শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১

সৃষ্টি উদযাপন কাল - ২০২১: আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার

সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, তোমার প্রশংসা হোক। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার্থে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালন করতে আহ্বান করেছেন। এই কালটির একটি বিশেষ তাৎপর্য হল ১ সেপ্টেম্বর (বুধবার) 'সৃষ্টির সেবাযত্নে বিশ্ব প্রার্থনা দিবস' পালনের মাধ্যমে শুরু হবে এবং ৪ অক্টোবর 'আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের পর্ব দিবস' উদযাপনের মাধ্যমে সমাপ্তি হবে। এবছর প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে 'আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' গ্রহণ করা হয়েছে। 

'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালনের একটি বিশিষ্ট সর্বজনীন অনু্প্রেরণা মাত্রা রয়েছে। এসময়ে আমরা পিছনে ফিরে তাকাই এবং  ধন্যবাদ জানাই প্যাট্রিয়ার্ক প্রথম দিমিট্রিওসকে যিনি ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে  বিশ্বের সকল পরিবার একত্রে আমাদের অভিন্ন বসতবাটির যত্ন ও সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা ও বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণের একটি মাস উদযাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন থেকে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' ও সর্বজনীন প্রেরণা সকলের মধ্যে বিদ্যমান বয়েছে। সকল পরিবারকে একত্রে সৃষ্টির জন্য প্রার্থনা, সৃষ্টির সেবাযত্ন বিষয়ক অনুধ্যান ও সৃষ্টি রক্ষণাবেক্ষণের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে একসাথে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' অর্থপূর্ণ করতে আহ্বান করেছেন। ধমৃগুরু পোপ ফ্রান্সিস গুরুত্বের সাথে জরুরীভিত্তিতে সৃষ্টির সঙ্গে ও একে অপরের সাথে সর্ম্পকের নিরাময় করতে বিশ্ব পরিবারকে উৎসাহিত করছেন এবং সকলকে একইভাবে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান করছেন "কেননা আমরা জানি যে, পরিবর্তন সম্ভব" (লাউদাতো সি, অনু. ১৩)।

ভাটিকানের 'মানব উন্নয়ন' নামক পুণ্য দপ্তর পুুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের আহ্বানকে সফলতা দান করতে আগামী ৭ বছর (২০২১-২০২৭ খ্রিস্টাব্দ) সময়কে 'লাউদাতো সি অ্যাকশন প্লাটফর্ম' ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে এবছর থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে ধরিত্রীর বাস্তুতন্ত্র অর্থাৎ ‘প্রকৃতি-পরিবেশ পুনরুদ্ধার দশক’ (২০২১-২০৩০ খ্রিস্টাব্দ) কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসময় জনগণ আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সম্মিলনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একটি আগামী অক্টোবর ১১-২৪ তারিখে চীনে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত 'জীববৈচিত্র্য বিষয়ক শীর্ষ-বৈঠক' ‘কপ-১৫’ (COP15); অপরটি আগামী নভেম্বর ১-১২ তারিখে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘ আয়োজিত 'জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক শীর্ষ-বৈঠক' ‘কপ-২৬’ (COP26)। ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর আশা করছে খ্রিস্টভক্তগণ প্রকাশ্যভাবে 'অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' বিষয়টি শীর্ষ-বৈঠকসমূহে নিজেদের মতামত জোড়ালোভাবে ব্যক্ত করবে। এ জন্য ‘সুস্থ ধরিত্রী, সুস্থ জনগণ আবেদন’ (Healthy Planet, Healthy People Petition) সংযুক্ত পত্রে স্বাক্ষর সংগ্রহে ‘লাউদাতো সি মূভম্যানট’ ও জোটসমূহ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, যা হবে আমাদের 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' পালনের একটি অন্যতম পদক্ষেপ। 

এসময়ে ‘লাউদাতো সি’ সর্বজনীন পত্রটির ৭টি লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায় করা হবে। লক্ষ্যসমূহ হল- জগতের আর্তনাদে সাড়াদান, দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান, পরিবেশগত অর্থনীতি বিস্তার, সহজ-সরল জীবনধারা, পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ক শিক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ উদ্দীপ্ত আধ্যাত্মিকতা এবং সমাজকে সম্পৃক্তকরণ ও অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি। লক্ষ্য অর্জনের জন্য  গোটা মণ্ডলীকে সাতটি কর্মক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- পরিবার, ধর্মপল্লী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ক্লাবসমূহ, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় সংঘসমূহ ইত্যাদি। করোনাভাইরাস শিখিয়েছে মানুষ সচেতন হয়ে ‘স্বভাব’ পালটাতে পারলে পরিবর্তন সম্ভব।  আমাদের অভিন্ন বসতবাটির অবনতির বিষয়টি আমাদের জীবনধারা পরিবর্তন করার দাবি জানায় ফলে মানব পরিবারের আচরণে আমূল পরির্তনের জরুরি প্রয়োজন (লাউদাতো সি, অনু. ২০৬, ৪)। 

কাথলিক মণ্ডলী ও কারিতাস একত্রে ৭ লাখ বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিগত বছর ব্যক্তিগত ও সমবেত উদ্যোগে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী ও প্রাপ্তবয়স্ক অনেকে সৃষ্টির সেবাযত্নে নিয়মিত প্রার্থনা, ভার্চুয়াল সভা-সেমিনার, লেখালেখি, বন ও বসতবাটি রক্ষণাবেক্ষণে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন (বিশেষভাবে ময়মনসিংহ ও সিলেট), বৃক্ষরোপণ, করোনাভাইরাস মহামারীতে দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান, নিজ নিজ বসতবাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাগান করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ, আবর্জনা সঠিক ব্যবস্থাপনা, দূষণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা, ব্যয় সংকোচন, ঋণ পরিশোধ এবং জৈবসুরক্ষাসহ বহুবিধ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে কেউ কেউ সহভাগিতা করেছেন। আমাদের অভিন্ন বসতবাটির সেবাযতত্ন ও ফলপ্রসূতা নিশ্চিত করতে বিগত দিনগুলোতে আপনাদের বহুবিধ সৃজনশীল উদ্ভাবন উদ্যোগ ও উপায়ের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ভাটিকানের ‘মানব উন্নয়ন’ নামক পুণ্য দপ্তর আশা করছে পোপ ফ্রান্সিস এর আহ্বানে প্রতিটি ডাইয়োসিস ও ধর্মপল্লী বহুবিধ সৃজনশীল উদ্ভাবন  উদ্যোগ চলমান রাখবে-

১. সেপ্টেম্বর ১ তারিখ বুধবার ‘সৃষ্টির সেবাযযত্নে বিশ্ব প্রার্থনা দিবস’ এবং 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' (১ সেপ্টেম্বর - ৪ অক্টোবর) সৃষ্টি জন্য  প্রার্থনা করতে পারি। এই প্রার্থনা পরিবার, ক্ষুদ্র দল, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মপল্লী, ধর্মব্রতীদের গৃহ, সেমিনারি,  সংগঠন এবং সর্বজনীন হতে পারে;

২. যাজকগণ প্রতিটি ধর্মপল্লীতে 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' এর প্রতি রবিবার দিন (সেপ্টেম্বর ৫, ১২, ১৯, ২৬, অক্টোবর ৩ এবং ৪ আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের পর্ব দিবস) পবিত্র খ্রিস্টযাগের উপদেশে বিশেষ সহভাগিতা (‘আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার’) করতে পারেন;  

৩. আমাদের সবারই করণীয় আছে- নিজের ঘরের বাতিটা অকারণে না জ্বালানো, গাড়ি কম চালানো, অযথা মোটরসাইকেল না চালানো, গাছ লাগানো, বাগান করা, সৃষ্টির যত্ন নেয়া, পানি পরিমিত ব্যবহার করা, অযথা বিকট শব্দ না করা, নির্মল বায়ু সেবন করা, দূষণ বা নোংরামী থেকে বিরত থাকা ও জৈবসুরক্ষার মতো কাজগুলো সকলেই করতে পারি; 

৪. ক্ষুদ্র দলে সভা, সেমিনার, কর্মশালা ও তৃণমূল পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষার্থে বিভিন্ন কর্মসূচী- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গাছ লাগানোর অভিযান, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন, পরিবেশ বিষয়ক লেখালেখি বা পাঠ করা;

৫. সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন- ’লাউদাতো সি’ পত্রটি কেবল ‘সবুজ প্রৈরিতিক পত্র নয়’ (green Encyclical) বরং একটি ‘সামাজিক প্রৈরিতিক পত্রও’ (social Encyclical)। তাই অশান্তি, কোন্দল, অন্যায্যতার মত বিভিন্ন নোংরামী নিরসন ও সংলাপ এবং দীনদরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদানে বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করা যায়;

৬. শীর্ষ-বৈঠক (কপ-১৫ ও কপ-২৬) দু’টিতে নিজেদের মতামত জোড়ালোভাবে ব্যক্ত করতে ‘সুস্থ ধরিত্রী, সুস্থ জনগণ আবেদন’ সংযুক্ত  পত্রে স্বাক্ষর প্রদানে মাধ্যমে শীর্ষ-বৈঠকসমূহে অবদান রাখতে পারি (Link: Healthy Planet, Healthy People Petition, Sign the petition);

৭. খ্রিস্টবিশ্বাসী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের হয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে প্রাবক্তিক ভূমিকা পালন করা এবং তাদের পক্ষে অ্যাডভোকেসি করা। আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের গণ-উদ্যোগসমূহকে জোরদার ও ইতিবাচকভাবে গণমাধ্যমসমূহে প্রচার, প্রকাশ ও সার্বিক সহযোগিতা করা দরকার। 

আমাদের এই ধরিত্রী কারও একার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, ধরিত্রী মূলত একটি যৌথ উত্তরাধিকার, যার সুফল ভোগ করার অধিকার সবারই আছে (লাউদাতো সি, অনু. ৯৩)। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এক বার্তায় জোর দিয়ে বলেছেন- ‌"আসুন, একসাথে কাজ করি, কেবলমাত্র আমরা এইভাবেই আমাদের ভবিষ্যতে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ ও টেকসই ধরিত্রী গড়তে সক্ষম হবো, এটাই আমাদের আশা। আসুন, আমরা আমাদের মাতৃভূমির যত্ন নিতে এগিয়ে আসি; ... আসুন, পৃথিবী এবং সৃষ্টির উপহারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই; আসুন, আমরা এমন একটি জীবনযাত্রা এবং এমন একটি সমাজের উদ্বোধন করি যা শেষ পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব ও  টেকসই পরিবেশ হয়। সবার জন্য আরও একটি সুন্দর ভবিষ্যত উপহার দিতে আমাদের সুযোগ রয়েছে। পিতা ঈশ্বরের নিকট থেকে আমরা একটি সুন্দর বাগান পেয়েছি, আমাদের  সন্তানদের জন্য আমরা একটি মরুভূমি রেখে যেতে পারি না।" আসুন, দায়িত্বপ্রাপ্ত ও নিবেদিতপ্রাণ অংশীজন হিসেবে বহুবিদ ও বিচিত্র সৃজনশীল উদ্ভাবন উদ্যোগ ও উপায়ে সৃষ্টিকর্তার অমূল্যদান 'আমাদের অভিন্ন বসতবাটি পুনরুদ্ধার' করতে অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। 'সৃষ্টি উদযাপন কাল' সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।




বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১

সমৃদ্ধ জীবনের আশা নিয়ে জীবনযাপন

সহজ-সরল অনাড়ম্বর অথচ সমৃদ্ধজীবনযাত্রা অনুশীলনের কিছু দিক হলো যেখানে আমরা অল্প নিয়েই তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকতে, যে সুযোগ-সুবিধা আসে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে, যা সহায়-সম্বল আছে তার প্রতি অনাসক্ত হতে এবং যা নেই তার জন্য দুঃখ ও বেদনাবোধ পোষণ না করতে শেখা (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২২২)। সহজ-সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে সমৃদ্ধজীবন গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কিছু কিছু বিষয়ে সচেতনতা নবায়ন করতে পারি; যা এখানে আলোচনা করা হয়েছে। 

১. পরিবারই জীবন-সংস্কৃতির প্রাণ- আমি যেখানে বসবাস করছি সেটা একটি পরিবার; আমাদের পরিবার হল সৃষ্টি ও প্রকৃতির একটি অংশ; পরিবারের আরো বেশী য্ত্ন নিব। পরিবার জীবন-সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের নিকট ঈশ্বরের মহামূল্যবান দান; এখানেই আমরা সমাদৃত হতে পারি, এখানেই আমরা সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি এবং এখানেই আমাদের মানবিক বৈশিষ্ট্য বিকশিত হতে পারে। পরিবারেই আমরা শিক্ষা পাই কিভাবে ভালবাসতে হয়, কিভাবে ভালবাসা পেতে হয়, কিভাবে জীবনকে শ্রদ্ধা করতে হয়, কিভাবে জিনিসপত্র মর্যাদার সাথে ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে নিয়ম-শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতা পালন করতে হয় এবং কিভাবে প্রকৃতি, প্রতিবেশীর ও দীনদরিদ্রদের প্রতি যত্নবান হতে হয়। পরিবারে একত্রে খাবারের সময়, অবসর সময়, বিনোদনের সময়, প্রার্থনার সময়, প্রকৃতিতে ঘুরাঘুরির সময়টুকু স্কুলের এক একটি পাঠদানকক্ষের মতই আমরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ রস আহরণ করি; তারপর অবিরত সমাজকেই ফলদান করি (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২১৩)। এখানেই আমরা অভিজ্ঞতা করি একার মধ্যে ঐক্য নেই, বহুকে নিয়ে সত্য ঐক্য সৃষ্টি হয়।

২. মিতব্যয়িতা ও স্বল্প নিয়ে সুখী হওয়া- স্বল্পতে সুখী হওয়াই হচ্ছে খ্রিষ্টীয় আধ্যাত্মিকতার বৈশিষ্ট্য; আমাদের আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মবেষ্টিত অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে  সকলের মঙ্গল চিন্তার অকৃত্রিম চেতনা বিস্তার করতে হবে। তাই সম্পদ ও কর্তৃত্বের বাহাদুরী এবং উদ্দেশ্যবিহীন আমোদ-প্রমোদ বর্জন করা, প্রয়োজন অতিরিক্ত খরচপাতি বর্জন করা, জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার রোধ করা, ভোজনবিলাস ও অতি ভোগের মানসিকতা ত্যাগ করে জীবনকে আনন্দপূর্ণ করে গড়তে পারি। একেবারে রিক্ততা জীবনের জন্য বেদনাদায়ক, আবার বহুলতায় সত্যিকারে আনন্দ হারিয়ে যায় কিন্তু বৈচিত্র্যের মাঝে জীবনের মূল ভাবটি খুঁজে পাওয়াই সুন্দরতম দিক।

৩. অপচয়রোধ ও ঋণ পরিশোধ- বর্তমান চরম ভোগবাদ বর্জন করে নিষ্প্রয়োজন বেঁচা-কেনার ঘূর্ণাবর্তে ফেঁসে না গিয়ে প্রয়োজন মাফিক কেনাকাটা পরিহার করে, যতটুকু প্রয়োজন শুধু ততটুকু খাবার রান্না ও পরিমিত ভোগ করে; প্রয়োজন অতিরিক্ত খরচপাতি বর্জন করে, জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার না করে, ভোজনবিলাস ও অতি ভোগের মানসিকতা বর্জন করে; বাড়িতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিভিশন, এসি, পানির কল, বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহারের পর বন্ধ রাখার সচেতনতার মধ্যমে ও অন্যকে সচেতন করে জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারি। ক্রেডিট ইউনিয়নসহ সকল প্রকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ঋণ গ্রহণ করে বিনোদন বা উৎসব অথবা বিনোমূলক ভ্রমন আয়োজন থেকে বিরত থাকে কষ্টার্জিত অর্থ অপচয়রোধ করতে পারি।

৪. যত্নবান হওয়ার সংস্কৃতি অনুশীলন- আমাদের নিজের স্বার্থপর গণ্ডি অতিক্রম ক’রে অপরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় এখনই। আমরা যদি সৃষ্টজীবের প্রতি প্রকৃত মর্যাদার স্বীকৃতি দেই, অপরের কল্যাণের কথা ভাবি, জীবনপত্রের প্রতি যত্নবান হই, অপরের দুঃখকষ্ট নিবারণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করি, আশেপাশের পরিবেশের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনার পূর্বেই রক্ষা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করি তখন আমাদের মর্যাদার স্বীকৃতি আমরা পাব। নিজের দেহ থেকে শুরু করে জামাকাপড়, ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, সমাবেশস্থল প্রভৃতির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা; সমন্বিত পরিবেশ সংক্রান্ত অবনতি রোধকল্পে সমাজ উপকৃত হবে এমন ‘যত্নবান হওয়ার সংস্কৃতি’ অনুশীলন করতে পারি। যদি আমরা আমাদের ভাইবোনদের জন্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের যত্নবান হতে ইচ্ছা করি তবে অপরের জন্য নিঃস্বার্থ দরদবোধ থাকা এবং সব ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মমগ্নতা প্রত্যাখ্যান করা একান্তই অপরিহার্য (অনুুরূপ-লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ  - ২০৮)।

৫. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ- ভোক্তাদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ থাকাটা কত প্রয়োজন তা বর্তমান অতি উৎপাদিত ও ভোগ্যপণ্যে ক্ষতিকারক রাসায়ানিক ব্যবহার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশনা থেকে সহজে অনুমান করা যায়। ক্রয়-বিক্রয় ও ভোগের সঙ্গে নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ সব সময়ই জড়িত থাকে। শাকসবজি, ফুল ও ফলের বাগান করা এবং খাবার হিসেবে ব্যবহার করা; প্রকৃতিজাত, বিশুদ্ধ ও সুষম খাদ্য আহার ও পানীয় পান করা; মাংস গ্রহণ পরিমিত করা, পরিমিত পরিবেশন ও পরিমিত ভোগ, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খাবারই রান্না করা, দেশীপণ্য ব্যবহার দিন দিন বাড়াতে পারি ফলে ভোক্ত হিসেবে নৈতিক আচরণ প্রকাশ করে জীবন সমৃদ্ধ করতে পারি। 

৬. দূষণমুক্ত পরিবেশ- একমাত্র অকপট গুণাবলীর চর্চা এবং অনুশীলন নিশ্চিত করতে পারলে সকলে নিঃস্বার্থভাবে পরিবেশ সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করতে প্রস্তুত থাকবে। তখনই শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, জল অম্লীকরণসহ সকল প্রকার দূষণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে। কিছু কিছু অভ্যাস নিজে আয়ত্ত করা এবং অন্যকে অভ্যস্থ হতে উৎসাহিত করা; যেমন- যেখানে সম্ভব যতটুকু সম্ভব হেঁটে চলাচলের অভ্যাস করা, সাইকেল ব্যবহার করা, দলগতভাবে গাড়ি ব্যবহার  করা, গণপরিহন ব্যবহার করা, পরিবহণের দূষণকারী কর্মক্রিয়া বর্জন করা, নিয়মিত তাপবর্ধক যন্ত্রটি কম ব্যবহার করে গরম কাপড় পরার অভ্যাস করা, টেকসই ও দেশীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা, প্লাস্টিক ও কাগজ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা, পানির ব্যবহার কমানো ও অপচয় করার অভ্যাস ত্যাগ করা, বর্জ পৃথক করা, নিষ্প্রয়োজন বাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া; খাদ্যসামগ্রী রান্না বা গরম করার সময় ব্যবহৃত জ্বালানির ধোঁয়া অত্যাধিক পরিমাণে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করার ফলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে এ বিষয়ে সচেতন থেকে কম সময় ধরে ব্যবহার করা; কীটনাশক, সার, ছত্রাকনাশক, উদ্ভিদনাশক এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিষাক্ত দ্রব্য যা মাটি ও পানির অম্লীকরণের করে তা পরিহার করে এবং এ ধরণের অন্যান্য অনেক দিকে সচেতন হওয়া ও অন্যকে সচেতন হতে সহায়তা করা। এসব কিছুর মধ্যে প্রতিফলিত হয় উদার ও মর্যাদাসম্পন্ন সৃজনশীলতা এবং যার মাধ্যমে মনুষ্যত্বেও শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রকাশ ঘটে (অনুরূপ- লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২১১)।

৭. চারটি ‘পি’ (Four P’s)- ‘লাউদাতো সি’ পত্রটির নিবিড় সমন্বয় ও কার্যকরী সাড়াদানের ক্ষেত্রে চারটি ‘পি’ (Four P’s) অনুধ্যানে করণীয়সমূহ স্মরণ করতে পারি- plant বা গাছ-গাছড়া লাগানো, pray প্রার্থনা করা, protect বা রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও promote বা সংবর্ধিত করা অর্থাৎ ‘লাউদাতো সি’র মাণ্ডলিক  শিক্ষা সকলের নিকট প্রকাশ ও প্রচার করা যায়।

৮. সত্য মতকে সত্যরূপে গ্রহণ- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিত্তিহীন গুজব ও ‘মতের অরণ্য’ এ হারিয়ে না গিয়ে বরং বেরিয়ে এসে মূলধারার গণমাধ্যমের উপর নির্ভর হওয়া যেন যথার্থ আনন্দ, গভীর তৃপ্তি, প্রকৃত সত্য আহরণ করা যায়। ব্যক্তিগতভাবে এবছর কমপক্ষে দুইটি বই পড়ার অঙ্গীকার করা; চলমান বিষয় সংক্রান্ত পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের গ্রাহক হয়ে পাঠ করা; সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ক একটি শিক্ষা সেমিনারে অংশগ্রহণ করা; যা যা নতুন শুনছি তার কিছু অংশ মনে রাখা। আমরা যা শুনি তার মাত্র দশভাগের একভাগ এক বছর পর মনে রাখতে পারি। আগ্রহ চলমান ও অনুশীলন অটুট থাকলে মনে রাখার হাড়ও বাড়বে।

৯. ছুঁড়ে ফেলার সংস্কৃতি বর্জন- অর্থনীতি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে সংগ্রহ কর-চাহিদা পূরণ কর-ছুঁড়ে ফেলার (Take-Make-Dispose) বর্তমানযুগে প্রচলিত উন্নয়নের মডেলের পরিবর্তে লাউদাতো সি'র অনুপ্রেরণা- পুনর্নবীকরণ-পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ-অন্যের সাথে সহভাগিতার (Renew-Remake-Share) রূপান্তরশীল প্রক্রিয়া প্রচলন ও অনুুসরণ করা। সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য কোন কিছু তাৎক্ষণিকভাবে বর্জন না ক’রে বা ফেলে না দিয়ে তা পুনরায় ব্যবহার করাটাও ভালোবাসার কাজ হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং তার মাধ্যমে আমাদের মানবিক মর্যাদাই প্রকাশ পায় (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২১১)।

১০. সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ- কর্মস্থলে ‘ধন্যবাদ’ ও ‘স্বাগত’ এমন সৌজন্যসূচক শব্দ ব্যবহার, ইতিবাচক কথা বলা, ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার, নারী সহকর্মীদের যথাযথ সম্মানসূচক আচরণ করা, নোংরা শব্দ পরিহার করা, সমালোচনামূলক কথা না বলা, বিচারকি কথা-বার্তা পরিহার কর্মপরিবেশ সুন্দর রাখে। অযাচিত চাটুকারিতার স্বভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকা; কাজের সময় অযথা অন্যের নিকট বসে সময় নষ্ট না করা বরং তাকে কাজ করতে দেয়া এবং নিজে ভাল কাজ করা, কাজে সৃজনশীল চিন্তা করা, অবসর সময়ে উদ্দীপনামূলক লেখা পড়ে নতুন চিন্তা আহরণ করা এসব দায়িত্বশীল আচরণ কর্মপরিবেশ সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।

১১. সকলে ভাই-বোন চেতনা- পরিবেশের প্রতি যত্নবান হওয়াটা জীবনযাপনেরই অংশবিশেষ আর সেই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে একত্র মিলেমিশে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ থেকে বসবাস করার সক্ষমতা অর্জন। ঈশ্বর হচ্ছেন আমাদের সকলের অভিন্ন পিতা, সুতরাং আমরা সকলে হয়ে উঠেছি পরস্পর ভাইবোন। পরিবারেই এমন সরল ভ্রাতৃত্ববোধ চর্চা শুরু হয়, পরিবারেই আমরা দাবিহীনভাবে চাইতে শিখি, যা-কিছু পেয়েছি তার জন্য অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে “ধন্যবাদ” দিতে শিখি, পরিবারেই আমরা আক্রমণাত্মক মনোভাব ও লোভ সংবরণ করতে পারি এবং কাউকে কষ্ট দিলে বা ক্ষতি করলে ন¤্রভাবে ক্ষমা আদান-প্রাদান করতে শিখি।  আন্তরিকতাপূর্ণ স্বতস্ফুর্ত এমন সব সহজ সরল অঙ্গভঙ্গি, ভদ্র আচরণ ও ভাল অভ্যাস আমাদের পারিপার্শ্বিকতায় সহভাগিতামূলক জীবন ও শ্রদ্ধাবোধের কালচার বা সংস্কৃতি তৈরিতে সহায়ক হয় যা জীবনকে সমৃদ্ধ করে তুলে (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২১৩)।   

আমাদের অভিন্ন উৎপত্তি সম্বদ্ধে, আমাদের পারস্পরিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে এবং সবার সাথে সহভাগিতা করার দায়িত্ব সম্বদ্ধে জ্ঞান ও সচেতনতা উপস্থিত থাকলে জীবন সম্পর্কে নতুন প্রত্যয়, ইতিবাচক মনোভাব ও অবনত অবস্থার অগ্রগতি সম্ভব। যা আমাদের জীবনধারা পরিবর্তন করার দাবি জানায় (লাউদাতো সি, অনুচ্ছেদ - ২০৬)। আসুন, সবাই মিলে জীবনের প্রতি নতুন শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করি, সকলে অভিন্ন বসতবাটির সদস্য হিসেবে সকলের সমান অধিকার তা স্বীকার করি, টেকসই উন্নয়ন অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করি, ন্যায্যতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বেগবান করি, জীবনের আনন্দপূর্ণ উৎসব করার জন্য ভবিষৎ প্রজন্ম যাতে আমাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে পারে এমন ব্যক্তিগতভাবে ও সমবেতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করি। (প্রকাশিত : সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, সংখ্যা ২৮, ৮-১৪ আগস্ট, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ)