শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম বাংলাদেশ - দিকনির্দেশনা

 ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার্থে ‌"লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম" এ সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ‘বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী’র দিকনির্দেশনা

জগতের আর্তনাদ, দরিদ্রদের আর্তনাদ

'লাউদাতো সি'-"হে আমার প্রভু, তোমার প্রশংসা হোক"। ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন’'নামক পুণ্য দপ্তর এর সাথে একাত্ম হয়ে 'বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী' আগামী সাত বছর "লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম" (২০২১ থেকে ২০২৭ খ্রিস্টাব্দ) শিরোনামে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষা বিষয়ক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়েছে। 'লাউদাতো সি' সর্বজনীন পত্রটির সাতটি লক্ষ্যসমূহ হল- (ক) জগতের আর্তনাদে সাড়াদান, (খ) দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান, (গ) পরিবেশগত অর্থনীতি বিস্তার, (ঘ) টেকসই সহজ-সরল জীবনধারা গ্রহণ, (ঙ) পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক শিক্ষা, (চ) পরিবেশ সংরক্ষণ উদ্দীপ্ত আধ্যাত্মিকতা অনুশীলন এবং (ছ) সমাজকে সম্পৃক্তকরণ ও অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ। সস্প্রতি পোপ ফান্সিস বলেছেন- 'লাউদাতো সি' শুধু সবুজ সর্বজনীন পত্র নয়, বরং এটি একটি সামাজিক সর্বজনীন পত্রও। 

১. ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন' নামক পুণ্য দপ্তর লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য গোটা  মণ্ডলীকে সাতটি কর্মক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে- (ক) পরিবার, (খ) ধর্মপল্লী, (গ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, (ঘ) সংগঠন ও ক্লাব, (ঙ) সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, (চ) হাসপাতাল এবং (ছ) ধর্মসংঘসমূহ ইত্যাদি। এই নির্দেশনা দেশের প্রথম অধিবাসি জীবনধারা অনুধাবন করতে; জগতের আর্তনাদ ও দরিদ্রের আর্তনাদে ঐশতাত্ত্বিক ভিত্তি  অনুধাবন করতে; এবং 'লাউদাতো সি'র লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মৌলিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করছে। সুতরাং বিগত দিন গুলোতে আমরা উন্নয়ন কর্মকাÐসহ আমাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সমন্বিত পরিবেশের যে ক্ষতিসাধন করেছি, তা পুনরুদ্ধারের জন্য আগামী সাত বছর "লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম" এ অবিরত সৃজনশীল উদ্যোগ, কর্মপরিকল্পনা এবং কর্মকৌশল গ্রহণ করবো। 

২. ভাটিকানের পুণ্য দপ্তর ২২-২৯ মে, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ "লাউদাতো সি সপ্তাহ-২০২২" ঘোষণা করেছে এবং মূলসুর হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে "শোনা এবং একসাথে পথচলা" যা পোপ মহোদয়ের আহ্বানে "আমাদের অভিন্ন বসতবাটিকে রক্ষা করতে গোটা মানব পরিবারেেক একত্রিত করবে" (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ-১৩)। এ উদ্যাপনের মূল উদ্দেশ হলো- সর্বজনীন পত্রটির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনা বৃদ্ধি, আমাদের অভিন্ন বসতবাটির যতেœর মৌলিক নীতিসমূহ প্রচার এবং পরিবেশগত রূপান্তরের দিকে একসাথে যাত্রা করা। এ সপ্তাহটি উদ্যাপন বিশ্বকে দেখাবে কাথলিক মণ্ডলীর ২২০,০০০টি ধর্মপল্লীর ১.৩ বিলিয়ন খ্রিস্টভক্তজনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সাত বছরে কতটা পরিবর্তিত হয়েছে এবং সারা বিশ্বের জনগণকে অনুপ্রাণিত করছে। তাই বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী (সিবিসিবি) আগামী সাত বছর "লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম" কার্যক্রমে সকল অংশীজনদেরকে- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, ক্লাব, যুবসংঘ, পালকীয় সেবাকেন্দ্র, সেমিনারি, ছাত্রাবাস, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, হাসপাতাল, এবং সকল ধর্মসংঘ সবাইকে সাথে নিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানাচ্ছে।

৩. সিবিসিবি কমিশনসমূহের সচিব ও সদস্যদের নিয়ে একটি কার্যনির্বাহী "লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম দল" গঠন করা হয়েছে। যারা আগামী সাত বছরের কার্যক্রম নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করবে এবং সকল অংশীজনদের দিক্নির্দেশনা দিয়ে যাবে। এই দলে শিক্ষক, যাজক, ব্রাদার, সিস্টার, যুবক-যুবতী ও আগ্রহী ব্যক্তিদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্কিং প্লাটফর্ম তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডাইয়োসিস পর্যায়েও অনুরূপ একটি সক্রিয় দল গঠন খুবই বাস্তব সম্মত হিসেবে ধারণা করা হয়েছে। কর্মপরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে (ক) আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধিমূলক (Spiritual Events), (খ) জীবনধারা পরিবর্তনমূলক (Action Events) ও (গ) গণমঙ্গল নীতিমালামূলক (Policy Events) ।

৪. সর্বপর্যায়ে ব্যাপকতর সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মে ১৫, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ রবিবার বাংলাদেশ কাথলিক মÐলীর সকল গীর্জায় একযুগে রবিবাসরীয় খ্রিস্টযাগের মাধ্যমে “লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম’ উদ্যাপন উদ্ভোধন করা হবে। এ উপলক্ষে খ্রিস্টযাগ কাঠামো ও উপদেশ সহায়ক তৈরি করে প্রত্যেক ডাইয়োসিসে প্রেরণ করা হয়েছে। সেদিন সকল ডাইয়োসিসে সমস্ত ধর্মপল্লীতে বিশেষ প্রার্থনা, খ্রিস্টযাগ, উপদেশ ও অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। খ্রিস্টযাগ প্রাকৃতিক পরিবেশ, গ্রোটো বা লাউদাতো সি বাগানে আয়োজন করতে পারলে আরও অর্থপূর্ণ হবে। খ্রিস্টযাগের পরে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন- কাপড়ের ব্যাগ বিতরণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশগ্রহণ, ময়লা-আবর্জনা-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কিছু উদ্যোগ  ইত্যাদি।

৫. একই সাথে স্থানীয়ভাবে “লাউদাতো সি সপ্তাহ-২০২২” সক্রিয়ভাবে উদ্যাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়। কাথলিক মণ্ডলী ছাড়াও অন্যান্য মণ্ডলীকে উৎসাহিত করা হবে যেন নিজেদের আয়োজনে “লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম” কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। আগামী মে ১৫ থেকে ২৯, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ মধ্যে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, আন্তঃমাণ্ডলিক , আন্তঃধর্মীয়, পরিবেশবিদ, পরিবেশ সংরক্ষণকর্মী ও সংগঠনের অংশীজনদের উপস্থিতিতে "Sharing the Good Practices"  আলোচনা সভা আয়োজন করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। আলোচনার অনুধ্যান ও অনুধাবন লিপিবদ্ধ করে পরবর্তী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ সহায়ক হতে পারে। সিবিসিবি পর্যায়েও একটি আলোচনা সভা আয়োজন করতে যাচ্ছে।

৬. পৃথিবী নামক গ্রহটির যে-অবনতি ঘটছে তা ব্যক্তিগতভাবে ও দলগতভাবে নিজের জন্য বেদনায়ক কষ্ট বলে অনুভব করা এবং আমরা প্রত্যেকে এ বিষয়ে কী করতে পারি তা আবিষ্কার করতে একটি আন্তরিক “পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক মন পরিবর্তন’ এর সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। পোপ ফ্রান্সিস সৃষ্টির বিরুদ্ধে আমাদের পাপ স্বীকার করার আহ্বান ও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন- কারণ আমরা সবাই পরিবেশের কমবেশি ক্ষতিসাধন করেছি। ঈশ্বরের সৃষ্টির জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করেছি, আবাহাওয়া পরিবর্তন করেছি, বনজঙ্গল ধ্বংস করেছি, জলাভূমির পবিত্রতা বিনষ্ট করেছি, জমিজমা, বাতাস ও জীবন ধ্বংস করেছি- এসবই পাপ। কেননা প্রাকৃতিক জগতের বিরুদ্ধে পাপ করার অর্থ আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে পাপ করা এবং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করা (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ-৮)।

৭. ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর এবং পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীর ‘একজন খ্রিস্টভক্ত, একটি বৃক্ষরোপণ’ উদ্যোগটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে, আরও প্রস্তাব করেছেন- বর্তমানে কার্বন নিঃসরণ কমানো উদ্যোগটি গ্রহণ বাস্তবসম্মত। বিভিন্ন ডাইয়োসিসে ধর্মপল্লী ও প্রতিষ্ঠানসমূহর পাশাপাশি বিসিএসএম, যুবসংগঠন, ক্লাব ও ক্রেডিট ইউনিয়নের অংশগ্রহণ খুবই উজ্জ¦ল ছিল। সুতরাং বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমে বাস্তবে কী হয়েছে, কী অবস্থায় আছে, কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা ডাইয়োসিস পর্যায়ে ফিরে দেখা দরকার। একটি প্রতিবেদনও তৈরি করা প্রয়োজন।

৮. জাতীয় ও ডাইয়োসিস পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক সংলাপ ও ফোরাম আয়োজন করার তাগিদ অনুভব করা হয়েছে। যেখানে আন্তঃধর্মীয়, আন্তঃমাণ্ডলিক, বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান যেমন- ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), হিন্দু-বোদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চার্চসমূহ এবং আরো পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনের অংশগ্রহণ থাকতে পারে। পরিবেশবিদ ও পরিবেশ সংরক্ষণকর্মীদের সাথে নেটওয়ার্কিংএ যোগদান করা- যেমন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), আদিবাসী  ফোরাম বাংলাদেশ, কারিতাস, ওয়ার্ল্ড ভিশন এবং আঞ্চলিক পর্যায়ের আরো সংগঠনের সাথে জড়িত থাকা। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং চলমান রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন- The Dicastery for Promoting Integral Human Development-Vatican, Migration and Refugee Section-Vatican, The Federation of Asian Bishops’ Conferences (FABC –OHD-CCD), The River Above Asia Oceania Ecclesial Network (Raoen), Laudato Si Movement, International Catholic Migration Commission (ICMC), Asia Pacific Justice and Peace Worker Network (APJP WN), Talitha Kum Vatican and Talitha kum Asia.

৯. কাথলিক শিক্ষা বোর্ডের সহযোগিতায় কাথলিক স্কুলসমূহকে কেন্দ্র করে অন্যান্য স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলী ও ছাত্র-ছাত্রীদের এ বিষয়ে ব্যাপকতর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করা যায়। পোষ্টার তৈরী, ডকুমেন্টরি তৈরী, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা ও র‌্যালী আয়োজনে যুবক-যুবতী ও ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পৃক্ত করা যায়।  কারিতাসের ট্রাস্ট- কারিতাস ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (সিডিআই) কর্তৃক ‘লাউদাতো সি’ পত্রটির আলোকে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক’ একটি সংক্ষিপ্ত মডিউল তৈরি যায়। তাদের আয়োজিত প্রশিক্ষণসমূহে বিষয়টি সংযুক্ত করতে পারে এবং আলাদা একটি প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

১০. বিশ্বজগতের মা মারীয়া তিনি দীনদরিদ্রদের কষ্টে ও ক্ষতবিক্ষত জগতের সকল প্রাণীর জন্য দুঃখশোকে কাতর। তাঁর নিকট সবিনয় প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে প্রজ্ঞার দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে দেখার শক্তি দেন। পবিত্র পরিবার ও বিশ্বজনীন মÐলীর রক্ষাকর্তা সাধু যোসেফ আামদের শেখাতে পারেন- কিভাবে সেবাযতœ দিতে হয় এবং বসতবাটি রক্ষা করার জন্য কিভাবে উদারভাবে পরিশ্রম করতে হয়। যীশু বলেন- “আমি এখন সব-কিছুই নতুন ক’রে তুলছি” (প্রত্যাদেশ ২১:৫)। এই গ্রহটির জন্য আমাদের ভাবনা-চিন্তা যেন আমাদের প্রত্যাশার আনন্দ বিনষ্ট করতে না পারে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের মাঝে নিত্য উপস্থিত, কখনো পরিত্যাগ করেন না, একা ফেলে রেখে যান না। এই পৃথিবীতে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন নতুন পথ ও পন্থা খুঁজে পাওয়ার জন্য তিনিই প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দান করছেন, আসুন ধ্যান-প্রার্থনায় তা শুনি ও এখনই কাজে সক্রিয় হই (লাউদাতো সি ২৪৩-২৪৫)। আমরা পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে দায়বদ্ধতা স্বীকার করি; দায়বদ্ধতার ভিত্তি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার ওপর সৃদৃঢ় বিশ্বাস ও কৃতজ্ঞতা। 

ইতোমধ্যে অনেক ব্যক্তি, ডাইয়োসিস, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মসংঘ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করছেন। আমাদের অর্জনসমূহ সমবেতভাবে সহভাগিতা করার পরিবেশ তৈরীর উদ্দেশ্যে ‘লাউদাতো সি সপ্তাহ-২০২২’ এর মূলভাবটি “শোনা এবং সাথে পথচলা” খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যার যার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক সেবাকাজ আরো গতি পাবে। সত্যিকার অর্থেই ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডি ত্যাগ করে সুপরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একসাথে কাজ করা অধিকতর কল্যাণকর হবে। অন্যথায় মাশুল দিতে হবে আগে না হোক অদূর ভবিষ্যতে। আমরা বিশ্বাস করি পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ মহান কিছু অর্জন সম্ভব হবে। ধরিত্রীর বুকে আনবে নতুন ছন্দ, জাগাবে নতুন আশা। আসুন, একসাথে, একত্রে ‘লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম’ উদ্যোগে আগামী ৭ বছর নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাসমূহ অবিরত চালিয়ে যাই; ‘আমরা সবুজ, আমরা সুন্দর’ থাকি; আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ সুন্দর নির্মল পৃথিবী গড়ে তুলি। তাঁর প্রশংসা ও মহিমা হোক - লাউদাতো সি!


বিশপ জের্ভাস রোজারিও ডিডি, সভাপতি, ন্যায় ও শান্তি কমিশন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী

ফাদার লিটন হিউবার্ট গমেজ, সিএসসি , সেক্রেটারি, ন্যায় ও শান্তি কমিশন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী




বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২১

লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম এর ঘোষণাপত্র

 প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার্থে ‍"লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম" এ সক্রিয় হওয়ার আহ্বানে বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর ন্যায় ও শান্তি কমিশনের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ২০২১ খ্রিস্টাব্দ 

জগতের আর্তনাদ, দরিদ্রদের আর্তনাদ

বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর ন্যায় ও শান্তি কমিশনের ঘোষণাপত্রটি গভীরভাবে অনুভব করছে- জগতের আর্তনাদ ও দরিদ্রদের আর্তনাদ যা নিশ্চিত করে যে, "আমােেদর সকল মানুষের হৃদয়, মন এবং আচরণে ব্যাপক  পরিবর্তন দরকার"। এতে ধর্মগ্রন্থ, ধর্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, কাথলিক মণ্ডলীর সামাজিক শিক্ষা, জগতের প্রজ্ঞা এবং কোন দেশের প্রথম অধিবাসীদের জীবনধারা অনুধাবন করা হয়েছে। ঘোষনাপত্রটি ঐশতত্ত্বের অন্তর্নিহিত শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সুবিধাবঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া ক্ষতিগ্রস্থ আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের প্রতি সাড়া দিয়ে সৃষ্টির যত্ন নেওয়ার প্রচেষ্টাকে অনুপ্রাণিত করছে। ঘোষণাপত্রটি ত্রি-ব্যক্তি পরমেশ্বরের সৃষ্টির রহস্য অনুধান; সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর পবিত্রতা; মননশীল দৃষ্টিতে সৃষ্টির বিস্ময় ও সৌন্দর্য উপলব্ধি এবং জীবনের রূপান্তর ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করছে। 

ঘোষণাপত্রটিতে ন্যায় ও শান্তি কমিশন বাংলাদেশ বিশপ সম্মিলনীর পক্ষে বাংলাদেশের সকল খ্রিস্টভক্তজনগণকে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস -এর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে 'লাউদাতো সি' পত্রটির মৌলিক সাতটি লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়ে সমন্বিত পরিবেশগত টেকসই উন্নয়নের দিকে আগামী সাত বছর "লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম" (২০২১ থেকে ২০২৭ খ্রিস্টাব্দ) যাত্রায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। 'লাউদাতো সি' পত্রটির সাতটি লক্ষ্যসমূহ হল- (১) জগতের আর্তনাদে সাড়াদান, (২) দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান, (৩) পরিবেশগত অর্থনীতি বিস্তার, (৪) টেকসই সহজ-সরল জীবনধারা গ্রহণ, (৫) পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক শিক্ষা, (৬) পরিবেশ সংরক্ষণ উদ্দীপ্ত আধ্যাত্মিকতা অনুশীলন এবং (৭)  সমাজকে সম্পৃক্তকরণ ও অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ। সস্প্রতি পোপ মহোদয় বলেছেন- 'লাউদাতো সি’ শুধু সবুজ প্রৈরিতিক পত্র নয়, বরং একটি সামাজিক প্রৈরিতিক পত্রও।'

লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন' নামক পুণ্য দপ্তরের নির্দেশনায় গোটা মÐলীকে সাতটি কর্মক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- (১) পরিবার, (২) ধর্মপল্লী, (৩) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, (৪) সংগঠন ও ক্লাব, (৫) সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, (৬) হাসপাতাল এবং (৭) ধর্মসংঘসমূহ ইত্যাদি। এই নির্দেশনা দেশের প্রথম আধিবাসীদের জীবনধারা অনুধাবন করতে; জগতের আর্তনাদ ও দরিদ্রের আর্তনাদে ঐশতাত্ত্বিক ভিত্তি অনুধাবন করতে; এবং 'লাউদাতো সি'র লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মৌলিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করছে। সুতরাং বিগত দিন ধরে আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ আমাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সমন্বিত পরিবেশের যে ক্ষতি করেছি, তা পুনরুদ্ধারের জন্য আগামী সাত বছর ধরে অবিরত কর্মসূচি গ্রহণ করবো। 

ঘোষণাপত্রটিতে ন্যায় ও শান্তি কমিশন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় সুপারিশ করছে- প্রথমতঃ আমাদের কর্মকাণ্ডের দ্বারা মানব পরিবার ও আমাদের অভিন্ন বসতবাটির যে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছি তা অকপটে স্বীকার করে অকৃতিম অনুতাপ ও মরপরিবর্তন একান্ত প্রয়োজন; দ্বিতীয়তঃ প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় ছোটখাট আদান-প্রদানের গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ-সংক্রান্ত বাস্তবতার অবনতি রোধকল্পে বৃহত্তর কর্মপন্থা আবিষ্কার করা যেখানে সমাজের প্রচলিত 'ছুঁড়ে ফেলার সংস্কৃতির' পরিবর্তে 'যত্নবান হওয়ার সংস্কৃতির' দিকে যাত্রা করতে হবে। 'একজন খ্রিস্টভক্ত, একটি বৃক্ষরোপণ' উদ্যোগটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে, বর্তমানে কার্বন নিঃসরণ কমানো উদ্যোগটি গ্রহণ বাস্তবসম্মত। একটি ইতিবাচক মনোভাব অন্তরে নিয়ে 'ভালবাসার সভ্যতাকে' আর্দশ করে- সবাই ভাইবোন মনোভাব লালন, সহজ-সরল জীবনধারা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ, পরিবেশ সংরক্ষণ উদ্দীপ্ত উপাসনা, ক্রেডিট ইউনিয়নসমূহে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আদিবনভূমি সংরক্ষণ, আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, পরিমিত পরিবেশন ও ভোগ, অপচয়রোধ, ঋণ পরিশোধ, জৈবসুরক্ষা, বাগান করা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, প্রয়োজন মাফিক কেনাকাটা, প্লাস্টিক ব্যবহার হ্রাস, পলিথিন বর্জন, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ পরিমিত ব্যবহার, সকল প্রকার দুষণ হ্রাস, পাট ও মোটা কাপড়ের ব্যাগ প্রচলন, শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রী ও ধর্মীয় শিক্ষকদের মাধ্যমে পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা সেমিনার বিস্তার, প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক পুস্তিকা প্রস্তুত, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র ব্যবহার, ক্ষুদ্র সমাজভিত্তিক কর্মপরিল্পনা গ্রহণ, জলবায়ু বিপর্যয়ে বাস্তুচ্যুত অভিবাসী-শরণার্থীদের গ্রহণ, মানবপাচারের শিকার ঝুঁকিপূর্ণ মানুষজনের প্রতি মনোযোগ, নৈতিক বিনিয়োগ ও নবীকরণযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ এবং লাউদাতো সি নেটওয়ার্কে যোগদান ইত্যাদি।

প্রথম বছর (২০২১ খ্রিস্টাব্দ) নিজ নিজ অবস্থানে পরিকল্পনা গ্রহণের কাল, দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ বছর (২০২২ থেকে ২০২৬ খ্রিস্টাব্দ) হল কর্মসম্পাদন কাল এবং সপ্তম বছর (২০২৭ খ্রিস্টাব্দ) হবে সৃষ্টি উদ্যাপন কাল। জগতের আর্তনাদ ও দরিদ্রের আর্তনাদ সাড়াদানের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাসমূহ আমাদের সামনে মোট সাত বছরের যাত্রা জুড়ে একটি কার্যকর শক্তি ও অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে। আপনার ও আপনাদের প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকার অগ্রগতিসাধনের 'লাউদাতো সি'র লক্ষ্যভিত্তিক মৌলিক কার্যকর পদক্ষেপসমূহ ব্যাপকভাবে প্রশংসা করা হবে। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের আহ্বানে  "লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম" পালন সফল হউক, সার্থক হউক।


ফা. লিটন হিউবার্ট গমেজ, সিএসসি

           সেক্রেটারি

এবং বিশপ জের্ভাস রোজারিও ডিডি

           সভাপতি

ন্যায় ও শান্তি কমিশন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী




শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১

সৃষ্টি উদযাপন কাল - ২০২১: আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার

সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, তোমার প্রশংসা হোক। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার্থে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালন করতে আহ্বান করেছেন। এই কালটির একটি বিশেষ তাৎপর্য হল ১ সেপ্টেম্বর (বুধবার) 'সৃষ্টির সেবাযত্নে বিশ্ব প্রার্থনা দিবস' পালনের মাধ্যমে শুরু হবে এবং ৪ অক্টোবর 'আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের পর্ব দিবস' উদযাপনের মাধ্যমে সমাপ্তি হবে। এবছর প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে 'আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' গ্রহণ করা হয়েছে। 

'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালনের একটি বিশিষ্ট সর্বজনীন অনু্প্রেরণা মাত্রা রয়েছে। এসময়ে আমরা পিছনে ফিরে তাকাই এবং  ধন্যবাদ জানাই প্যাট্রিয়ার্ক প্রথম দিমিট্রিওসকে যিনি ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে  বিশ্বের সকল পরিবার একত্রে আমাদের অভিন্ন বসতবাটির যত্ন ও সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা ও বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণের একটি মাস উদযাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন থেকে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' ও সর্বজনীন প্রেরণা সকলের মধ্যে বিদ্যমান বয়েছে। সকল পরিবারকে একত্রে সৃষ্টির জন্য প্রার্থনা, সৃষ্টির সেবাযত্ন বিষয়ক অনুধ্যান ও সৃষ্টি রক্ষণাবেক্ষণের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে একসাথে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' অর্থপূর্ণ করতে আহ্বান করেছেন। ধমৃগুরু পোপ ফ্রান্সিস গুরুত্বের সাথে জরুরীভিত্তিতে সৃষ্টির সঙ্গে ও একে অপরের সাথে সর্ম্পকের নিরাময় করতে বিশ্ব পরিবারকে উৎসাহিত করছেন এবং সকলকে একইভাবে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান করছেন "কেননা আমরা জানি যে, পরিবর্তন সম্ভব" (লাউদাতো সি, অনু. ১৩)।

ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন' নামক পুণ্য দপ্তর পুুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের আহ্বানকে সফলতা দান করতে আগামী ৭ বছর (২০২১-২০২৭ খ্রিস্টাব্দ) সময়কে 'লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম' ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে এবছর থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে ধরিত্রীর বাস্তুতন্ত্র অর্থাৎ ‘প্রকৃতি-পরিবেশ পুনরুদ্ধার দশক’ (২০২১-২০৩০ খ্রিস্টাব্দ) কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসময় জনগণ আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সম্মিলনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একটি আগামী অক্টোবর ১১-২৪ তারিখে চীনে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত 'জীববৈচিত্র্য বিষয়ক শীর্ষ-বৈঠক' ‘কপ-১৫’ (COP15); অপরটি আগামী নভেম্বর ১-১২ তারিখে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘ আয়োজিত 'জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক শীর্ষ-বৈঠক' ‘কপ-২৬’ (COP26)। ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর আশা করছে খ্রিস্টভক্তগণ প্রকাশ্যভাবে 'অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' বিষয়টি শীর্ষ-বৈঠকসমূহে নিজেদের মতামত জোড়ালোভাবে ব্যক্ত করবে। এ জন্য ‘সুস্থ ধরিত্রী, সুস্থ জনগণ আবেদন’ (Healthy Planet, Healthy People Petition) সংযুক্ত পত্রে স্বাক্ষর সংগ্রহে ‘লাউদাতো সি মূভম্যানট’ ও জোটসমূহ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, যা হবে আমাদের 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালনের একটি অন্যতম পদক্ষেপ। 

এসময়ে ‘লাউদাতো সি’ সর্বজনীন পত্রটির ৭টি লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায় করা হবে। লক্ষ্যসমূহ হল- জগতের আর্তনাদে সাড়াদান, দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান, পরিবেশগত অর্থনীতি বিস্তার, সহজ-সরল জীবনধারা, পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক শিক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ উদ্দীপ্ত আধ্যাত্মিকতা এবং সমাজকে সম্পৃক্তকরণ ও অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি। লক্ষ্য অর্জনের জন্য  গোটা মণ্ডলীকে সাতটি কর্মক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- পরিবার, ধর্মপল্লী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ক্লাবসমূহ, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় সংঘসমূহ ইত্যাদি। করোনাভাইরাস শিখিয়েছে মানুষ সচেতন হয়ে ‘স্বভাব’ পালটাতে পারলে পরিবর্তন সম্ভব।  আমাদের অভিন্ন বসতবাটির অবনতির বিষয়টি আমাদের জীবনধারা পরিবর্তন করার দাবি জানায় ফলে মানব পরিবারের আচরণে আমূল পরির্তনের জরুরি প্রয়োজন (লাউদাতো সি, অনু. ২০৬, ৪)। 

কাথলিক মণ্ডলী ও কারিতাস একত্রে ৭ লাখ বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিগত বছর ব্যক্তিগত ও সমবেত উদ্যোগে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী ও প্রাপ্তবয়স্ক অনেকে সৃষ্টির সেবাযত্নে নিয়মিত প্রার্থনা, ভার্চুয়াল সভা-সেমিনার, লেখালেখি, বন ও বসতবাটি রক্ষণাবেক্ষণে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন (বিশেষভাবে ময়মনসিংহ ও সিলেট), বৃক্ষরোপণ, করোনাভাইরাস মহামারীতে দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান, নিজ নিজ বসতবাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাগান করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ, আবর্জনা সঠিক ব্যবস্থাপনা, দূষণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা, ব্যয় সংকোচন, ঋণ পরিশোধ এবং জৈবসুরক্ষাসহ বহুবিধ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে কেউ কেউ সহভাগিতা করেছেন। আমাদের অভিন্ন বসতবাটির সেবাযতত্ন ও ফলপ্রসূতা নিশ্চিত করতে বিগত দিনগুলোতে আপনাদের বহুবিধ সৃজনশীল উদ্ভাবন উদ্যোগ ও উপায়ের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর আশা করছে পোপ ফ্রান্সিস এর আহ্বানে প্রতিটি ডাইয়োসিস ও ধর্মপল্লী বহুবিধ সৃজনশীল উদ্ভাবন  উদ্যোগ চলমান রাখবে-

১. সেপ্টেম্বর ১ তারিখ বুধবার ‘সৃষ্টির সেবাযযত্নে বিশ্ব প্রার্থনা দিবস’ এবং 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' (১ সেপ্টেম্বর - ৪ অক্টোবর) সৃষ্টি জন্য  প্রার্থনা করতে পারি। এই প্রার্থনা পরিবার, ক্ষুদ্র দল, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মপল্লী, ধর্মব্রতীদের গৃহ, সেমিনারি,  সংগঠন এবং সর্বজনীন হতে পারে;

২. যাজকগণ প্রতিটি ধর্মপল্লীতে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' এর প্রতি রবিবার দিন (সেপ্টেম্বর ৫, ১২, ১৯, ২৬, অক্টোবর ৩ এবং ৪ আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের পর্ব দিবস) পবিত্র খ্রিস্টযাগের উপদেশে বিশেষ সহভাগিতা (‘আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার’) করতে পারেন;  

৩. আমাদের সবারই করণীয় আছে- নিজের ঘরের বাতিটা অকারণে না জ্বালানো, গাড়ি কম চালানো, অযথা মোটরসাইকেল না চালানো, গাছ লাগানো, বাগান করা, সৃষ্টির যত্ন নেয়া, পানি পরিমিত ব্যবহার করা, অযথা বিকট শব্দ না করা, নির্মল বায়ু সেবন করা, দূষণ বা নোংরামী থেকে বিরত থাকা ও জৈবসুরক্ষার মতো কাজগুলো সকলেই করতে পারি; 

৪. ক্ষুদ্র দলে সভা, সেমিনার, কর্মশালা ও তৃণমূল পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষার্থে বিভিন্ন কর্মসূচী- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গাছ লাগানোর অভিযান, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন, পরিবেশ বিষয়ক লেখালেখি বা পাঠ করা;

৫. সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- ’লাউদাতো সি’ পত্রটি কেবল ‘সবুজ প্রৈরিতিক পত্র নয়’ (green Encyclical) বরং একটি ‘সামাজিক প্রৈরিতিক পত্রও’ (social Encyclical)। তাই অশান্তি, কোন্দল, অন্যায্যতার মত বিভিন্ন নোংরামী নিরসন ও সংলাপ এবং দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদানে বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করা যায়;

৬. শীর্ষ-বৈঠক (কপ-১৫ ও কপ-২৬) দু’টিতে নিজেদের মতামত জোড়ালোভাবে ব্যক্ত করতে ‘সুস্থ ধরিত্রী, সুস্থ জনগণ আবেদন’ সংযুক্ত  পত্রে স্বাক্ষর প্রদানে মাধ্যমে শীর্ষ-বৈঠকসমূহে অবদান রাখতে পারি (Link: Healthy Planet, Healthy People Petition, Sign the petition);

৭. খ্রিস্টবিশ্বাসী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের হয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে প্রাবক্তিক ভূমিকা পালন করা এবং তাদের পক্ষে অ্যাডভোকেসি করা। আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের গণ-উদ্যোগসমূহকে জোরদার ও ইতিবাচকভাবে গণমাধ্যমসমূহে প্রচার, প্রকাশ ও সার্বিক সহযোগিতা করা দরকার। 

আমাদের এই ধরিত্রী কারও একার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, ধরিত্রী মূলত একটি যৌথ উত্তরাধিকার, যার সুফল ভোগ করার অধিকার সবারই আছে (লাউদাতো সি, অনু. ৯৩)। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এক বার্তায় জোর দিয়ে বলেছেন- ‌"আসুন, একসাথে কাজ করি, কেবলমাত্র আমরা এইভাবেই আমাদের ভবিষ্যতে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ ও টেকসই ধরিত্রী গড়তে সক্ষম হবো, এটাই আমাদের আশা। আসুন, আমরা আমাদের মাতৃভূমির যত্ন নিতে এগিয়ে আসি; ... আসুন, পৃথিবী এবং সৃষ্টির উপহারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই; আসুন, আমরা এমন একটি জীবনযাত্রা এবং এমন একটি সমাজের উদ্বোধন করি যা শেষ পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব ও  টেকসই পরিবেশ হয়। সবার জন্য আরও একটি সুন্দর ভবিষ্যত উপহার দিতে আমাদের সুযোগ রয়েছে। পিতা ঈশ্বরের নিকট থেকে আমরা একটি সুন্দর বাগান পেয়েছি, আমাদের  সন্তানদের জন্য আমরা একটি মরুভূমি রেখে যেতে পারি না।" আসুন, দায়িত্বপ্রাপ্ত ও নিবেদিতপ্রাণ অংশীজন হিসেবে বহুবিদ ও বিচিত্র সৃজনশীল উদ্ভাবন উদ্যোগ ও উপায়ে সৃষ্টিকর্তার অমূল্যদান 'আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' করতে অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।




বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১

সমৃদ্ধ জীবনের আশা নিয়ে জীবনযাপন

সহজ-সরল অনাড়ম্বর অথচ সমৃদ্ধজীবনযাত্রা অনুশীলনের কিছু দিক হলো যেখানে আমরা অল্প নিয়েই তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকতে, যে সুযোগ-সুবিধা আসে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে, যা সহায়-সম্বল আছে তার প্রতি অনাসক্ত হতে এবং যা নেই তার জন্য দুঃখ ও বেদনাবোধ পোষণ না করতে শেখা (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২২২)। সহজ-সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে সমৃদ্ধজীবন গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কিছু কিছু বিষয়ে সচেতনতা নবায়ন করতে পারি; যা এখানে আলোচনা করা হয়েছে। 

১. পরিবারই জীবন-সংস্কৃতির প্রাণ- আমি যেখানে বসবাস করছি সেটা একটি পরিবার; আমাদের পরিবার হল সৃষ্টি ও প্রকৃতির একটি অংশ; পরিবারের আরো বেশী য্ত্ন নিব। পরিবার জীবন-সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের নিকট ঈশ্বরের মহামূল্যবান দান; এখানেই আমরা সমাদৃত হতে পারি, এখানেই আমরা সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি এবং এখানেই আমাদের মানবিক বৈশিষ্ট্য বিকশিত হতে পারে। পরিবারেই আমরা শিক্ষা পাই কিভাবে ভালবাসতে হয়, কিভাবে ভালবাসা পেতে হয়, কিভাবে জীবনকে শ্রদ্ধা করতে হয়, কিভাবে জিনিসপত্র মর্যাদার সাথে ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে নিয়ম-শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতা পালন করতে হয় এবং কিভাবে প্রকৃতি, প্রতিবেশীর ও দীনদরিদ্রদের প্রতি যত্নবান হতে হয়। পরিবারে একত্রে খাবারের সময়, অবসর সময়, বিনোদনের সময়, প্রার্থনার সময়, প্রকৃতিতে ঘুরাঘুরির সময়টুকু স্কুলের এক একটি পাঠদানকক্ষের মতই আমরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ রস আহরণ করি; তারপর অবিরত সমাজকেই ফলদান করি (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২১৩)। এখানেই আমরা অভিজ্ঞতা করি একার মধ্যে ঐক্য নেই, বহুকে নিয়ে সত্য ঐক্য সৃষ্টি হয়।

২. মিতব্যয়িতা ও স্বল্প নিয়ে সুখী হওয়া- স্বল্পতে সুখী হওয়াই হচ্ছে খ্রিষ্টীয় আধ্যাত্মিকতার বৈশিষ্ট্য; আমাদের আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মবেষ্টিত অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে  সকলের মঙ্গল চিন্তার অকৃত্রিম চেতনা বিস্তার করতে হবে। তাই সম্পদ ও কর্তৃত্বের বাহাদুরী এবং উদ্দেশ্যবিহীন আমোদ-প্রমোদ বর্জন করা, প্রয়োজন অতিরিক্ত খরচপাতি বর্জন করা, জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার রোধ করা, ভোজনবিলাস ও অতি ভোগের মানসিকতা ত্যাগ করে জীবনকে আনন্দপূর্ণ করে গড়তে পারি। একেবারে রিক্ততা জীবনের জন্য বেদনাদায়ক, আবার বহুলতায় সত্যিকারে আনন্দ হারিয়ে যায় কিন্তু বৈচিত্র্যের মাঝে জীবনের মূল ভাবটি খুঁজে পাওয়াই সুন্দরতম দিক।

৩. অপচয়রোধ ও ঋণ পরিশোধ- বর্তমান চরম ভোগবাদ বর্জন করে নিষ্প্রয়োজন বেঁচা-কেনার ঘূর্ণাবর্তে ফেঁসে না গিয়ে প্রয়োজন মাফিক কেনাকাটা পরিহার করে, যতটুকু প্রয়োজন শুধু ততটুকু খাবার রান্না ও পরিমিত ভোগ করে; প্রয়োজন অতিরিক্ত খরচপাতি বর্জন করে, জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার না করে, ভোজনবিলাস ও অতি ভোগের মানসিকতা বর্জন করে; বাড়িতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিভিশন, এসি, পানির কল, বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহারের পর বন্ধ রাখার সচেতনতার মধ্যমে ও অন্যকে সচেতন করে জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারি। ক্রেডিট ইউনিয়নসহ সকল প্রকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ঋণ গ্রহণ করে বিনোদন বা উৎসব অথবা বিনোমূলক ভ্রমন আয়োজন থেকে বিরত থাকে কষ্টার্জিত অর্থ অপচয়রোধ করতে পারি।

৪. যত্নবান হওয়ার সংস্কৃতি অনুশীলন- আমাদের নিজের স্বার্থপর গণ্ডি অতিক্রম ক’রে অপরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় এখনই। আমরা যদি সৃষ্টজীবের প্রতি প্রকৃত মর্যাদার স্বীকৃতি দেই, অপরের কল্যাণের কথা ভাবি, জীবনপত্রের প্রতি যত্নবান হই, অপরের দুঃখকষ্ট নিবারণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করি, আশেপাশের পরিবেশের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনার পূর্বেই রক্ষা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করি তখন আমাদের মর্যাদার স্বীকৃতি আমরা পাব। নিজের দেহ থেকে শুরু করে জামাকাপড়, ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, সমাবেশস্থল প্রভৃতির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা; সমন্বিত পরিবেশ সংক্রান্ত অবনতি রোধকল্পে সমাজ উপকৃত হবে এমন ‘যত্নবান হওয়ার সংস্কৃতি’ অনুশীলন করতে পারি। যদি আমরা আমাদের ভাইবোনদের জন্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের যত্নবান হতে ইচ্ছা করি তবে অপরের জন্য নিঃস্বার্থ দরদবোধ থাকা এবং সব ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মমগ্নতা প্রত্যাখ্যান করা একান্তই অপরিহার্য (অনুুরূপ-লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ  - ২০৮)।

৫. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ- ভোক্তাদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ থাকাটা কত প্রয়োজন তা বর্তমান অতি উৎপাদিত ও ভোগ্যপণ্যে ক্ষতিকারক রাসায়ানিক ব্যবহার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশনা থেকে সহজে অনুমান করা যায়। ক্রয়-বিক্রয় ও ভোগের সঙ্গে নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ সব সময়ই জড়িত থাকে। শাকসবজি, ফুল ও ফলের বাগান করা এবং খাবার হিসেবে ব্যবহার করা; প্রকৃতিজাত, বিশুদ্ধ ও সুষম খাদ্য আহার ও পানীয় পান করা; মাংস গ্রহণ পরিমিত করা, পরিমিত পরিবেশন ও পরিমিত ভোগ, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খাবারই রান্না করা, দেশীপণ্য ব্যবহার দিন দিন বাড়াতে পারি ফলে ভোক্ত হিসেবে নৈতিক আচরণ প্রকাশ করে জীবন সমৃদ্ধ করতে পারি। 

৬. দূষণমুক্ত পরিবেশ- একমাত্র অকপট গুণাবলীর চর্চা এবং অনুশীলন নিশ্চিত করতে পারলে সকলে নিঃস্বার্থভাবে পরিবেশ সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করতে প্রস্তুত থাকবে। তখনই শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, জল অম্লীকরণসহ সকল প্রকার দূষণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে। কিছু কিছু অভ্যাস নিজে আয়ত্ত করা এবং অন্যকে অভ্যস্থ হতে উৎসাহিত করা; যেমন- যেখানে সম্ভব যতটুকু সম্ভব হেঁটে চলাচলের অভ্যাস করা, সাইকেল ব্যবহার করা, দলগতভাবে গাড়ি ব্যবহার  করা, গণপরিহন ব্যবহার করা, পরিবহণের দূষণকারী কর্মক্রিয়া বর্জন করা, নিয়মিত তাপবর্ধক যন্ত্রটি কম ব্যবহার করে গরম কাপড় পরার অভ্যাস করা, টেকসই ও দেশীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা, প্লাস্টিক ও কাগজ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা, পানির ব্যবহার কমানো ও অপচয় করার অভ্যাস ত্যাগ করা, বর্জ পৃথক করা, নিষ্প্রয়োজন বাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া; খাদ্যসামগ্রী রান্না বা গরম করার সময় ব্যবহৃত জ্বালানির ধোঁয়া অত্যাধিক পরিমাণে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করার ফলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে এ বিষয়ে সচেতন থেকে কম সময় ধরে ব্যবহার করা; কীটনাশক, সার, ছত্রাকনাশক, উদ্ভিদনাশক এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিষাক্ত দ্রব্য যা মাটি ও পানির অম্লীকরণের করে তা পরিহার করে এবং এ ধরণের অন্যান্য অনেক দিকে সচেতন হওয়া ও অন্যকে সচেতন হতে সহায়তা করা। এসব কিছুর মধ্যে প্রতিফলিত হয় উদার ও মর্যাদাসম্পন্ন সৃজনশীলতা এবং যার মাধ্যমে মনুষ্যত্বেও শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রকাশ ঘটে (অনুরূপ- লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২১১)।

৭. চারটি ‘পি’ (Four P’s)- ‘লাউদাতো সি’ পত্রটির নিবিড় সমন্বয় ও কার্যকরী সাড়াদানের ক্ষেত্রে চারটি ‘পি’ (Four P’s) অনুধ্যানে করণীয়সমূহ স্মরণ করতে পারি- plant বা গাছ-গাছড়া লাগানো, pray প্রার্থনা করা, protect বা রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও promote বা সংবর্ধিত করা অর্থাৎ ‘লাউদাতো সি’র মাণ্ডলিক  শিক্ষা সকলের নিকট প্রকাশ ও প্রচার করা যায়।

৮. সত্য মতকে সত্যরূপে গ্রহণ- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিত্তিহীন গুজব ও ‘মতের অরণ্য’ এ হারিয়ে না গিয়ে বরং বেরিয়ে এসে মূলধারার গণমাধ্যমের উপর নির্ভর হওয়া যেন যথার্থ আনন্দ, গভীর তৃপ্তি, প্রকৃত সত্য আহরণ করা যায়। ব্যক্তিগতভাবে এবছর কমপক্ষে দুইটি বই পড়ার অঙ্গীকার করা; চলমান বিষয় সংক্রান্ত পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের গ্রাহক হয়ে পাঠ করা; সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ক একটি শিক্ষা সেমিনারে অংশগ্রহণ করা; যা যা নতুন শুনছি তার কিছু অংশ মনে রাখা। আমরা যা শুনি তার মাত্র দশভাগের একভাগ এক বছর পর মনে রাখতে পারি। আগ্রহ চলমান ও অনুশীলন অটুট থাকলে মনে রাখার হাড়ও বাড়বে।

৯. ছুঁড়ে ফেলার সংস্কৃতি বর্জন- অর্থনীতি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে সংগ্রহ কর-চাহিদা পূরণ কর-ছুঁড়ে ফেলার (Take-Make-Dispose) বর্তমানযুগে প্রচলিত উন্নয়নের মডেলের পরিবর্তে লাউদাতো সি'র অনুপ্রেরণা- পুনর্নবীকরণ-পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ-অন্যের সাথে সহভাগিতার (Renew-Remake-Share) রূপান্তরশীল প্রক্রিয়া প্রচলন ও অনুুসরণ করা। সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য কোন কিছু তাৎক্ষণিকভাবে বর্জন না ক’রে বা ফেলে না দিয়ে তা পুনরায় ব্যবহার করাটাও ভালোবাসার কাজ হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং তার মাধ্যমে আমাদের মানবিক মর্যাদাই প্রকাশ পায় (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২১১)।

১০. সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ- কর্মস্থলে ‘ধন্যবাদ’ ও ‘স্বাগত’ এমন সৌজন্যসূচক শব্দ ব্যবহার, ইতিবাচক কথা বলা, ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার, নারী সহকর্মীদের যথাযথ সম্মানসূচক আচরণ করা, নোংরা শব্দ পরিহার করা, সমালোচনামূলক কথা না বলা, বিচারকি কথা-বার্তা পরিহার কর্মপরিবেশ সুন্দর রাখে। অযাচিত চাটুকারিতার স্বভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকা; কাজের সময় অযথা অন্যের নিকট বসে সময় নষ্ট না করা বরং তাকে কাজ করতে দেয়া এবং নিজে ভাল কাজ করা, কাজে সৃজনশীল চিন্তা করা, অবসর সময়ে উদ্দীপনামূলক লেখা পড়ে নতুন চিন্তা আহরণ করা এসব দায়িত্বশীল আচরণ কর্মপরিবেশ সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।

১১. সকলে ভাই-বোন চেতনা- পরিবেশের প্রতি যত্নবান হওয়াটা জীবনযাপনেরই অংশবিশেষ আর সেই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে একত্র মিলেমিশে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ থেকে বসবাস করার সক্ষমতা অর্জন। ঈশ্বর হচ্ছেন আমাদের সকলের অভিন্ন পিতা, সুতরাং আমরা সকলে হয়ে উঠেছি পরস্পর ভাইবোন। পরিবারেই এমন সরল ভ্রাতৃত্ববোধ চর্চা শুরু হয়, পরিবারেই আমরা দাবিহীনভাবে চাইতে শিখি, যা-কিছু পেয়েছি তার জন্য অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে “ধন্যবাদ” দিতে শিখি, পরিবারেই আমরা আক্রমণাত্মক মনোভাব ও লোভ সংবরণ করতে পারি এবং কাউকে কষ্ট দিলে বা ক্ষতি করলে ন¤্রভাবে ক্ষমা আদান-প্রাদান করতে শিখি।  আন্তরিকতাপূর্ণ স্বতস্ফুর্ত এমন সব সহজ সরল অঙ্গভঙ্গি, ভদ্র আচরণ ও ভাল অভ্যাস আমাদের পারিপার্শ্বিকতায় সহভাগিতামূলক জীবন ও শ্রদ্ধাবোধের কালচার বা সংস্কৃতি তৈরিতে সহায়ক হয় যা জীবনকে সমৃদ্ধ করে তুলে (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২১৩)।   

আমাদের অভিন্ন উৎপত্তি সম্বদ্ধে, আমাদের পারস্পরিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে এবং সবার সাথে সহভাগিতা করার দায়িত্ব সম্বদ্ধে জ্ঞান ও সচেতনতা উপস্থিত থাকলে জীবন সম্পর্কে নতুন প্রত্যয়, ইতিবাচক মনোভাব ও অবনত অবস্থার অগ্রগতি সম্ভব। যা আমাদের জীবনধারা পরিবর্তন করার দাবি জানায় (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২০৬)। আসুন, সবাই মিলে জীবনের প্রতি নতুন শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করি, সকলে অভিন্ন বসতবাটির সদস্য হিসেবে সকলের সমান অধিকার তা স্বীকার করি, টেকসই উন্নয়ন অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করি, ন্যায্যতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বেগবান করি, জীবনের আনন্দপূর্ণ উৎসব করার জন্য ভবিষৎ প্রজন্ম যাতে আমাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে পারে এমন ব্যক্তিগতভাবে ও সমবেতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করি। (প্রকাশিত : সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, সংখ্যা ২৮, ৮-১৪ আগস্ট, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ)

মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১

Statement on the death of human rights defender Fr. Stanislaus Lourduswamy, SJ

We, the Catholic Church of Bangladesh, are deeply saddened by the death in custody of Fr. Stan Swamy, 84 year-old Jesuit priest and human rights defender in India, on 05 July 2021. The Episcopal Commission for Justice and Peace of the Catholic Bishops’ Conference of Bangladesh (ECJP-CBCB) extends the deepest condolences to the Church and the faithful in India and to Jesuit Fathers and to the Father’s family. We are united in prayers that the Father of all mercy to welcome him into His peace and light.

Fr. Stanislaus Lourduswamy, the elderly human rights defender, popularly known as Fr. Stan Swamy, died days before his scheduled bail hearing in the High Court of Bombay, which had been postponed due to his deteriorating health. Fr. Stan Swamy, who also suffered from Parkinson’s disease, had been placed on a ventilator at Holy Family Hospital in Mumbai over the weekend, more than a month after he was admitted to the hospital under court order with COVID-19. Fr. Stan Swamy was repeatedly denied bail, and died at the Holy Family Hospital, in Mumbai, India. The defender spent 9 months in jail under the anti-terror law, the Unlawful Activities Prevention Act (UAPA), denied bail and medical care in jail, and only transferred to a hospital when his condition became critical on 29 May.

Fr. Stan Swamy was born into a farming family in the southern Indian state of Tamil Nadu. He joined the Jesuits after turning 20. After his ordination, he served as a priest for more than 50 years. Fr. Stan Swamy advocated for the rights of indigenous tribes in Jharkhand and served as the director of the Indian Social Institute, a training school for marginalized communities in Bangalore, for more than a decade. He was the co-founder of the Persecuted Prisoners Solidarity Committee, an organization assisting those held in prison without having been convicted of a crime because they are still undergoing a trial. Fr. Stan Swamy worked among the Adivasis, Dalits and other marginalized communities so that the poor may have life and life to the full with dignity and honor.

In a Statement announcing Fr. Stan Swamy’s death, “Fr. Stan Swamy has been a dedicated advocate for the rights of Adivasi people, especially in the State of Jharkhand. He founded the Vistapan Virodhi Jan Vikas Andolan, an all-India platform to secure and protect the land rights of Dalit and Adivasi peoples, and was a prominent advocate against the forced displacement of Adivasi communities, typically occurring in the context of development and the mining of mineral-rich lands. He spoke out against the systemic discrimination and violence directed at the Adivasi community and he notably documented and advocated against the arrest of Adivasi youth, who are frequently accused of being “Naxalites” or “Maoists.” He has supported and inspired the most marginal and vulnerable communities to seek redress against violence and discrimination. His persecution and eventual arrest are direct reprisal for his peaceful work.”

"He was arrested on Oct. 8, 2020, by the National Investigation Agency, India’s counter-terrorism task force. The Jesuit priest was accused of being involved with a Maoist group, and inciting violence in the town of Bhima-Koregaon on Jan. 1, 2018. On 09 October, Fr. Stan Swamy was transferred 1,700 kilometres away from his home to Mumbai, Maharashtra, and remanded in the overcrowded Taloja Central Jail. At the time of his arrest Stan Swamy was already suffering from Parkinson’s disease, significant loss of hearing in both ears, and other serious underlying health issues. Initially jail authorities denied him warm clothes and a sipper cup which he needed due to the effects of Parkinson’s disease. Fr. Stan Swamy was eventually transferred from Taloja Central Jail to the Holy Family Hospital on 28 May 2021, when his condition had worsened severely. He tested positive for Covid19 on 30 May. Throughout the month of June he remained in a critical condition, and was moved to the Intensive Care Unit. Fr. Stan Swamy died on at 1.24 pm on 05 July."

His death in custody, and the continued incarceration of other defenders is a tragic indictment of India’s human rights record, and of the global community’s human rights commitments. We stand by Fr. Stan Swamy and other defenders accused and held under trial in this case, and believe they are being deliberately targeted for their human rights work. Standing united and without compromises the human rights values we believe that Indian government will understand their unjust steps and will release many other human rights defenders arbitrarily held in India before they meet the same fate as Fr. Stan Swamy.

We, Justice and Peace volunteers, experienced Fr. Stan Swamy as a gentle giant who walked miles with the tribals and marginalized people for 60 years. Fr. Stan Swamy was attentive to the needs of the poor communities, filled with courage and determination. He dedicated His life as a priest and human rights defender to the preferential option for the poor. In this simple way, he embodied the strong prophetic mission of the Church in India, as well as in global community. A man of justice, peace and unity, Fr. Stan Swamy has been deeply involved in integral human development in the local church and in the country. We learned that by denying him basic human rights, the state has shown its ugly coercive force to the people, Fr. Stan Swamy is a martyr, and a saintly example for us, he fought and died for justice and human rights for least, last and lost ‘all brothers and sisters’ in our ‘common home’ to build fraternal society.

Again, on behalf of the Episcopal commission for Justice and peace-CBCB we express deepest condolences to the Jesuits of Jamshedpur Jesuit Province, the Jesuits of Bangladesh, the family members, friends, lawyers, well-wishers and all those who stood by Fr. Stan Swamy, and we are united in prayers during this painful moment. We offer our thoughts, prayers and well-wishes during this dark time in human rights defenders in the country. We continue to stand in solidarity with Fr. Stan Swamy and we call for full accountability for his death while we demand justice. His example, good works, spirit, courage and kindness will not be forgotten and will continue to inspire.

 

Fr. Liton Hubert Gomes, CSC, Executive Secretary, Episcopal Commission for Justice and Peace, The Catholic Bishops’ Conference of Bangladesh, CBCB Centre, 24/C Asad Avenue, Mohammedpur, Dhaka 1207, Bangladesh, July 12, 2021

Most Rev. Bishop Gervas Rozario,DD, Chairman, Episcopal Commission for Justice and Peace of CBCB, Vice-President of CBCB & Bishop of Rajshahi


(Source: Picture and Information- Collected from website)

সোমবার, ৭ জুন, ২০২১

আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার্থে আমাদের আচরণবিধি

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে ৫ জুন এ দিনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তবে  ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতিবছর দিনটি পালিত হয়ে আসছে। চলতি বছর দিবসটি উদযাপনের  বিষয়বস্তু ধরিত্রীর বাস্তুতন্ত্র অর্থাৎ প্রকৃতি-পরিবেশ ‘পুুনর্মূল্যায়ন, পুনগঠন, পুনরুদ্ধার’ (Reimagine, Recreate, Restore) করা। তবে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের পরিবেশ দিবসটির আরেকটি গুরুত্ব আছে- আজ থেকে জাতিসংঘের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশকও (২০২১-২০৩০) শুরু হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ, এত দিন ধরে আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ আমাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সমন্বিত পরিবেশের যে ক্ষতি করেছি, তা পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বের সব কটি রাষ্ট্র আগামী এক দশক ধরে চেষ্টা করবে। 

পরিবেশ সুরক্ষার্থে ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর পুুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এর আহ্বানকে সফলতা দান করতে আগামী ৭ বছর সময়কে "লাউদাতো সি কর্মসূচি প্লাটফর্ম" ঘোষণা করেছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে, পরিবার, ধর্মপল্লী, পালকীয় সেবা কমিশনসমূহ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হোস্টেল, সেমিনারী, ব্রাদার হাউজ, সিস্টারদের কনভেন্ট, সংগঠন, ক্রেডিট ইউনিয়ন, প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং দলগতভাবে নিজেদের কিছু সুনির্দিষ্ট ও লিখিত অঙ্গীকার ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে আহ্বান করেছেন। তবে আমাদের প্রত্যেকজনকে জানা দরকার, আমাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র বা প্রকৃতি-পরিবেশ কেমন আছে? আর কী করলে এর পুনরুদ্ধার সম্ভব? আমার দায়িত্বটা কীভাবে আমি পালন করতে পারি। আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার্থে পোপ ফ্রান্সিস এর সর্বজনীন পত্র ‘লাউদাতো সি’ এর অনুপ্রেরণায় করণীয় কিছু উপলব্ধি ও কিছু সুপারিশ এখানে প্রদান করা হল যা নিজেদের জন্য একটি "অভিন্ন বসতবাটি সুরক্ষা আচরণবিধি" তৈরি করতে সহায়তা করবে। 

১. নিজের বেদনাদায়ক কষ্ট অনুভব- অন্তরে গভীরভাবে উপলব্ধি করি আবর্জনা এখানে-সেখানে ছুড়ে ফেলে অপরিচ্ছন্ন-অস্বাস্থ্যকর নর্দমা তৈরি করেছি; গাছ কেটেছি কিন্তু রোপনে অবহেলা করে পরিবেশে ভারসাম্য নষ্ট করেছি; স্বার্থপরতা ও অতিভোগের কারণে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ করে ফেলেছি; প্রতিনিয়ত প্রচুর পানি অপচয় করছি, খাল ও নদীর জল বিষাক্ত করে ফেলেছি; এভাবে প্রকৃতি ও প্রতিবেশীদের প্রতি অনেক ক্ষতি  ইতোমধ্যে করেছি। এসব স্মরণ করে অনুতপ্ত হই ও মন-পরিবর্তন করি  এবং প্রকৃতি ও  প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে অঙ্গীকার করে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এর সাথে আধ্যাত্মিকভাবে একাত্ম থাকি। 

২. সৃষ্টির মঙ্গলবার্তা বিশ্বাস- আমাদের আশা হল- ঈশ্বর, যিনি শূণ্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তিনি পৃথিবীতেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন এবং সব ধরনের অমঙ্গলকে পরাস্ত করতে পারেন। তিনি আমার, আপনার সহযোগিতায় তা করতে চান। আজ থেকেই আমার ও আপনার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপে বড় কিছু অর্জন সম্ভব, কেননা আমরা জানি যে পরিবর্তন সম্ভব; এই বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করা;

৩. সৃষ্টি-কেন্দ্রিক উপাসনা প্রস্তুত- যারা পরিবেশ সংরক্ষণ ও বাস্তব্যবিদ্যা গবেষণা করেন তাদের প্রতিপালক আসিসির সাধু ফ্রান্সিস এর মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করতে পারি; সৃষ্টি-কেন্দ্রিক বা লাউদাতো সি উপাসনা উদযাপনকে উৎসাহিত করতে পারি এবং পরিবেশগত ধর্মশিক্ষা, প্রার্থনা, নির্জনধ্যান ও মানব গঠন কার্যক্রম আয়োজন করা যায়; 

৪. পরিবারের যত্ন- আমি যেখানে বসবাস করছি সেটা একটি পরিবার; আমাদের পরিবার হল সৃষ্টি ও প্রকৃতির একটি অংশ; পরিবারের আরো বেশী যত্ন নিব। খাবারের সময়, অবসর সময়ে অথবা বিনোদনের সময়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং দীনদরিদ্রদের অবস্থা নিয়ে সহভাগিতা করা; প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং গরীবদের জন্য ভাল কিছু উদ্যোগ নিতে সন্তানদের উৎসাহিত করা যায়;

৫. তিনটি ‘পি’ (three P’s)- ‘লাউদাতো সি’ পত্রটির নিবিড় সমন্বয় ও কার্যকরী সাড়াদানের ক্ষেত্রে তিনটি ‘পি’ (three P’s) অনুধ্যানে করণীয়সমূহ স্মরণ করতে পারি- plant বা গাছ-গাছড়া লাগানো, protect বা রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও promote বা সংবর্ধিত করা অর্থাৎ ‘লাউদাতো সি’র মাণ্ডলিক শিক্ষা সকলের নিকট প্রকাশ ও প্রচার করা;

৬. পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা- নিজের দেহ থেকে শুরু করে জামাকাপড়, ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, সমাবেশস্থল, প্রভৃতির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা; সন্তানদেরও অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করবো। বাড়ির চারিপাশের প্লাস্টিক, নর্দমা ও আবর্জনা পরিস্কার করতে উদ্যোগ গ্রহণ ও নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করা বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা যায়;

৭. অপচয়রোধ ও ঋণ পরিশোধ- প্রয়োজন মাফিক কেনাকাটা, পরিমিত রান্না করা; প্রয়োজন অতিরিক্ত খরচপাতি, জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার, ভোজনবিলাস ও অতি ভোগের মানসিকতা বর্জন করা; বাড়িতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিভিশন, এসি, পানির কল, বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহারের পর বন্ধ রাখাতে সর্বদা সচেতন থাকব। ক্রেডিট ইউনিয়নসহ সকল প্রকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা; ঋণ গ্রহণ করে বিনোদন বা উৎসব আয়োজন থেকে বিরত থাকা;

৮. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার- শাকসবজি, ফুল ও ফলের বাগান করা এবং খাবার হিসেবে ব্যবহার করা। প্রকৃতিজাত, বিশুদ্ধ ও সুষম খাদ্য আহার ও পানীয় পান করা; মাংস গ্রহণ পরিমিত করা, পরিমিত পরিবেশন ও পরিমিত ভোগ, দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার মনোভাব তৈরি করা; 

৯. বাগান ও জৈবসার- রান্নাঘরের অবশিষ্টাংশ, পাতা-লতা ও আবর্জনাগুলি মিশ্রিত করে উত্তম সার তৈরি করা যায় এবং এসব গাছের বৃদ্ধিতে আরও ভাল সার হিসেবে সহায়তা করে। গ্রামের বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা শহরে বাসাবাড়িতে টবে বারান্দায় বা ছাদে অথবা জানালার পাশে অথবা কর্মস্থলে শাক-সবজি-ফুল বাগান তৈরি করা ও নির্ধারিত গাছ, শাক-সবজি বা ফুলগাছ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সন্তানদের দায়িত্ব বন্টন করা; 

১০. দূষণমুক্ত পরিবেশ- শব্দ, বায়ূ, জল এবং সকল প্রকার দূষণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা; গণপরিবহন ব্যবহার করা এবং পরিবহনের দূষণকারী কর্মক্রিয়া পরিত্যাগ করতে হবে; 

১১. পানি অপচয়রোধ- যারা পানীয় জলের চরম সংকটে আছে তাদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমরা  স্নানে পরিমিত পানি ব্যবহার বা আগের চেয়ে একটু কম পানি ব্যবহার করা, হাতমুখ ধোয়ার সময় কলের পানি নষ্ট না করি, যতটুকু পান করতে চাই ততটুকু পানি গ্লাসে ঢেলে পান করতে পারি। আমাদের এমন ক্ষুদ্র ক্ষ্রদ্র অভ্যাস পানি অপচয় অনেক হ্রাস করবে; 

১২. প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতনতা- আমরা এমুহূর্তে প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ বাদ দিতে পারছি না তাই সঠিকভাবে ব্যবহার ও প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পলিথিন ব্যাগ একেবারেই বাদ দিতে হবে কারণ এর ক্ষতির ধরন বহুমাত্রিক এবং বাড়ছে- মাটি নষ্ট করে জমিতে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করছে, শহরে নর্দমা বের হওয়ার পথ বন্ধ করে ব্যাপক ক্ষতি করছে এবং আগুনে দিলে গ্যাস হয়ে বায়ুদূষণ করে মানবদেহের সংঘাতিক ক্ষতি করবে; 

১৩. কাপড় ও পাটের ব্যাগ ব্যবহার- পাটের তৈরি চটের ব্যাগ অথবা ভারী ও শক্ত কাপড় পুনঃব্যহার করে ব্যাগ তৈরি করে বাজারে বা বাড়ির নিত্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়;

১৪. পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা- লাউদাতো সি পত্রটির অনুপ্রেরণায় সমন্বিত পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক শিক্ষা বিস্তার করা সম্ভব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ডাইয়োসিস, ধর্মপল্লী, ক্লাব, সংগঠন, ক্রেডিট ইউনিয়ন, পরিবারে, যোগাযোগ মাধ্যমে, ধর্মশিক্ষাদানে ও অন্যত্র। পরিবেশগত সচেতনতা এবং কর্মকাণ্ড তৈরি লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিবেশগত চেতনায়নমূলক শিক্ষা পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করতে পারে; 

১৫. পরিবেশ বিষয়ক বই ও পত্রিকা পড়া- ব্যক্তিগতভাবে এবছর পরিবেশ বিষয়ক একটি বই পড়ার অঙ্গীকার করা; প্রকৃতি ও পরিবেশ সংক্রান্ত পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের গ্রাহক হয়ে পাঠ করা; লাউদাতো সি বিষয়ক একটি শিক্ষা সেমিনারে অংশগ্রহণ করা; যা যা নতুন শুনছি তার কিছু অংশ মনে রাখতে চেষ্টা করা। আমরা যা শুনি তার মাত্র ১০ শতকরা এক বছর পর মনে রাখতে পারি। আগ্রহ অটুট থাকলে মনে রাখার শতকরা হারও বাড়বে;

১৬. অভিজ্ঞ সহায়ক নিমন্ত্রণ- নিজেদের সংঘের, বা প্রতিষ্ঠানের সেবাগ্রহণকারী অংশীজনের সাথে আপনার শিক্ষণ সহভাগিতার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে আপনাকে সহায়তা করতে বাইরে থেকে অভিজ্ঞ সহায়ক বা বক্তা ডেকে আনুন;

১৭. নিজে জানুন ও অন্যকে জানান- আমাদের দেশে পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে সরকার কাজ করছে, দেশী সংস্থা কাজ করছে, বিদেশী সংস্থা কাজ করছে। তাদের কাজ সম্পর্কে জানা ও অপরকে জানানো, তাদের কাজে সহযোগিতা করা। প্রকৃতি ও পরিবেশ বা 'লাউদাতো সি' বিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জোটে (networking) যোগ দিন; নিজের চেষ্টায় পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ, ফলাফল ও প্রতিরোধ সম্পর্কে আরো বেশী করে জানুন। পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ে মণ্ডলীর শিক্ষা কী, মহামান্য পোপ মহোদয় বার বার কী আহবান রাখছেন- তা জানুন;

১৮. একজনকে দায়িত্ব প্রদান- আপনার সংঘে বা প্রতিষ্ঠানে এমন একজনকে বাছাই করুন যে কী না আপনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আগামী বছর এই বিষয়ে নিজে আরো জানবেন, সংঘের বা প্রতিষ্ঠানের সকলকে জানাবেন ও বাইরে অন্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবেন; 

১৯. সহভাগিতা ও আলোচনা- আপনার যা যা নতুন শিক্ষণ (learning) তা তা আপনার সংঘের বা প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার অংশীজনদের (stakeholders) জানান। যেসমস্ত চিঠি, দলিল, লেখা পাচ্ছেন তা সহভাগিতা করুন, তাদের কেন জানাচ্ছেন তা-ও ব্যাখ্যা করুন। আপনার প্রত্যাশা খুলে বলুন। কোনো নিয়মিত সভায় সকলের সাথে এই বিষয় আলাপ করতে ঘন্টাখানেক সময় বরাদ্দ রাখা যেতে পারে;

২০. কর্মস্থলে সচেতনতা- কর্মস্থলে প্রয়োজন ছাড়া কাগজে প্রিন্ট না করা, প্রয়োজনে কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় প্রিন্ট করা এবং সুযোগ থাকলে কাগজ পুনঃব্যবহার করতে পারি; কম্পিউটার, প্রিন্টার ও অন্যান্য অফিস সরঞ্জামসমূহ ব্যবহারের পরে বন্ধ রাখব; দলীয়ভাবে গাড়ী ব্যবহার করার মাধ্যমে কার্বন ব্যবহার হ্রাস করতে পারি; 

২১. সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ- কর্মস্থলে ‘ধন্যবাদ’ ও ‘স্বাগত’ এমন সৌজন্যসূচক শব্দ ব্যবহার, ইতিবাচক কথা বলা, ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার, নোংরা শব্দ পরিহার, সমালোচনামূলক কথা না বলা, বিচারকি কথা-বার্তা পরিহার কর্মপরিবেশ সুন্দর রাখে। অযাচিত চাটুকারিতার স্বভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকা; কাজের সময় অযথা অন্যের নিকট বসে সময় নষ্ট না করা বরং তাকে কাজ করতে দেয়া এবং নিজে ভাল কাজ করা, কাজে সৃজনশীল চিন্তা করা, অবসর সময়ে উদ্দীপনামূলক লেখা পড়ে নতুন চিন্তা আহরণ করা; 

২২. সত্য মতকে সত্যরূপে গ্রহণ- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিত্তিহীন গুজব ও ‘মতের অরণ্য’ থেকে  বেরিয়ে এসে মূলধারার গণমাধ্যমের উপর নির্ভর করা যেন যথার্থ আনন্দ, গভীর তৃপ্তি, প্রকৃত সত্য আহরণ করা যায়;

২৩. ছুঁড়ে ফেলার সংস্কৃতি বর্জন- অর্থনীতি, উৎপাদন ও জিনিসপত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে- সংগ্রহ কর-চাহিদা পূরণ কর-ছুঁড়ে ফেলার (take-make-dispose) বর্তমানযুগে প্রচলিত উন্নয়নের মডেলের পরিবর্তে লাউদাতো সি'র অনুপ্রেরণা- পুনর্নবীকরণ-পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ-অন্যের সাথে সহভাগিতার (renew-remake-share) রূপান্তরশীল প্রক্রিয়া প্রচলন ও অনুুসরণ করা;

২৪. পবিত্র আহ্বান হিসেবে গ্রহণ- নিজের কল্যাণের কথা ভেবেই প্রকৃতি, পরিবেশ এবং প্রতিবেশীর সুরক্ষা সুসংবাদটি পবিবারের আপনজন ও বন্ধুবান্ধবদের জানানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই এটি পবিত্র একটি আহ্বান হিসেবে গ্রহণ করা যায়;

২৫. নিজের অংশগ্রহণটা অপরিহার্য- যদি ভাল কিছু করি তবে ‘আরো ভাল’ কিছু করতে চেষ্টা করি, যদি আরো ভাল কিছু করে ফেলেছি তবে ‘উত্তম কিছু’ করতে চেষ্টা করি, আর যদি উত্তম কিছু করে থাকি তবে ‘অতি উত্তম কিছু' করার জন্য উদ্যোগ নিতে পারি;

২৬. সুনির্দিষ্ট কৌশল অবলম্বন- সকল পযায়ে সুনির্দিষ্ট কৌশল থাকা দরকার। যেমন- প্রথমত, সমন্বিত পরিবেশ সরক্ষার্থে বিভিন্ন বাসস্তুতন্ত্র বা প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের বর্তমান সঠিক অবস্থা জানা থাকতে হবে এতে সুনির্দিষ্ট কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা যায়। দ্বিতীয়ত, লোকজ জ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের সমন্বয় করে পরিকল্পনা সাজানো দরকার। কারণ পৃথিবীব্যাপী প্রতিবেশ রক্ষায় লোকায়ত জ্ঞান, স্থানীয় সংরক্ষণ পদ্ধতি, জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংরক্ষণ উদ্যোগগুলো বড় ভূমিকা রাখছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। তৃতীয়ত, স্থানীয় ও আঞ্চলিক সুরক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থত, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা এবং সবুজ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দেওয়ার সময় এখনই, সবাইকে তা মানতে হবে। প্রকৃতিকেন্দ্রিক ও জবাবদিহিমূলক মনিটরিং ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং তবেই সমন্বিত পরিবেশ সংরক্ষনের সুফল পাওয়া যাবে।

২৭. অবিরত প্রার্থনা করি- যদি কিছুই করতে না পারি তবে পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে সরাসরি যারা জড়িত তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তেনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের জন্যেও প্রার্থনা করুন। দীনদরিদ্র মানুষ যারা অমানবিক ও অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন তাদের জন্য প্রার্থনা অব্যাহত রাখুন। এই বিশ্ব জানতেও পারেনা প্রার্থনায় যে কতো আশ্চর্য্য কাজ হয়!     

করোনাভাইরাস মহামারী শিখিয়েছে আমাদের আরও বেশি যত্নবান ও রক্ষণাবেক্ষণ মনোভাব প্রয়োজন। পোপ মহোদয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা ‘লাউদাতো সি সপ্তাহ’ উদযাপন করছি। ইতোমধ্যে অনেকে নীরবে কাজ করে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করেছি। ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর পোপ ফ্রান্সিসের এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে আগামী ৭ বছর অবিরত বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করবে। আসুন, একসাথে, একত্রে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাসমূহ  "অভিন্ন বসতবাটির সুরক্ষায় আমাদের আচরণবিধি" অনুসরণ করি তবেই মহান কিছু অর্জন সম্ভব হবে। ধরিত্রীর বুকে আনবে নতুন ছন্দ, জাগাবে নতুন আশা; ‘আমরা সবুজ, আমরা সুন্দর’ থাকি।

মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১

লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম


'লাউদাতো সি' সর্বজনীন পত্রটির ৭টি লক্ষ্য

১. 'লাউদাতো সি সপ্তাহ-২০২১' (মে ১৬-২৫, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ) এর সমাপ্তি দিবসে মে ২৫, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তরের প্রধান কার্ডিনাল পিটার টার্কসন সমন্বিত পরিবেশ সংরক্ষণে আগামী ৭ বছর সময়কে 'লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম' (Laudato Si Action Platform-LSAP) হিসেবে  ঘোষণা করেছেন। কার্ডিনাল মহোদয় বলেছেন- 'লাউদাতো সি' সর্বজনীন পত্রটি প্রকাশিত হওয়া থেকে আজ ছয় বছর অবধি জগতের ও দীনদরিদ্রদের আর্তনাদ দিন দিন আমাদের কাছে আরও হৃদয় বিদারক হয়ে উঠেছে। আমাদের বিজ্ঞানী এবং তরুনদের বার্তা ক্রমবর্ধমানভাবে উদ্বেগজনক- 'আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছি।'

২. 'লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম' বহুমাত্রিক সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়ে সমন্বিত পরিবেশ সংরক্ষণের দিকে সাত বছরের যাত্রা। কার্ডিনাল বলেছেন- এই সাতটি বছর হবে সক্রিয় কর্মসূচিভিত্তিক একটি যাত্রা, তবে এখন আগের চেয়ে আরো বিস্তর কাজ করার সময়; সুনির্দিষ্ট বহুমাত্রিক সৃজনশীল কর্মসূচি গ্রহণের সময় এখনই। কার্ডিনাল মহোদয় 'লাউদাতো সি' সর্বজনীন পত্রটির সাতটি লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেছেন-

(ক) জগতের আর্তনাদে আমাদের সাড়াদান অর্থাৎ পৃথিবী নামক বাগানটি চাষ করা, যত্ন নেওয়া, তত্ত্বাবধান করা, সুরক্ষা করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা (আদি ২:১৫); 

(খ) দীনদরিদ্রদের কান্নায় আমাদের প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ আমরা সকলে মিলে একটি মাত্র মানবপরিবার, অভিন্ন বসতবাটিতে সকলের সমান অধিকার রয়েছে তা অনুধাবন করা;

(গ) পরিবেশগত অর্থনীতি অর্থাৎ আরও ন্যায়-সঙ্গত, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই অর্থনীতি হতে হবে যা কাউকে পিছনে ফেলে রাখে না; 

(ঘ) সরল জীবনযাত্রা গ্রহণ অর্থাৎ সহজ সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ জীবন গড়ার প্রত্যয় নিয়ে জগতের বেদনাদায়ক বিষয়সমূহে সচেতন হওয়া ও নিরাময়ের উদ্যোগ নেওয়া; 

(ঙ) পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা অর্থাৎ পরিবেশগত সচেতনতা এবং কর্মকাণ্ড তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিবেশ সংরক্ষণ ও চেতনায়নমূলক শিক্ষা পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করা;

(চ) পরিবেশগত আধ্যাত্মিকতা অনুশীলনে গভীরভাবে অনুধাবন করা যে মানবজীবন তিনটি সম্পর্কযুক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যথা-  ঈশ্বরের সঙ্গে, আমাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে এবং পৃথিবীর সঙ্গে; সুতরাং সৃষ্টি-কেন্দ্রিক উপাসনা উদ্যাপনকে উৎসাহিত করা এবং পরিবেশগত ধর্মশিক্ষা, প্রার্থনা, নির্জনধ্যান ও মানব গঠন কার্যক্রম আয়োজন করা এবং 

(ছ) সমদায়িত্ববোধ প্রেরণায় অংশগ্রহণমূলক বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করা। পত্রটির মৌলিক অনুপ্রেরণায় আমাদের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।  

৩. এ উপলক্ষে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এক বার্তায় জোর দিয়ে বলেছেন- আসুন, একসাথে কাজ করি, কেবলমাত্র আমরা এইভাবেই আমাদের ভবিষ্যতে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ ও টেকসই ধরিত্রী গড়তে সক্ষম হবো, এটাই আমাদের আশা। পোপ মহোদয় বার্তায় অভিন্ন বসতবাটির যত্নে তাঁর আবেদনটি 'পুনর্নবীকরণ' করে বলেন- "আসুন আমরা আমাদের মাতৃভূমির যত্ন নিতে এগিয়ে আসি; আসুন, আমাদেরকে সম্পদের শিকারী করে তোলে এমন স্বার্থপর প্রলোভনকে কাটিয়ে উঠি; আসুন, পৃথিবী এবং সৃষ্টির উপহারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই; আসুন, আমরা এমন একটি জীবনযাত্রা এবং এমন একটি সমাজের উদ্বোধন করি যা শেষ পর্যন্ত পরিবেশ বান্ধব ও পরিবেশ-টেকসই হয়। সবার জন্য আরও একটি সুন্দর ভবিষ্যত উপহার দিতে আমাদের সুযোগ রয়েছে। পিতা ঈশ্বরের নিকট থেকে আমরা একটি সুন্দর বাগান পেয়েছি, আমাদের  সন্তানদের জন্য আমরা একটি মরুভূমি রেখে যেতে পারি না।" তিনি সকলকে এই যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানান বিশেষত- পরিবার, ধর্মপল্লী, ডাইয়োসিস, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, খামার, সংগঠন, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে জড়িত সম্পৃক্ত হতে আহ্বান জানান। 

৪. বিশেষত বিগত 'লাউদাতো সি বছর' এ (মে, ২০২০ - মে, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ) ৭০০,০০০ গাছ লাগানোর উদ্যোগের জন্য কার্ডিনাল টার্কসন এ সময় বাংলাদেশের কাথলিক খ্রিস্টভক্তগণের প্রশংসা করেছেন। ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন' নামক পুণ্য দপ্তর আগামী ৪ অক্টোবর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে আসিসির সাধু ফ্রান্সিস এর পর্বদিবসে 'লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম' এর কর্মসূচি উদ্বোধন করবে এবং এ সময়ের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে, পরিবার, ধর্মপল্লী, পালকীয় সেবা কমিশনসমূহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হোস্টেল, সেমিনারী, ব্রাদার হাউজ, সিস্টারদের কনভেন্ট, সংগঠন, ক্রেডিট ইউনিয়ন, সকল প্রকার প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং দলগতভাবে নিজেদের বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে আহ্বান করছে যেন একই দিনে আমরা একযুগে বহুমাত্রিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করতে পারি।

৫. ভাটিকানের 'পরিবেশ ও সৃষ্টি' নামক দপ্তরের সমন্বকারী ফা. যোসট্রম আইজাক কুরিথাডাম বলেছেন- আমাদের অভিন্ন বসতবাটির এবং সৃষ্টির সমস্ত সদস্যদের প্রতি যত্নবান হতে পবিত্র আত্মা কীভাবে বিশ্বব্যাপী মণ্ডলীকে উদ্বুদ্ধ করছে এটি দেখতে অনুপ্রেরণাদায়ক; 'লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম' হল সমন্বিত পরিবেশ বিষয়ক চেতনায় পুরোপুরি টেকসয়ের অভিমুখে যাত্রা। তিনি আরো বলেছেন- লাউডাতো সি বছর' সমাপ্ত হওয়ার পর থেকেই সকল খ্রিস্টভক্তগণ ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাৎসরিক বিশ্বব্যাপী প্রার্থনা এবং অভিন্ন বসতবাটির যত্ন উদযাপনের জন্য 'সৃষ্টি উদ্যাপন কাল' এর দিকে মনোনিবেশ করবেন। ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তরের সেক্রেটারি মন্সিনিয়র ব্রুনো মারি দোফে- সকল খ্রিস্টভক্তদের বিশ্বব্যাপী 'সৃষ্টি উদ্যাপন কাল' পালনে পুণ্যপিতা পোপ ফান্সিসের আহ্বানের কথা স্মরন করে দিয়ে বলেছেন- আমরা বিশপদের এবং মাণ্ডলিক সংস্থাসমূহকে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে নিজস্ব বিবৃতি প্রকাশ করতে উৎসাহিত করছি।

৬. অন্যদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পর্ষদও ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ৫ জুন এ দিনকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। তবে  ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতিবছর দিনটি পালিত হয়ে আসছে। চলতি বছর দিবসটি উদযাপনের বিষয়বস্তু ছিল ধরিত্রীর বাস্তুতন্ত্র অর্থাৎ প্রকৃতি-পরিবেশ ‘পুুনর্মূল্যায়ন, পুনর্গঠন, পুনরুদ্ধার’ (Reimagine, Recreate, Restore) করা। তবে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের পরিবেশ দিবসটির আরেকটি গুরুত্ব আছে- আজ থেকে জাতিসংঘের ‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশক’ (২০২১-২০৩০ খ্রিস্টাব্দ) শুরু হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ, এত দিন ধরে আমরা উন্নয়ন কর্মকণ্ডসহ আমাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সমন্বিত পরিবেশের যে ক্ষতি করেছি, তা পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বের সব কটি রাষ্ট্র আগামী এক দশক অবিরত চেষ্টা করবে।

৭. করোনাভাইরাস মহামারির এ অবরুদ্ধ সময়ে নিজের অবস্থানে থেকে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার জন্য কিছু কিছু উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থপূর্ণভাবে ‘লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম’ কর্মপ্রক্রিয়ায় জড়িত হতে পরিকল্পনা করতে পারি। ধরিত্রীর যত্ন নেওয়া, তত্ত্বাবধান করা, সুরক্ষা করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য আমরা সবাই যার যার নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতা, আত্মনিয়োগ ও মেধা অনুসারে জড়িত হয়ে ঈশ্বরের হাতের যন্ত্র হিসেবে সহযোগিতা করতে পারি (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ ১৪)। আসুন, ধরিত্রীর নিরাময়ে ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তরের এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে আগামী ৭ বছর সময় সক্রিয়ভাবে সাথে থাকি। আসুন, একসাথে, একত্রে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাসমূহ অবিরত চালিয়ে যাই; ‘আমরা সবুজ, আমরা সুন্দর’ থাকি।




রবিবার, ২৩ মে, ২০২১

অভিন্ন বসতবাটির সুরক্ষায় আমাদের আচরণবিধি

ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর পুুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এর আহ্বানকে সফলতা দান করতে আগামী ৭ বছর সময়কে "লাউদাতো সি কর্মসূচি প্লাটফর্ম" ঘোষণা করেছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে, পরিবার, ধর্মপল্লী, পালকীয় সেবা কমিশনসমূহ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হোস্টেল, সেমিনারী, ব্রাদার হাউজ, সিস্টারদের কনভেন্ট, সংগঠন, ক্রেডিট ইউনিয়ন, প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং দলগতভাবে নিজেদের কিছু সুনির্দিষ্ট ও লিখিত অঙ্গীকার ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে আহ্বান করেছেন।আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার্থে পোপ ফ্রান্সিস এর সর্বজনীন পত্র ‘লাউদাতো সি’ এর অনুপ্রেরণায় করণীয় কিছু উপলব্ধি ও কিছু সুপারিশ এখানে প্রদান করা হল যা নিজেদের জন্য একটি "অভিন্ন বসতবাটির সুরক্ষায় আমাদের আচরণবিধি" তৈরি করতে সহায়তা করবে।

১. নিজের বেদনাদায়ক কষ্ট অনুভব- অন্তরে গভীরভাবে উপলব্ধি করি আবর্জনা এখানে-সেখানে ছুড়ে ফেলে অপরিচ্ছন্ন-অস্বাস্থ্যকর নর্দমা তৈরি করেছি; গাছ কেটেছি কিন্তু রোপনে অবহেলা করে পরিবেশে ভারসাম্য নষ্ট করেছি; স্বার্থপরতা ও অতিভোগের কারণে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ করে ফেলেছি; প্রতিনিয়ত প্রচুর পানি অপচয় করছি, খাল ও নদীর জল বিষাক্ত করে ফেলেছি; এভাবে প্রকৃতি ও প্রতিবেশীদের প্রতি অনেক ক্ষতি  ইতোমধ্যে করেছি। এসব স্মরণ করে অনুতপ্ত হই ও মন-পরিবর্তন করি  এবং প্রকৃতি ও  প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে অঙ্গীকার করে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এর সাথে আধ্যাত্মিকভাবে একাত্ম থাকি। 

২. সৃষ্টির মঙ্গলবার্তা বিশ্বাস- আমাদের আশা হল- ঈশ্বর, যিনি শূণ্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তিনি পৃথিবীতেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন এবং সব ধরনের অমঙ্গলকে পরাস্ত করতে পারেন। তিনি আমার, আপনার সহযোগিতায় তা করতে চান। আজ থেকেই আমার ও আপনার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপে বড় কিছু অর্জন সম্ভব, কেননা আমরা জানি যে পরিবর্তন সম্ভব; এই বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করা;

৩. সৃষ্টি-কেন্দ্রিক উপাসনা প্রস্তুত- যারা পরিবেশ সংরক্ষণ ও বাস্তব্যবিদ্যা গবেষণা করেন তাদের প্রতিপালক আসিসির সাধু ফ্রান্সিস এর মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করতে পারি; সৃষ্টি-কেন্দ্রিক বা লাউদাতো সি উপাসনা উদযাপনকে উৎসাহিত করা এবং পরিবেশগত ধর্মশিক্ষা, প্রার্থনা, নির্জনধ্যান ও মানব গঠন কার্যক্রম আয়োজন করা যায়;

৪. পরিবারের যত্ন- আমি যেখানে বসবাস করছি সেটা একটি পরিবার; আমাদের পরিবার হল সৃষ্টি ও প্রকৃতির একটি অংশ; পরিবারের আরো বেশী যত্ন নিব। খাবারের সময়, অবসর সময়ে অথবা বিনোদনের সময়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং দীনদরিদ্রদের অবস্থা নিয়ে সহভাগিতা করা; প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং গরীবদের জন্য ভাল কিছু উদ্যোগ নিতে সন্তানদের উৎসাহিত করা যায়;

৫. তিনটি ‘পি’ (three P’s)- ‘লাউদাতো সি’ পত্রটির নিবিড় সমন্বয় ও কার্যকরী সাড়াদানের ক্ষেত্রে তিনটি ‘পি’ (three P’s) অনুধ্যানে করণীয়সমূহ স্মরণ করতে পারি- plant বা গাছ-গাছড়া লাগানো, protect বা রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও promote বা সংবর্ধিত করা অর্থাৎ ‘লাউদাতো সি’র মাণ্ডলিক শিক্ষা সকলের নিকট প্রকাশ ও প্রচার করা;

. পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা- নিজের দেহ থেকে শুরু করে জামাকাপড়, ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, সমাবেশস্থল, প্রভৃতির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা; সন্তানদেরও অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করবো। বাড়ির চারিপাশের প্লাস্টিক, নর্দমা ও আবর্জনা পরিস্কার করতে উদ্যোগ গ্রহণ ও নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করা বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা যায়;

. অপচয়রোধ ও ঋণ পরিশোধ- প্রয়োজন মাফিক কেনাকাটা, পরিমিত রান্না করা; প্রয়োজন অতিরিক্ত খরচপাতি, জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার, ভোজনবিলাস ও অতি ভোগের মানসিকতা বর্জন করা; বাড়িতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিভিশন, এসি, পানির কল, বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহারের পর বন্ধ রাখাতে সর্বদা সচেতন থাকব। ক্রেডিট ইউনিয়নসহ সকল প্রকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা; ঋণ গ্রহণ করে বিনোদন বা উৎসব আয়োজন থেকে বিরত থাকা;

. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার- শাকসবজি, ফুল ও ফলের বাগান করা এবং খাবারের হিসেবে ব্যবহার করা। প্রকৃতিজাত, বিশুদ্ধ ও সুষম খাদ্য আহার ও পানীয় পান করা; মাংস গ্রহণ পরিমিত করা, পরিমিত পরিবেশন ও পরিমিত ভোগ, দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার মনোভাব তৈরি করা; 

. বাগান ও জৈবসার- রান্নাঘরের অবশিষ্টাংশ, পাতা-লতা ও আবর্জনাগুলি মিশ্রিত করে উত্তম সার তৈরি করা যায় এবং এসব গাছের বৃদ্ধিতে আরও ভাল সার হিসেবে সহায়তা করে। কর্মস্থলে ও বাড়িতে খালি জায়গায়, টবে, বারান্দা, ছাদে অথবা জানালার পাশে গাছ রোপণ ও নির্ধারিত গাছ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সন্তানদের দায়িত্ব বন্টন করে দিতে পারি। গ্রামের বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা শহরে বাসাবাড়িতে টবে বারান্দায় বা ছাদে অথবা জানালার পাশে শাক-সবজি-ফুল বাগান তৈরি করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা; 

১০. দূষণমুক্ত পরিবেশ- শব্দ, বায়ূ, জল এবং সকল প্রকার দূষণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা; গণপরিহন ব্যবহার করা এবং পরিবহণের দূষণকারী কর্মক্রিয়া পরিত্যাগ করতে হবে; 

১১. পানি অপচয়রোধ- যারা পানীয় জলের চরম সংকটে আছে তাদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমরা  স্নানে পরিমিত পানি ব্যবহার বা আগের চেয়ে একটু কম পারি ব্যবহার, হাতমুখ ধোয়ার সময় কলের পানি নষ্ট না করি, যতটুকু পান করতে চাই ততটুকু পানি গøাসে ঢেলে পান করতে পারি। আমাদের এমন ক্ষুদ্র ক্ষ্রদ্র অভ্যাস পানি অপচয় অনেক হ্রাস করবে; 

১২. প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতনতা- আমরা এমুহূর্তে প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ বাদ দিতে পারছি না তাই সঠিকভাবে ব্যবহার ও প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পলিথিন ব্যাগ একেবারেই বাদ দিতে হবে কারণ এর ক্ষতির ধরন বহুমাত্রিক এবং বাড়ছে- মাটি নষ্ট করে জমিতে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করছে, শহরে নর্দমা বের হওয়ার পথ বন্ধ করে ব্যাপক ক্ষতি করছে এবং আগুনে দিলে গ্যাস হয়ে বায়ুদূষণ করে মানবদেহের সংঘাতিক ক্ষতি করবে; 

১৩. কাপড় ও পাটের ব্যাগ ব্যবহার- পাটের তৈরি চটের ব্যাগ অথবা ভারী ও শক্ত কাপড় পুনঃব্যহার করে ব্যাগ তৈরি করে বাজারে বা বাড়ির নিত্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়;

১৪. পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা- লাউদাতো সি পত্রটির অনুপ্রেরণায় সমন্বিত পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক শিক্ষা বিস্তার করা সম্ভব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ডাইয়োসিস, ধর্মপল্লী, ক্লাব, সংগঠন, ক্রেডিট ইউনিয়ন, পরিবারে, যোগাযোগ মাধ্যমে, ধর্মশিক্ষাদানে ও অন্যত্র। পরিবেশগত সচেতনতা এবং কর্মকাণ্ড তৈরি লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিবেশগত চেতনায়নমূলক শিক্ষা পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করােত পারে; 

১৫. পরিবেশ বিষয়ক বই ও পত্রিকা পড়া- ব্যক্তিগতভাবে এবছর পরিবেশ বিষয়ক একটি বই পড়ার অঙ্গীকার করা; প্রকৃতি ও পরিবেশ সংক্রান্ত পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের গ্রাহক হয়ে পাঠ করা; লাউদাতো সি বিষয়ক একটি শিক্ষা সেমিনারে অংশগ্রহণ করা; যা যা নতুন শুনছি তার কিছু অংশ মনে রাখুন। আমরা যা শুনি তার মাত্র ১০ শতকরা এক বছর পর মনে রাখতে পারি। আগ্রহ অটুট থাকলে মনে রাখার শতকরা হারও বাড়বে;

১৬. অভিজ্ঞ সহায়ক নিমন্ত্রণ- আপনার সংঘের, বা প্রতিষ্ঠানের সেবাগ্রহণকারী অংশীজনের সাথে আপনার শিক্ষণ সহভাগিতার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে আপনাকে সহায়তা করতে বাইরে থেকে অভিজ্ঞ সহায়ক বা বক্তা ডেকে আনুন;

১৭. নিজে জানুন ও অন্যকে জানান- আমাদের দেশে পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে সরকার কাজ করছে, দেশী সংস্থা কাজ করছে, বিদেশী সংস্থা কাজ করছে। তাদের কাজ সম্পর্কে জানা ও অপরকে জানানো, তাদের কাজে সহযোগিতা করা। প্রকৃতি ও পরিবেশ বা লাউদাতো সি বিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জোটে (হবঃড়িৎশরহম) যোগ দিন; নিজের চেষ্টায় পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ, ফলাফল ও প্রতিরোধ সম্পর্কে আরো বেশী করে জানুন। পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ে মণ্ডলীর শিক্ষা কী, মহামান্য পোপ মহোদয় বার বার কী আহবান রাখছেন- তা জানুন;

১৮. একজনকে দায়িত্ব প্রদান- আপনার সংঘে বা প্রতিষ্ঠানে এমন একজনকে বাছাই করুন যে কী না আপনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আগামী বছর এই বিষয়ে নিজে আরো জানবেন, সংঘের বা প্রতিষ্ঠানের সকলকে জানাবেন ও বাইরে অন্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবেন; 

 ১৯. সহভাগিতা ও আলোচনা- আপনার যা যা নতুন শিক্ষণ (learning) তা তা আপনার সংঘের বা প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার অংশীজনদের (stakeholders) জানান। যেসমস্ত চিঠি, দলিল, লেখা পাচ্ছেন তা সহভাগিতা করা, তাদের কেন জানাচ্ছেন তা-ও ব্যাখ্যা করুন। আপনার প্রত্যাশা খুলে বলুন। কোনো নিয়মিত সভায় সকলের সাথে এই বিষয় আলাপ করতে ঘন্টাখানেক সময় বরাদ্দ রাখা যেতে পারে;

২০. কর্মস্থলে সচেতনতা- কর্মস্থলে প্রয়োজন ছাড়া কাগজে প্রিন্ট না করা, প্রয়োজনে কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় প্রিন্ট করা এবং সুযোগ থাকলে কাগজ পুনঃব্যবহার করতে পারি; কম্পিউটার, প্রিন্টার ও অন্যান্য অফিস সরঞ্জামসমূহ ব্যবহারের পরে বন্ধ রাখব; দলীয়ভাবে গাড়ী ব্যবহার করার মাধ্যমে কার্বন ব্যবহার হ্রাস করতে পারি; 

২১. সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ- কর্মস্থলে ‘ধন্যবাদ’ ও ‘স্বাগত’ এমন সৌজন্যসূচক শব্দ ব্যবহার, ইতিবাচক কথা বলা, ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার, নোংরা শব্দ পরিহার, সমালোচনামূলক কথা না বলা, বিচারকি কথা-বার্তা পরিহার কর্মপরিবেশ সুন্দর রাখে। অযাচিত চাটুকারিতার স্বভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকা; কাজের সময় অযথা অন্যের নিকট বসে সময় নষ্ট না করা বরং তাকে কাজ করতে দেয়া এবং নিজে ভাল কাজ করা, কাজে সৃজনশীল চিন্তা করা, অবসর সময়ে উদ্দীপনামূলক লেখা পড়ে নতুন চিন্তা আহরণ করা; 

২২. সত্য মতকে সত্যরূপে গ্রহণ- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিত্তিহীন গুজব ও ‘মতের অরণ্য’ থেকে  বেরিয়ে এসে মূলধারার গণমাধ্যমের উপর নির্ভর করা যেন যথার্থ আনন্দ, গভীর তৃপ্তি, প্রকৃত সত্য আহরণ করা যায়;

২৩. ছুঁড়ে ফেলার সংস্কৃতি বর্জন- অর্থনীতি, উৎপাদন ও জিনিসপত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে- সংগ্রহ কর-চাহিদা পূরণ কর-ছুঁড়ে ফেলার (take-make-dispose) বর্তমানযুগে প্রচলিত উন্নয়নের মডেলের পরিবর্তে লাউদাতো সি'র অনুপ্রেরণা- পুনর্নবীকরণ-পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ-অন্যের সাথে সহভাগিতার (renew-remake-share) রূপান্তরশীল প্রক্রিয়া প্রচলন ও অনুুসরণ করা;

২৪. পবিত্র আহ্বান হিসেবে গ্রহণ- নিজের কল্যাণের কথা ভেবেই প্রকৃতি, পরিবেশ এবং প্রতিবেশীর সুরক্ষা সুসংবাদটি পবিবারের আপনজন ও বন্ধুবান্ধবদের জানানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই এটি পবিত্র একটি আহ্বান হিসেবে গ্রহণ করা যায়;

২৫. নিজের অংশগ্রহণটা অপরিহার্য- ইতোমধ্যে যদি ভাল কিছু করি তবে 'আরো ভাল' কিছু করতে চেষ্টা করি, যদি আরো ভাল কিছু করে ফেলেছি তবে 'উত্তম কিছু' করতে চেষ্টা করি, আর যদি উত্তম কিছু করে থাকি তবে 'অতি উত্তম কিছু' করার জন্য উদ্যোগ নিতে পারি;

২৬. অবিরত প্রার্থনা করি- যদি কিছুই করতে না পারি তবে পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে সরাসরি যারা জড়িত তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তেনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের জন্যেও প্রার্থনা করুন। দীনদরিদ্র মানুষ যারা অমানবিক ও অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন তাদের জন্য প্রার্থনা অব্যাহত রাখুন। এই বিশ্ব জানতেও পারেনা প্রার্থনায় যে কতো আশ্চর্য্য কাজ হয়!     

করোনাভাইরাস মহামারী শিখিয়েছে আমাদের আরও বেশি যতœবান ও রক্ষণাবেক্ষণ মনোভাব প্রয়োজন। পোপ মহোদয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা ‘লাউদাতো সি সপ্তাহ’ উদ্যাপন করছি। ইতোমধ্যে অনেকে নীরবে কাজ করে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করেছি। ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর পোপ ফ্রান্সিসের এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে আগামী ৭ বছর অবিরত বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করবে। আসুন, একসাথে, একত্রে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাসমূহ "অভিন্ন বসতবাটির সুরক্ষায় আমাদের আচরণবিধি" অনুসরণ করি তবেই মহান কিছু অর্জন সম্ভব হবে। ধরিত্রীর বুকে আনবে নতুন ছন্দ, জাগাবে নতুন আশা; ‘আমরা সবুজ, আমরা সুন্দর’ থাকি।



 পঞ্চাশত্তমী মহাপর্ব দিবস, রবিবার,  মে ২৩, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, লাউদাতো সি সপ্তাহ-২১

বুধবার, ১৯ মে, ২০২১

অধ্যয়ন, অনুধাবন ও অনুশীলন

 খ্রিস্টমণ্ডলীর কর্মনীতি বা কর্মকৌশল হলো  সদ্বিবেচনা বা বিবেক। সদ্বিবেচনা এমন একটি নৈতিক গুণ যা মঙ্গল-উদ্দেশ্য ও সঠিক পদ্ধতি জানার জন্য সাহায্য করে। সদ্বিবেচনার প্রক্রিয়ায় তিনটি ধাপ লক্ষ্যণীয়: (ক)  পরিস্থিতি জানা - “দেখা” (খ) যাচাই করা বা শুনা বা বিশ্লেষণ করা এবং (গ) কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া  বা কাজ করা।  সদ্বিবেবচনা এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে যা সঙ্গতিপূর্ণ, বাস্তবধর্মী ও দায়িত্বশীল।‌ আমরা যখন ‌'লাউদাতো সি সপ্তাহ -২১' পালন করছি তখন নিম্নের বিষয়সমূহ নিজেরা গভীরভাবে অনুধাবন এবং অনুশীলন  করে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার জন্য কিছু কিছু উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সপ্তাহটি অর্থপূর্ণ করতে পারি। 

(১) পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা- নিজের দেহ থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক, ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, সমাবেশস্থল, প্রভৃতির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা; 

(২) অপচয়রোধ- প্রয়োজন অতিরিক্ত খরচপাতি, জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার, ভোজনবিলাস ও অতি ভোগের মানসিকতা বর্জন ; 

(৩) দূষণমুক্ত পরিবেশ- শব্দ, বায়ূ, জল এবং সকল প্রকার দূষণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা; গণপরিহন ব্যবহার করা এবং পরিবহণের দূষণকারী কর্মক্রিয়া পরিত্যাগ করতে হবে; 

(৪) স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ- শাকসবজি, ফুল ও ফলের বাগান করা এবং খাবারের হিসেবে ব্যবহার করা। প্রকৃতিজাত, বিশুদ্ধ ও সুষম খাদ্য আহার ও পানীয় পান করা; মাংস গ্রহণ কমানো, পরিমিত পরিবেশন ও পরিমিত ভোগ, দেশীপণ্য ব্যবহার;

 (৫) সত্য মতকে সত্যরূপে গ্রহণ- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিত্তিহীন গুজব ও ‘মতের অরণ্য’ থেকে  বেরিয়ে এসে মূলধারার গণমাধ্যমের উপর নির্ভর করা যেন যথার্থ আনন্দ, গভীর তৃপ্তি, প্রকৃত সত্য আহরণ করা। সকলে সত্য মতকে অবিচল সত্যরূপে গ্রহণ করতে পারলে নানা প্রকার বিদ্রোহ, বিভ্রাট ও মনোবিকার যার ফলে সৃষ্ট এক ধরণের মানসিক আর্বজনা থেকে সমাজ রক্ষা পাবে এবং

(৬) ছুঁড়ে ফেলার সংস্কৃতি বর্জন- অর্থনীতি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে সংগ্রহ কর-চাহিদা পূরণ কর-ছুঁড়ে ফেলার (Take-Make-Dispose) বর্তমানযুগে প্রচলিত উন্নয়নের মডেলের পরিবর্তে লাউদাতো সি'র অনুপ্রেরণা- পুনর্নবীকরণ-পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ-অন্যের প্রয়োজনে সহভাগিতার (Renew-Remake-Share) রূপান্তরশীল প্রক্রিয়া প্রচলন ও অনুুসরণ করা। 

আসুন, একসাথে, একত্রে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাসমূহ অবিরত চালিয়ে যাই; ‘আমরা সবুজ, আমরা সুন্দর’ থাকি।



শনিবার, ১৫ মে, ২০২১

‘লাউদাতো সি সপ্তাহ’ - মে ১৬-২৫, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ

 LAUDATO SI WEEK 21, May 16-25, 2021

পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার উপর মে ২৪, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘লাউদাতো সি’ সর্বজনীন পত্রটি লিখেছেন। তাঁর আহ্বানে ‘লাউদাতো সি বছর’ (মে, ২০২০ থেকে মে, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ) পালনের সমাপ্তিতে মে ১৬-২৫, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ তারিখে ‘লাউদাতো সি সপ্তাহ’ উদযাপন হতে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারির এ অবরুদ্ধ সময়ে নিজের অবস্থানে থেকে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার জন্য কিছু কিছু উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থপূর্ণভাবে সপ্তাহটি উদযাপন করতে পারি। যেমন-

১. আমাদের জীবনযাপনে অপরিহার্য উপাদান (মাটি, বায়ু, আগুন, জল) নিয়ে গভীর মনোযোগ প্রদান করতে পারি; কিন্তু এসবই
এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং আমাদের সকলকেই ভাবিয়ে তুলছে; আমরা সবাই ভুক্তভোগী;

২. দীনদরিদ্র, দুর্বল ও দুঃখকষ্টে জর্জরিত মানুষের আর্তনাদে আরও অধিক মনোযোগ দিতে পারি;

৩. একটি আরও ন্যায়-সঙ্গত, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই অর্থনীতির প্রতি মনোযোগ দিতে পারি যা কাউকে পিছনে
ফেলে রাখে না;

৪. সহজ-সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ-জীবন গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কিছু কিছু বিষয়ে সচেতনতা লাভ করা যায়- (ক)
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, (খ) অপচয়রোধ, (গ) দূষণমুক্ত পরিবেশ, (ঘ) প্রকৃতিজাত, বিশুদ্ধ ও সুষম খাদ্য আহার ও পানীয় পান
করা;

৫. আমাদের অভিন্ন উৎপত্তি সম্বদ্ধে, আমাদের পারস্পরিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে এবং সম্পদসমূহ সবার সাথে সহভাগিতা করার
দায়িত্ব সম্বদ্ধে পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা, জ্ঞান ও সচেতনতা গ্রহণ করতে পারি;

৬. ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রকৃতির ধ্যানমগ্নতায় বিস্ময়বোধ, প্রশংসা, আনন্দ এবং কৃতজ্ঞতা অন্তরে অবিরত অনুভব করা; সৃষ্টি-কেন্দ্রিক
উপাসনা উদযাপনকে উৎসাহিত করা এবং পরিবেশগত ধর্মশিক্ষা, প্রার্থনা, নির্জনধ্যান ও মানব গঠন কার্যক্রম আয়োজন
করা যায় এবং

৭. এ সংকটকালে একযোগে এই ধরিত্রীকে বাঁচানোর চিন্তায় মনোযোগী হওয়া ও অংশগ্রহণমূলক বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ খুবই
প্রাসঙ্গিক ভাবনা।
আসুন, একসাথে, একত্রে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাসমূহ অবিরত চালিয়ে যাই; ‘আমরা সবুজ, আমরা সুন্দর’ থাকি।



শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১

খ্রিস্ট জীবন্ত : আমাদের আশা, আমাদের মনোবল

১. পুনরুত্থান পর্বের প্রস্তুতিতে আমরা ধ্যান করতে চেষ্টা করেছি- যিশু খ্রিস্ট আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন উপবাস, প্রার্থনা এবং দান কর্ম আমাদের মন পরিবর্তনকে সম্ভব ক’রে তোলে, অন্যদিকে এসব আমাদের মন পরিবর্তনের চিহ্নও (মথি ৬:১-১৮)। উপবাসের মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত হই, প্রার্থনায় অন্তরে আশার আলো দেখতে পাই এবং দান-কর্মে মাধ্যমে ‘যত্নের সংস্কৃতি’ চর্চা করতে পারি। ফলে নিজে রূপান্তরিত হয়ে অন্যকে রূপান্তরিত হতে অনুপ্রাণিত করি। জীবনযাপনে প্রার্থনা, ধ্যান, উপাসনা ও সংস্কারীয় জীবনের প্রতি অনুরাগ ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে; খ্রিস্টিয় বিবাহ, যাজকীয় ও সন্ন্যাসব্রতী জীবনের আহ্বান সম্পর্কে নবচেতনা ও নবজাগরণ ঘটবে; ধর্মশিক্ষা গ্রহণে ও দানে নিষ্ঠতা বাড়বে; সামাজিক জীবনের সম্পৃক্ততা বাড়বে; দয়াকর্ম, সাংস্কৃতিক ও আধ্যত্মিক কর্মকাণ্ডের জন্য নতুন উদ্যোগ ও চেতনা সৃষ্টি হবে এবং খ্রিস্টবিশ্বাসে যাদের স্খলন ঘটেছে, তারা আবার খ্রিস্টীয় জীবনে ও মণ্ডলীর মিলন-সংযোগে ফিরে আসে। ফলে আমাদেরকে নিখাঁদ বিশ্বাস, জীবন্ত আশা এবং কার্যকরী দানশীলতার জীবন যাপনে সমর্থ ক’রে তোলে।

২. এ বছরের পুনরুত্থান পর্বটিও আমাদের নিকট যিশুর প্রথম শিষ্যদের অভিজ্ঞতার মতোই। করোনাভাইরাসের 'ধ্বংস ও মৃত্যুর আক্রমণ' দুর্বল হয়েও আবার নতুনভাবে সংক্রমণ শুরু ফলে সাধারণ জনগণের মনে অনিশ্চয়তা ও সংশয় বাড়ছে। যিশুর মৃতদেহ সমাধিগুহায় শুইয়ে রেখে শিষ্যদের কারও কারও মনের মধ্যে অনিশ্চয়তা, সংশয় ও সন্দেহ ছিল (মথি ২৮: ১৭)। তবে কয়েকজন নারীর একটি ক্ষুদ্রদল সক্রিয় ছিল; যিশুর মৃত্যু তাদেরকে হতাশায় পঙ্গু করে ফেলেনি। বরং তারা একটি সাধারণ কাজ অসাধারণভাবে করেছে। তারা যিশুর পবিত্র দেহে গন্ধদ্রব্য লেপনের কাজটি আরও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য সুগন্ধি-মশলা প্রস্তুত করে নিয়ে এসেছে। গত বছর নিস্তার জাগরণীর অনুধ্যানে পোপ ফান্সিস বলেছেন- "তারা তাদের ভালবাসার দুয়ার বন্ধ করে রাখেনি; তাদের অন্তরের অন্ধকারে দয়ার শিখা প্রজ্জলিত রেখেছে।" আমাদের ভাবতে হবে- আমাদের জীবনের অশ্চিয়তা, সংশয় ও সন্দেহের মুহূর্তে আমরা কি ভয়ে ভালবাসার দূয়ার বন্ধ রেখেছি? অভাবী ও বিপদাপন্ন ভাইবোনদের সেবাযত্নের জন্য আমি কীভাবে গন্ধদ্রব্য, সুগন্ধি-মশলা নিয়ে প্রস্তুত আছি?

৩. যিশুকে সমাধিগুহায় রেখে যিশুর মা একটি নতুন সূর্যকিরণ, একটি নতুন দিন দেখার আশা নিয়ে প্রার্থনারত সময় কাটিয়েছেন। তিনি আজ আমাদের সকলের 'মা' । পোপ মহোদয় একটি অনুধ্যানে বলেছেন- “যিশুর দেহটি মাটিতে  শোয়ানো বীজ যিনি পৃথিবীকে নতুন জীবন দান করবেন এবং মা মারীয়া প্রার্থনা ও ভালবাসা দ্বারা এই আশাটি প্রস্ফুটিত হতে সহায়তা করেছেন।” প্রার্থনা আমাদের জন্য একটি অন্যতম আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন সময় অভিজ্ঞতা করছি। একটি অন্ধকার ও বিরক্তকর অভিজ্ঞতা যা আমাদের কাছে অভিশাপের মত হতে পার। ঐ মুহূর্তে প্রার্থনা আমাদের জীবনে গভীর অভ্যন্তরীণ রূপান্তর আনে, শান্তির সূচনা করে। এমন কী কিছু সময় পরে অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আর্শীবাদের অভিজ্ঞতা করতে পারি। এই অবরুদ্ধ সময়ের দুর্গতিতে আমারা চিন্তা করি- আমরা কতটা সময় প্রার্থনায় কাটিয়েছি, আমরা কতটুকু আশা ও মনোবল নিয়ে মা-মারীয়ার মত সবকিছু নতুন স্বাভাকিতায় গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে আছি? পরিবারে কীভাবে প্রার্থনারত জীবনযাপন করছি?

৪. এই দিনেই ‘আশা’ পৃথিবীতে প্রবেশ করে। যিশুর সাথে নারীদলটির সাক্ষাৎ ঘটে। তারা বুঝেছেন যিশুর মৃত্যু তাঁর মহিমা-লাভের সোপান মাত্র। যিশুর কথা শুনে তাদের অন্তরে আশা ও মনোবল আগুনেরই মতো আবার জ্বলে উঠেছে।  পোপ ফান্সিস বলেছেন- “ভয় করো না, ভয় পেও না -এই আশার বার্তাটি আজ আমাদের কাছেও এসেছে। একই বাক্য ঈশ্বর আমাদের জন্য দিয়েছেন।” পোপ মহোদয় আরো বলেছেন- “আশা করাটা আমাদের অধিকার। ভোরের আলোর সাথে সাথেই ‘আশা’ পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে।” একদল নারীই 'আশা'র বার্তাটির প্রথম দূত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিল। এটি নৈরাশ্যের হাত থেকে আমাদের উদ্ধারের এক বার্তা, আমাদের মনে কি আনন্দ, কি ভক্তির উচ্ছ¡াস- কীভাবে তা প্রকাশ করছি? অতিভোগ, অতিউৎসব, অতিপরিবেশন ও পানাহার অথবা আমাদেরকে নিখাঁদ বিশ্বাস, জীবন্ত আশা এবং কার্যকরী দানশীলতার জীবন যাপনে সমর্থ ক’রে তোলচ্ছে। 

৫. পুনরুত্থানেরই একটি ঐশদান- 'আশা'। সবকিছুর শেষে অশুভকে পরাজিত করে শুভ জয়ী হবে এমন আশাবাদ এটি নয়। বরং এটি পিতা ঈশ্বরের কাছ থেকে আগত অনুগ্রহদান ‘আশা’। এটি একটি ঐশদান যা আমরা নিজেরা অর্জন করিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বলে থাকি আগামী সপ্তাহ বা কয়েকদিনের মধ্যে করোনাভাইরাস বাহাদুরি সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে করতে শুরু করেছি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে কিন্তু বিগত সপ্তাহগুলোতে আমরা অভিজ্ঞতা করেছি, সময় অতিবাহিত হয়েছে তথাপি আমাদের এমন আশাবাদ অর্থহীন প্রমাণিত। যিশুর প্রদত্ত আশা ভিন্ন সংবাদ দেয়। তিনি আমাদের অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস দিয়েছেন, ঈশ্বর সমস্ত কাজের সমাপ্তিতে ভালো কিছু সমাধান দিবেন। কারণ ‘কবর’ থেকেও তিনি ‘জীবন’ ফিরিয়ে এনেছেন। এই দুর্যোগের পরে পরিবেশ আরো ভাল হবে, তিনি আমাদের পরিচালনা করবেন। “ঈশ্বর যিনি শূণ্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তিনি পৃথিবীতেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন এবং সব ধরণের অমঙ্গলকে পরাস্ত করতে পারেন। অন্যায্যতা অজেয় নয়” (লাউদাতো সি - ৭৪)। অফুরন্ত আশা, গভীর বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে পিতা ঈশ্বরে দান গ্রহণে অপেক্ষা করি। প্রার্থনা, দয়াকাজ ও ত্যাগম্বীকারের মাধ্যমে আমাদের বিশ্বাস, আশা ও ভালবাসা নবায়িত হতে দেই। 

৬. পোপ ফ্রান্সিস অনুধ্যানে বলেছন- “তিনি হৃদয়ের পাথরও সরিয়ে দিতে পারেন। একটি কবর থেকেই জীবন আবির্ভূত এটাই আমাদের আশা। যিনি এমন এক স্থান থেকে আবির্ভূত হয়েছেন, সেখান থেকে কেউ কখনও আবির্ভূত হয়নি- এটি কবর। যিনি সমাধির প্রবেশদ্বার বন্ধ করার পাথরটি সরিয়ে দিয়েছেন, এই দুর্যোগ সময়ে তিনি আমাদের ভারাক্লান্ত হৃদয়ের পাথরও সরিয়ে দিতে পারেন।” তিনি আমাদের ত্যাগ করেননি, তিনি আমাদের সাথে আবার সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি আমাদের বেদনা, যন্ত্রণা এবং মৃত্যুর মধ্যে প্রবেশ করেছেন। তাঁর আলো সমাধির অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আজ তিনি চান সেই আলো আামদের জীবনের অন্ধকারময় স্থানেও প্রবেশ করুক, কৃষ্ণকালো মেঘে ঢাকা বিশ্বেকে (দ্রষ্টব্যঃ ফ্রাটেল্লি তুত্তি) আলোকিত করুক। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে অস্বস্তিকর ও গুরভার দুশ্চিন্তা জয় করা য়ায়- “শান্ত-সমাহিত অনুভূতি নিয়ে জীবনকে দেখা, প্রতিটি মুহূর্তকেই ঈশ্বরের দান বলে গ্রহন করা (লা. সি.- ২২৬)। আমরা নিজেদের সমস্যার পাথর সরিয়ে দিতে খ্রিস্ট যিশুর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি, বারে বারে তাঁকে অনুরোধ করি, তিনি আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না। ‘ফ্রাটেল্লি তুত্তি’ প্রৈরিতিক পত্রে পোপ ফ্রান্সিস বাইবেলে বর্ণিত দয়ালু সামারীয়র উপমা কাহিনী ধ্যান করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন- আমরা যা অভিজ্ঞতা করি, এই কাহিনী তার মধ্যে একটা উজ্জ্বল আলোকরশ্মির মতো বিরাজ করছে। এই উপমা কাহিনী আমাদের স্মরণ ক’রে দেয় যে, পরিবারে যে স্বাভাবিক ভালোবাসার অভিজ্ঞতা হয়- তা আমরা অচেনা মানুষদের প্রতিও দেখাতে পারি। এই ভালোবাসা আমরা ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে প্রকাশ করে পরিবারভূক্ত হয়ে উঠতে পারি। ভ্রাতৃবোধ ও সামাজিক বন্ধুত্ব নবায়ন করে আমরা একে অন্যের হৃদয়ের পাথর সরিয়ে দিতে পারি।

৭. দুর্গতিতে ‘মনোবল’ পুনরুত্থানের একটি অনুগ্রহদান। আমাদের হৃদয়ে রাখা পাথরটি সরিয়ে দিয়েই আমরা যিশুর মনোবল গ্রহণ করতে পারি। পুনরুত্থিত খ্রিস্ট আমাদের মনের গভীরের ভয়টি অনুভব করতে পারেন। পোপ মহোদয় বলেছেন- “খ্রিস্ট আমাদের সাহস দিচ্ছেন, তিনি আমাদের জীবন এবং আমাদের মৃত্যুতেও আমাদের সামনেই চলছেন। তিনি আমাদের আগে গালিলেয়া যাচ্ছেন,  সেখানে তাঁর ও শিষ্যদের প্রতিদিনের জীবন, পরিবার ও কাজের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কাজ-কর্মে আশা নিয়ে আসতে চান।” শিষ্যদের জন্য গালিলেয়া স্মৃতিময় স্থান কারণ এখানেই তাদের প্রথম আহ্বান করেছেন। গালিলেয়া ফিরে আসার অর্থ তিনি আমাদের প্রথম ভালবেসেছেন ও আহ্বান করেছেন। রবিবার হচ্ছে পুনরুত্থানের দিন, নতুন সৃষ্টির “প্রথম দিন” যেখানে ঈশ্বরের সাথে, নিজের সাথে, অপরের সাথে ও বিশ্বসৃষ্টির সাথে আমাদের সম্পর্ক নিরাময় হয় (লা.সি.- ২৩৭)। আমরা স্মরণ করি- প্রথমবার কোথায় যিশুর আহ্বান পেয়েছি, প্রথমবার কখন বুঝেছি তিনি আমার পাশেই আছে, প্রথমবার যখন খ্রিস্ট প্রসাদ গ্রহন করেছি তখনকার অভিজ্ঞতা স্মরণ করি এবং আজও এ দুর্গতিতে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি।

৮. তিনি আমাদের আজ জগতের সর্বত্র প্রেরণ করছেন (মথি ২৮:১৯)। পোপ মহোদয় বলেছেন- “তিনি আমাদের শুধু পবিত্র স্থান গালিলেয়া নয় বরং পৃথিবীর সর্বত্র প্রেরণ করছেন।  আমরা যেখানে বসবাস করি সেখানেই তিনি আমাদের প্রেরণ করছেন।” তিনি চান তাঁর প্রতি বিশ্বাসী যারা সকলের নিকট আমরা ‘জীবনের মঙ্গলবার্তা’ পৌঁছে দেই। আমরা যারা জীবন বাণী অভিজ্ঞাতা করেছি তারা যদি জীবনের কথা না বলি তবে কে বলবে? খ্রিস্ট জীবন্ত। “তিনি কখনো আমাদের প্রত্যাখ্যান করেন না, তিনি আমাদেরকে একা ফেলে রেখে যান না, কেননা তিনি নিশ্চিতরূপে আমাদের এই পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন এবং তাঁর সেই ভালবাসা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন পন্থা খঁজে পাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দান করে” (লা. সি.- ২৪৫)। আসুন, এই যাত্রা পথে আমরা সুর মিলিয়ে গান করি। আমাদের এই কষ্টের যাত্রা, আমাদের এই সংগ্রামের যাত্রা যেন প্রত্যাশিত আনন্দ বিনষ্ট করতে না পারে। তিনিই আমাদের আশা, তিনিই আমাদের মনোবল। জয় মৃত্যুঞ্জয়, জয় তোমারই জয়।




প্রকাশিত: সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, সংখ্যা ১২, ৪-১২ এপ্রিল, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ



সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১

কারাবন্দিদের মঙ্গলবার্তা


১. গতবছর পুণ্য শুক্রবারে ধর্মগুরু পোপ ফান্সিস কারাবন্দিদের সাথে আধ্যাত্মিক একাত্মতায় ক্রুশের পথ ধ্যান করেছেন। পোপ মহোদয় যিশুর ক্রুশের পথ অনুধ্যান লেখার জন্য আঠারোজনকে আমন্ত্রণ করেছেন। তারা নিজের জীবন অভিজ্ঞতা অনুধ্যান করেছে। আমন্ত্রিতদের মধ্যে পাঁচজন বন্দি, একটি পরিবার যারা হত্যার শিকার হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত একজন বন্দির কন্যা, কারাগারের একজন শিক্ষক, একজন সিভিল ম্যাজিস্ট্রেট, একজন বন্দির মা, একজন কারা ধর্মশিক্ষক, একজন  স্বেচ্ছাসেবক, একজন কারারক্ষী এবং একজন যাজক যিনি আট বছর বন্দি থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কারা অন্ধকারে থেকেও ভাল চোরের মত খ্রিস্টকে অভিজ্ঞতা করার ফলে এক মুহূর্তে জীবন আলোতে উদ্ভাসিত হতে পারে। ঈশ্বরে যাদের অগাত বিশ্বাস, পবিত্র আত্মার প্রদত্ত আশায় যারা পথ চলে তারাই হৃদয় গভীওর ভালবাসার আলোটি দেখতে পায়। এমনকি কারা অন্তরীণে অন্ধকারেও একটি আশার বাণী শোনতে পায়  “কারণ পরমেশ্বরের অসাধ্য কিছুই নেই” (লুক ১:৩৭)। আসুন তাদের খ্রিস্ট যিশুর অভিজ্ঞতা শুনি। 

২. যাবজ্জীবন কারদণ্ড প্রাপ্ত একজন বন্দি ২৯ বছর যাবৎ কারা অন্তরীণে। তার অনুধ্যান- যখন আমাকে আদালত কক্ষে আনা হয়েছে তখন 'ওকে ক্রুশে দাও, ক্রুশে দাও' এ চিৎকার শুনেছি। আবার খবরের কাগজ ও টেলিভিশন সংবাদে একই শ্লোগান আমি শুনতে পেয়েছি। আমি দোষী আর যিশু নির্দোষ ছিলেন। বাবার সাথে আমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আছি। কিন্তু শৈশবে চলার পথে পাবলিক বাসে, শ্রেণিকক্ষে ধণীর ছেলেরা আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে দিনের পর দিন কারণ আমি গরীব। তাদের দ্বারা আমি মানসিক নির্যাতদের শিকার হয়েছি, আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তারা অভিযুক্ত হয়নি, তাদের দণ্ড হয়নি। স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যা ছিল তাই প্রচুর অবজ্ঞা পেতে হয়েছে। তাই শৈশব থেকেই আমি ক্রুশবিদ্ধ। যিশুর যাতনাভোগের কাহিনী পড়ে ২৯ বছর পরেও আমি চোখের জল ফেলে কাঁদতে পারি। আমার সৌভাগ্য- আমার চোখের জল শেষ হয়ে যায়নি, লজ্জাবোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলিনি। যিশুর ক্রুশ যাতনাভোগ কাহিনী পড়ে আমি কখনও নিজেকে বারাব্বাস, কখনও পিতর এবং কখনও যুদাস অনুভব করে থাকি। কৃষ্ণকালো মেঘের পরে কররদ্রোজ্জ্ব দুপুরের আশায় জীবন এখনও প্রবাহমান। আমি খ্রিস্ট যিশুর সঙ্গে পুনর্মিলিত হতে চাই (২করি. ৫:২০)।

৩. একটি পরিবারের মা যাদের মেয়ে নির্দয়ভাবে হত্যার শিকার হয়েছে। সে অনুধ্যান করেছে- অন্যমেয়েটি কোনোভাবে প্রাণ রক্ষা  পেয়েছে কিন্তু মিষ্টি হাসি বিনষ্ট করে দিয়েছে। খুনী এখন কারাগারে বন্দি। সময় চলে যায় কিন্তু ক্রুশের ভার কমে না। কন্যাকে ভুলতে পারি না, সে আমার সাথে থাকতে পারত কিন্তু এখন নেই। আমরা এখন বৃদ্ধ, বাড়িতে দিন দিন বিপদাপন্ন সময় আসছে। তবে হতাশাগ্রস্থ সময়ে যিশু বিভিন্ন উপায়ে আমাদের কাছে এসেছেন। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে আরো ভালবাসতে, আরো সমর্থন করতে অনুগ্রহ পেয়েছি। যিশু আমাদের বাড়ির দরজা দরিদ্র ও হতাশাগ্রস্থদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে আহ্বান করেন। আমরা সাড়া প্রদান করি, আবার মানবকল্যাণ কাজ করতে শুরু করি। আমরা মন্দের কাছে আত্ম-সমর্পণ করতে চাই না। দয়া কাজের মাঝে বারে বারে মেয়েকে খুঁজে পাই। ঈশ্বরের ভালবাসায় সত্যই জীবন পুনর্নবীকরণ সম্ভব। তাঁর পুত্র যিশু মানুষের দুঃখ লাঘব করতে যন্ত্রণা সহ্য করেছেন।

৪. একজন বন্দি যিশুর মাটিতে পতন অনুধ্যান করেছে- আমার প্রথম পতনটি আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলাম; পৃথিবীতে ভাল বলতে কিছু আছে বুঝিনি। দ্বিতীয়টিতেও আমি বুঝিনি খুনের একটি পরিণতি আছে কারণ আমি ইতিমধ্যে বিবেকের ভিতরে মারা গিয়েছি। আমি বুঝতে পারিনি ধীরে ধীরে আমার ভিতরেও মন্দতার ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। কৃষ্ণকালো অন্ধকার মেঘ আমার জীবনকে ঘিরে ফেলেছে এবং যখন-তখন ভয়ানক টর্নেডো হানা দিতে যাচ্ছে। ক্রোধ আমার দয়াশীলতা মেরে ফেলে, আমি জঘন্য মন্দ কাজ করে ফেলি। কারাগারের অন্যের খারাপ আচরণ আমাকে আত্ম-বিশ্লেষণ করতে শেখায়- আমার পরিবারকে আমি নষ্ট করে দিয়েছি। আমার কারণে তারা সুনাম, সম্মান ও মানবিক মর্যাদা হারিয়েছে। আমার পরিবার এখন ‘খুনির পরিবার’। এখন আমার শাস্তিটি শেষ পর্যন্ত ভোগ করতে চাই। কারণ কারাগারে আমি এমন লোকদের খুঁজে পেয়েছি যারা আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি অতিশয় অপরাধী জেনেও দেখতে আসে, আশার কথা শুনায়, আমাকে ভালবেসে আলিঙ্গন করে ও খ্রিস্টকে গ্রহণ করতে সুযোগ করে দেয়।

৫. অন্য একজন বন্দির অনুধ্যান- আমার প্রথমবার পতন হয়েছে যেদিন মন্দ আমাকে আকৃষ্ট করেছে, মাদকদ্রব্যগুলো বাবার প্রতিদিন ১০ ঘন্টা পরিশ্রমের চেয়ে বেশী মূল্যবান ছিল। দ্বিতীয় পতন ছিল- যখন পরিবারকে ধ্বংস করেছি। মা এখন তার ছেলেকে দেখতে আসে, কিন্তু বন্দিকে নয়, মায়ের এমন মন আগে বুঝিনি। এখন বুঝতে শিখেছি, মায়ের চোখে তাকিয়ে দেখেছি মা সমস্ত লজ্জা নিজে গ্রহণ করেছে। বাবার মুখে তাকিয়ে দেখেছি বাবা গোপনে ঘরে একা বসে কেঁদে কেঁদে সময় পার করছে। 

৬. একজন বন্দির মায়ের অনুধ্যান- আমার ছেলের পাপের জন্য আমি নিজে দোষী। আমি আমার নিজের দায়বন্ধতার জন্যও ক্ষমা চাচ্ছি। আমি প্রার্থনা করি আমার সন্তান অপরাধের মূল্য পরিশোধ করে আমার কাছে নবজীবনে ফিরে আসবে। আমি অবিরাম প্রার্থনা করি- একদিন আমার সন্তান রূপান্তরিত মানুষ হয়ে উঠবে। ঈশ্বরকে, নিজেকে এবং অন্যদের ভালবাসতে শিখবে। মা মারীয়ার মতো আমি নিজেই কালভেরির পথে অভিজ্ঞতা করেছি, সন্তান যখন গ্রেপ্তার হয় সেদিন আমাদের পরিবারের পুরো জীবনটা বদলে গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া ছেলের পিছনে পিছনে মা-মারীয়ার মত দীর্ঘপথ হেঁটেছিলাম। আপন বাড়িতে ছেলের সাথে আমরাও কারাগারে বন্দি আছি । মানুষের মন্তব্য একটি ধারালো ছুরির মতো হৃদয়কে বিদীর্ণ করে, হৃদয়ে সবকষ্ট সহ্য করছি কিন্তু তাকে কখনও ত্যাগ করিনি।

৭. একজন বন্দির অনুধ্যান- আমি যেদিন কারাগারে প্রবেশ করেছি আর সেদিন কারাগার আমার বাড়িতে প্রবেশ করেছে। আমি আমার শহরে সমাজের জঘন্য ব্যক্তি হয়েছি। সকলে আমাকে খুনি হিসেবে ডাকে, কি দুর্ভাগ্য আমার নামটিও হারিয়েছি। আমি কারাগারে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, আমি যারা কারাগারে সেবাকাজ করতে আসে সেই চ্যাপলেইনদের মধ্যস্থতায় আবার বাচঁতে শিখেছি। আমার বন্দি সঙ্গিরা আমার ক্রুশ বহন করে সাইরিনির সিমোনের মত সাহায্য করছে। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমি অন্যকে বিশ্বাস করতে সক্ষম হব। কাউকে না কাউকে সুখী করতে অন্যের ক্রুশ বহন করে সাইরিনির সিমোন হয়ে উঠব।  

৮. একজন বন্দির কিশোরী কন্যার অনুধ্যান- আমি একজন বন্দির মেয়ে, আমি বাবার ভালবাসার অভাব অনুভব করি। আমার মা হতাশার শিকার কারণ অনেক বছরপূর্বে বাবা কারাবন্দি, সংসার ভেঙে পড়েছে, খুব বেশি আর্থিক সংকট। আমি অল্প বেতনের কাজ শুরু করি, পরিস্থিতি আমাকে প্রাপ্তবয়স্কের অভিনয় করতে বাধ্য করেছে। বাবার পরিণতির জন্য বাড়িতে সমস্ত কিছু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে আছে। যাদের বাবা যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ হয়েছে কেবল তারাই বুঝে। যতদূরের কারাগারেই স্থানান্তর করা হোক সেখানেই গিয়ে বাবার সাক্ষাৎ করি। যদি কারাগার কয়েকশ কিলোমিটার দূরেও হয়। আমি এখন বলি-‘এটাই জীবন।’ শুধু বাবার ভালবাসার কারণে আমি তার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। এই আশা করাটা আমার অধিকার।

৯. অন্য একজন বন্দির অনুধ্যান- আমি কারাগার থেকেই ঠাকুরদাদা হয়েছি। আমার মেয়ের বিয়ে, গর্ভাবস্থা কিছুই দেখেনি। একদিন নাতনীকে আমার জীবনের গল্প শোনাব। আমার মন্দ কাজের গল্প নয়, হতাশার গল্প নয়, দুর্ভোগের গল্প নয়। তবে আমার বিশ্বাসের গল্প। আমি যখন বিশ্বের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলাম, একাকী মনে করেছি, ভেবেছি জীবনে অর্থ নেই, প্রায় যিশুর মত বারে বারে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম। নাতনীকে বলব- এমন সময় তোমার জন্ম সংবাদ আমাকে ঈশ্বরের নিকট ফিরে আসতে সাহায্য করেছে। আমি বুঝতে আরম্ভ করেছি ঈশ্বর আমাকে এখনও কত ভালবাসেন। জীবনটা কত সুন্দর, তিনি কত সুন্দর উপহার আমাকে দিয়েছে। আমি ঈশ্বরের দান নাতনীকে সত্যিই কোলে জড়িয়ে নিব একদিন, এমন আশা আমি করতেই পারি। তাকে বলব- তুমি আমার দেবদূত।

১০. আট বছর বন্দিজীবন থেকে মুক্ত একজন যাজকের অনুধ্যান- যত লজ্জাই আসুক না কেন, এক মুহূর্তের জন্য আমি সব শেষ হয়ে যেতে দেইনি। আমি স্থির করেছি আমি সর্বদা যাজক থাকব। আইনের মাধ্যমে আমি আমার ক্রুশ কমাতে পারতাম কিন্তু আমি চেয়েছি সবটুকু ক্রুশ বহন করতে। আমি নিয়মিত বিচারকের কাজে সহযোগিতা করেছি। আমি যাজক হিসেবে কয়েক বছর ধরে যাদের  সেমিনারীতে পাঠিয়েছি তারা ও পরিবার আমার পাশে থেকে ক্রুশ বহন করতে সাহায্য করেছে। তারা নিয়মিত প্রার্থনা করেছ্, আমার চোখের অনেক অশ্রু মুছে দিয়েছে। আমি যেদিন পুরোপুরি মুক্তি পাই, আমি নিজেকে দশ বছর আগের চেয়ে বেশি সুখী মানুষ মনে করেছি। মুক্ত হয়ে আমি আমার জীবনে প্রথম ঈশ্বরের কাজের অভিজ্ঞতা করেছি। ক্রুশে ঝুলন্ত অবস্থায় আমি যাজকত্বের অর্থ আবিষ্কার করেছি। প্রতিটি কারাবন্দির জীবন হউক এক একটি মঙ্গলবার্তা, খ্রিস্ট যিশু আমাদের সঙ্গেই আছেন।



(প্রকাশিত: সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, ৭-১৩ মার্চ, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ)