস সেই গাছপালা ও বনভূমি কেটে উজার করা হয়েছে, আনবিক চুল্লি থেকে শুরু করে ইটের ভাটা পর্যন্ত সব কিছুই পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর বা গ্রীনহাউজ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করেও পৃথিবীর অনেক স্থানে মরুয়ায়ন করা হয়েছে। মানুষ আরও কত কিছু করেই না এই মায়ের মত ধরিত্রীর ক্ষতি করেছে আর তা করে চলেছে। ঈশ্বরের সকল সৃষ্টির প্রতি মানুষের অবহেলা আর অযত্ন পৃথিবীকে আজ প্রায় ধ্বংশের মুখে ফেলে দিয়েছে। 

তাই এই পৃথিবী যে আমাদের সকল মানুষের অভিন্ন বাসগৃহ সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ২০১৫ খ্রি: পোপ ফ্রান্সিস “লাউদাতো সি’” (তোমার প্রশংসা হোক) নামক একটি সর্বজনীন পত্র লিখেন - যা এই ২০২০ খ্রি: পাঁচ বছর পূর্ণ করেছে। পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও তা সুরক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে পোপ ফ্রান্সিস মে ২০২০ থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত একটি বছর “লাউদাতো সি’” বর্ষ ঘোষণা করেছেন। পোপ ফ্রন্সিস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ঈশ্বর ভালবেসে এই পৃথিবীসহ সকল সৃষ্টিই মানুষকে দিয়েছেন আর মানুষের তত্ত্বাবধানে রেখেছেন তা প্রয়োজনে পরিমিতভাবে ভোগ করতে, উপভোগ করতে আর সেই সাথে তা রক্ষণাবেক্ষণ করতে। আমরা এই পৃথিবী বা ধরিত্রীর মালিক নই, আমরা ঈশ্বরের এই উপহারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক। 

আমরা মানুষেরা এই পৃথিবী ও সৃষ্টির প্রতি যে অবহেলা করেছি আর পরিবেশের যে ক্ষতি করেছি, তা পুষিয়ে নিতে আমরা কি করতে পারি, সেই বিষয়ও আমাদের ভাবতে হবে। সুখের বিষয় এই যে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ু পবির্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে বেশ আগে থেকেই সচেতনতা তৈরী হয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস সেই সচেতনতার রেশ ধরেই পরামর্শ রেখেছেন যেন আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৃষ্টির সুরক্ষায় আরও দায়িত্বশীল আচরণ করি। আর সেই কারণেই আমাদের ভোগবাদী ও বস্তুবাদী মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। 

পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের য ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েছে, এখন আমরা কি করব সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তা আমাদের খুঁজে পেতে হবে। এর জন্য আমরা কিছু কাজ করতে পারি যা আমাদের পক্ষে খুবই সহজ।  লাইদাতো সি বছরে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বসহ বিবেচনা কারতে পারি- গাছপালা লাগাতে পারি, আবর্জনা সঠিক ব্যবস্থাপনা করা যায়, জৈবসার প্রয়োগ করে কৃষি ও পারিবারিক বাগান করতে পারি  এবং নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করতে পারি।  আমরা পৃথিবীকে “সবুজ ও পরিচ্ছন্ন” করতে ও রাখতে পারি। সবুজের জন্য অবশ্যই আমরা যত বেশী সম্ভব গাছপালা লাগাতে পারি ও কৃষিকাজের সম্প্রসারণ করতে পারি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা মানব কল্যানে যে শিল্পকারখানা স্থাপিত হয়েছে, তা চলুক কিন্তু কৃষিকে অবহেলা করে নয়। আমরা যতটা সম্ভব জীবাস্ম জ্বালানী শক্তি কম ব্যবহার করতে পারি আর নবায়নযোগ্য শক্তি (যেমন সৌরশক্তি, বায়ু ও জলশক্তি ব্যবহার করা) ব্যবহার বাড়াতে পারি। যে কোন ভাবেই সম্ভব আমরা যেন ঈশ্বরের সকল সৃষ্টি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের যত্ন নেই সেইটা হল আমাদের ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্ব। আমরা এই দায়িত্বের কথা যত বেশী মনে রাখব ততই আমাদের মানব জাতির জন্য মঙ্গল হবে। আসুন আমরা আমাদের মাতৃস্বরূপা ধরিত্রী, অর্থাৎ আমাদের অভিন্ন বাসগৃহ, এই পৃথিবীর সকল সৃষ্টি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচাই সেই সঙ্গে নিজেরাও বাঁচি। শুধু তাই নয়, আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা একটা সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে পারব। 

সকলের অনেক শুভেচ্ছা রইলো

বিশপ জের্ভাস রোজারিও, রাজশাহীর বিশপ ও চেয়ারম্যান, সিবিসিবি ন্যায় ও শান্তি কমিশন




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন