(সংগৃহীত) ঢাকায় এমন হাজারো শিশুর ঠাঁই রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, স্টেডিয়ামগুলোর আশপাশে। আর্থ-সামাজিক নানা টানাপড়েনে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এই শিশুদেরপরিচয় ‘পথশিশু’।
২০০৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের এক জরিপ বলছে, সারা বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১৩ লাখ।
বাংলাদেশে পথ শিশুর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে মতদ্বৈততা রয়েছে। ২০০৪ সালে বিআইডিএসের জরিপের বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পথশিশু বিষয়ক সেলের প্রধান আবুল হোসেন বলেন, “এই স্টাডি অনেক পুরাতন হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে এবং নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাই পথশিশুদের প্রকৃত সংখ্যা বর্তমানে কত, এটা না জানলে তাদের জন্য বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করা দুরূহ হবে।”
২০০৫ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের শতকরা ৪১ ভাগ পথশিশুর ঘুমানোর বিছানা নেই; ৪০ শতাংশ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না; ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে, ৮৪ শতাংশ শিশুর শীতবস্ত্র নেই; ৫৪ শতাংশ শিশুর অসুস্থতায় দেখার কেউ নেই; ৭৫ শতাংশ পথশিশু অসুস্থতায় ডাক্তার দেখাতে পারে না।
শিশুদের মাদকাসক্তির চিত্রও ভয়াবহ। শিশু অধিকার ফোরামের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৮৫ ভাগ পথশিশু মাদকাসক্ত।
তাদের ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ শিশু ধূমপান, ২৮ শতাংশ নানা ট্যাবলেট, ৮ শতাংশ শিশু ইনজেকশনে আসক্ত।
৮০ শতাংশ শিশু কাজ করে জীবন টিকিয়ে রাখতে; ২০ শতাংশ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়, ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু সার্বিকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
বাংলাদেশ পথশিশুদের নিয়ে কর্মরত ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক-স্ক্যান মহামারীর মধ্যে গত মার্চে রাজধানীর মহাখালী, এয়ারপোর্ট, কমলাপুর, গাবতলী, সদরঘাটসহ আটটি এলাকায় পথশিশুদের জীবনমান নিয়ে একটি জরিপ চালায়। গত ২৬-৩১ মার্চ পর্যন্ত এ জরিপ চলে।
জরিপে পাওয়া তথ্যের প্রসঙ্গে স্ক্যানের সভাপতি জাহাঙ্গীর নাকির বলেন, “জরিপে আমরা পথশিশুদের স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে ভয়াল এক অবস্থা দেখতে পাই। ওরা কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস কী সেটা জানেই না।
“সবাই একসাথেই থাকে, স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। ওরা সারাদিন ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে। ওরা তো করোনাভাইরাসের ক্যারিয়ার হতে পারে।”
স্ক্যানের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, মহামারীতে কর্মসংস্থান হারনো পথশিশুরা অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।বাংলাদেশ জুড়ে পথশিশুদের জীবনমানের যখন এ হাল, তখন নড়েচড়ে বসেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের উদ্যোগে একটি অনলাইন সভায় আসে নানা সুপারিশ।
সে সভায় এক শিশু অধিকারকর্মী জানান, ঢাকা শহরের পথশিশুদের বর্তমান বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে একটি সমীক্ষা পরিচালনায় গুরুত্বারোপ করা হয়।
অনলাইন সভার সুপারিশগুলো হল-
>> করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত, অসহায় শিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
>> গত ২৬ মার্চ লকডাউন শুরুর পর অদ্যাবধি যেসব সেন্টার বা আবাসনে অবস্থানকারী শিশুদের অতিরিক্ত নতুন শিশুর না নেওয়ায় সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
>> বেসরকারি উদ্যোগে তাৎক্ষণিকভাবে পথশিশুদের সামরিক অবস্থান ও খাদ্য সরবরাহের যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে তা ক্রমান্বয়ে নিয়মিত প্রোগ্রামের রূপান্তরের প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।
>> সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পথশিশুদের সহায়তায় যেসব উত্তম চর্চা তাদের সুরক্ষা ও উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা অন্যদের সাথে বিনিময় করতে হবে।
>> ঢাকা শহরের পথশিশুদের বর্তমান বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করতে হবে।
>> কোভিড-১৯, নদী ভাঙ্গন অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ভালনারেবিলিটি শনাক্তকরণের লক্ষ্যে একটি ব্যাপক জরিপ সমীক্ষা পরিচালনা করতে হবে।
>> সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এবং চলমান কর্মসূচির আলোকে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম গঠন করা জরুরি।
>> পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করার জন্য গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
>> পথশিশু সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশু যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ, শারীরিক, যৌন, মাদক, হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে সকলে সতর্ক দৃষ্টি রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
>> পথে অবস্থানকারী শিশুরা যাতে তাদের পিতামাতা অভিভাবক বা পরিবারের ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, “আমরা আগে জরিপের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। জরিপ করলে জানা যাবে শিশুরা কেন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, শিশুরা যখন পরিবার থেকে চলে আসে তখন তারা কিন্তু ভালনারেবল। তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, কেউ শারীরিক বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
“আমরা ইতোমধ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেটি চূড়ান্ত হলে আমরা পথশিশুদের নিয়ে জোরসোরে কাজ শুরু করব।”
তথ্যসূত্র: জয়ন্ত সাহা (নিজস্ব প্রতিবেদক), ৩ নভেম্বর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম