শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১

সৃষ্টি উদযাপন কাল - ২০২১: আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার

সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, তোমার প্রশংসা হোক। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার্থে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালন করতে আহ্বান করেছেন। এই কালটির একটি বিশেষ তাৎপর্য হল ১ সেপ্টেম্বর (বুধবার) 'সৃষ্টির সেবাযত্নে বিশ্ব প্রার্থনা দিবস' পালনের মাধ্যমে শুরু হবে এবং ৪ অক্টোবর 'আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের পর্ব দিবস' উদযাপনের মাধ্যমে সমাপ্তি হবে। এবছর প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে 'আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' গ্রহণ করা হয়েছে। 

'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালনের একটি বিশিষ্ট সর্বজনীন অনু্প্রেরণা মাত্রা রয়েছে। এসময়ে আমরা পিছনে ফিরে তাকাই এবং  ধন্যবাদ জানাই প্যাট্রিয়ার্ক প্রথম দিমিট্রিওসকে যিনি ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে  বিশ্বের সকল পরিবার একত্রে আমাদের অভিন্ন বসতবাটির যত্ন ও সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা ও বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণের একটি মাস উদযাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন থেকে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' ও সর্বজনীন প্রেরণা সকলের মধ্যে বিদ্যমান বয়েছে। সকল পরিবারকে একত্রে সৃষ্টির জন্য প্রার্থনা, সৃষ্টির সেবাযত্ন বিষয়ক অনুধ্যান ও সৃষ্টি রক্ষণাবেক্ষণের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে একসাথে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' অর্থপূর্ণ করতে আহ্বান করেছেন। ধমৃগুরু পোপ ফ্রান্সিস গুরুত্বের সাথে জরুরীভিত্তিতে সৃষ্টির সঙ্গে ও একে অপরের সাথে সর্ম্পকের নিরাময় করতে বিশ্ব পরিবারকে উৎসাহিত করছেন এবং সকলকে একইভাবে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান করছেন "কেননা আমরা জানি যে, পরিবর্তন সম্ভব" (লাউদাতো সি, অনু. ১৩)।

ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন' নামক পুণ্য দপ্তর পুুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের আহ্বানকে সফলতা দান করতে আগামী ৭ বছর (২০২১-২০২৭ খ্রিস্টাব্দ) সময়কে 'লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম' ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে এবছর থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে ধরিত্রীর বাস্তুতন্ত্র অর্থাৎ ‘প্রকৃতি-পরিবেশ পুনরুদ্ধার দশক’ (২০২১-২০৩০ খ্রিস্টাব্দ) কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসময় জনগণ আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সম্মিলনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একটি আগামী অক্টোবর ১১-২৪ তারিখে চীনে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত 'জীববৈচিত্র্য বিষয়ক শীর্ষ-বৈঠক' ‘কপ-১৫’ (COP15); অপরটি আগামী নভেম্বর ১-১২ তারিখে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘ আয়োজিত 'জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক শীর্ষ-বৈঠক' ‘কপ-২৬’ (COP26)। ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর আশা করছে খ্রিস্টভক্তগণ প্রকাশ্যভাবে 'অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' বিষয়টি শীর্ষ-বৈঠকসমূহে নিজেদের মতামত জোড়ালোভাবে ব্যক্ত করবে। এ জন্য ‘সুস্থ ধরিত্রী, সুস্থ জনগণ আবেদন’ (Healthy Planet, Healthy People Petition) সংযুক্ত পত্রে স্বাক্ষর সংগ্রহে ‘লাউদাতো সি মূভম্যানট’ ও জোটসমূহ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, যা হবে আমাদের 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালনের একটি অন্যতম পদক্ষেপ। 

এসময়ে ‘লাউদাতো সি’ সর্বজনীন পত্রটির ৭টি লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায় করা হবে। লক্ষ্যসমূহ হল- জগতের আর্তনাদে সাড়াদান, দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান, পরিবেশগত অর্থনীতি বিস্তার, সহজ-সরল জীবনধারা, পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক শিক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ উদ্দীপ্ত আধ্যাত্মিকতা এবং সমাজকে সম্পৃক্তকরণ ও অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি। লক্ষ্য অর্জনের জন্য  গোটা মণ্ডলীকে সাতটি কর্মক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- পরিবার, ধর্মপল্লী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ক্লাবসমূহ, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় সংঘসমূহ ইত্যাদি। করোনাভাইরাস শিখিয়েছে মানুষ সচেতন হয়ে ‘স্বভাব’ পালটাতে পারলে পরিবর্তন সম্ভব।  আমাদের অভিন্ন বসতবাটির অবনতির বিষয়টি আমাদের জীবনধারা পরিবর্তন করার দাবি জানায় ফলে মানব পরিবারের আচরণে আমূল পরির্তনের জরুরি প্রয়োজন (লাউদাতো সি, অনু. ২০৬, ৪)। 

কাথলিক মণ্ডলী ও কারিতাস একত্রে ৭ লাখ বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিগত বছর ব্যক্তিগত ও সমবেত উদ্যোগে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী ও প্রাপ্তবয়স্ক অনেকে সৃষ্টির সেবাযত্নে নিয়মিত প্রার্থনা, ভার্চুয়াল সভা-সেমিনার, লেখালেখি, বন ও বসতবাটি রক্ষণাবেক্ষণে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন (বিশেষভাবে ময়মনসিংহ ও সিলেট), বৃক্ষরোপণ, করোনাভাইরাস মহামারীতে দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান, নিজ নিজ বসতবাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাগান করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ, আবর্জনা সঠিক ব্যবস্থাপনা, দূষণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা, ব্যয় সংকোচন, ঋণ পরিশোধ এবং জৈবসুরক্ষাসহ বহুবিধ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে কেউ কেউ সহভাগিতা করেছেন। আমাদের অভিন্ন বসতবাটির সেবাযতত্ন ও ফলপ্রসূতা নিশ্চিত করতে বিগত দিনগুলোতে আপনাদের বহুবিধ সৃজনশীল উদ্ভাবন উদ্যোগ ও উপায়ের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর আশা করছে পোপ ফ্রান্সিস এর আহ্বানে প্রতিটি ডাইয়োসিস ও ধর্মপল্লী বহুবিধ সৃজনশীল উদ্ভাবন  উদ্যোগ চলমান রাখবে-

১. সেপ্টেম্বর ১ তারিখ বুধবার ‘সৃষ্টির সেবাযযত্নে বিশ্ব প্রার্থনা দিবস’ এবং 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' (১ সেপ্টেম্বর - ৪ অক্টোবর) সৃষ্টি জন্য  প্রার্থনা করতে পারি। এই প্রার্থনা পরিবার, ক্ষুদ্র দল, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মপল্লী, ধর্মব্রতীদের গৃহ, সেমিনারি,  সংগঠন এবং সর্বজনীন হতে পারে;

২. যাজকগণ প্রতিটি ধর্মপল্লীতে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' এর প্রতি রবিবার দিন (সেপ্টেম্বর ৫, ১২, ১৯, ২৬, অক্টোবর ৩ এবং ৪ আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের পর্ব দিবস) পবিত্র খ্রিস্টযাগের উপদেশে বিশেষ সহভাগিতা (‘আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার’) করতে পারেন;  

৩. আমাদের সবারই করণীয় আছে- নিজের ঘরের বাতিটা অকারণে না জ্বালানো, গাড়ি কম চালানো, অযথা মোটরসাইকেল না চালানো, গাছ লাগানো, বাগান করা, সৃষ্টির যত্ন নেয়া, পানি পরিমিত ব্যবহার করা, অযথা বিকট শব্দ না করা, নির্মল বায়ু সেবন করা, দূষণ বা নোংরামী থেকে বিরত থাকা ও জৈবসুরক্ষার মতো কাজগুলো সকলেই করতে পারি; 

৪. ক্ষুদ্র দলে সভা, সেমিনার, কর্মশালা ও তৃণমূল পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষার্থে বিভিন্ন কর্মসূচী- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গাছ লাগানোর অভিযান, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন, পরিবেশ বিষয়ক লেখালেখি বা পাঠ করা;

৫. সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- ’লাউদাতো সি’ পত্রটি কেবল ‘সবুজ প্রৈরিতিক পত্র নয়’ (green Encyclical) বরং একটি ‘সামাজিক প্রৈরিতিক পত্রও’ (social Encyclical)। তাই অশান্তি, কোন্দল, অন্যায্যতার মত বিভিন্ন নোংরামী নিরসন ও সংলাপ এবং দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদানে বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করা যায়;

৬. শীর্ষ-বৈঠক (কপ-১৫ ও কপ-২৬) দু’টিতে নিজেদের মতামত জোড়ালোভাবে ব্যক্ত করতে ‘সুস্থ ধরিত্রী, সুস্থ জনগণ আবেদন’ সংযুক্ত  পত্রে স্বাক্ষর প্রদানে মাধ্যমে শীর্ষ-বৈঠকসমূহে অবদান রাখতে পারি (Link: Healthy Planet, Healthy People Petition, Sign the petition);

৭. খ্রিস্টবিশ্বাসী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের হয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে প্রাবক্তিক ভূমিকা পালন করা এবং তাদের পক্ষে অ্যাডভোকেসি করা। আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের গণ-উদ্যোগসমূহকে জোরদার ও ইতিবাচকভাবে গণমাধ্যমসমূহে প্রচার, প্রকাশ ও সার্বিক সহযোগিতা করা দরকার। 

আমাদের এই ধরিত্রী কারও একার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, ধরিত্রী মূলত একটি যৌথ উত্তরাধিকার, যার সুফল ভোগ করার অধিকার সবারই আছে (লাউদাতো সি, অনু. ৯৩)। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এক বার্তায় জোর দিয়ে বলেছেন- ‌"আসুন, একসাথে কাজ করি, কেবলমাত্র আমরা এইভাবেই আমাদের ভবিষ্যতে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ ও টেকসই ধরিত্রী গড়তে সক্ষম হবো, এটাই আমাদের আশা। আসুন, আমরা আমাদের মাতৃভূমির যত্ন নিতে এগিয়ে আসি; ... আসুন, পৃথিবী এবং সৃষ্টির উপহারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই; আসুন, আমরা এমন একটি জীবনযাত্রা এবং এমন একটি সমাজের উদ্বোধন করি যা শেষ পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব ও  টেকসই পরিবেশ হয়। সবার জন্য আরও একটি সুন্দর ভবিষ্যত উপহার দিতে আমাদের সুযোগ রয়েছে। পিতা ঈশ্বরের নিকট থেকে আমরা একটি সুন্দর বাগান পেয়েছি, আমাদের  সন্তানদের জন্য আমরা একটি মরুভূমি রেখে যেতে পারি না।" আসুন, দায়িত্বপ্রাপ্ত ও নিবেদিতপ্রাণ অংশীজন হিসেবে বহুবিদ ও বিচিত্র সৃজনশীল উদ্ভাবন উদ্যোগ ও উপায়ে সৃষ্টিকর্তার অমূল্যদান 'আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' করতে অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন