শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২১

ফেব্রুয়ারী ৮ : মানবপাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক প্রার্থনা ও সচেতনতা দিবস

 সাধ্বী যোসেফিন বাকিতা’র পর্ব: মানবপাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক প্রার্থনা ও সচেতনতা দিবস

সিস্টার যোসফিন রোজারিও, এসএসএমআই

কৃতদাসী থেকে সৌভাগ্যবতী যোসেফিন: মাতামণ্ডলী ৮ ফেব্রুয়ারী সাধ্বী যোসেফিন বাকীতার পর্ব পালন করে থাকে। তিনি ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে আফ্রিকার সুদান দেশে ওলগোসা নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকালে তিনি মা বাবা ও ভাইবোনেদের ভালবাসায় বড় হচ্ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস; মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি আরব কৃতদাস-ব্যবসায়ীদের দ্বারা অপহৃত হন এবং কৃতদাসী রূপে একাধিকবার বিভিন্ন ধনীলোকদের কাছে বিক্রি হন। কৃতদাসী রূপে তার এ বিড়ম্বনাময় জীবনে এত নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্চিত ও প্রহারিত হন যে তিনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে নিজের নামটা পর্যন্ত ভুলে যান ফলেন। তার একজন মালিক তাকে 'বাকিতা' (বাংলায় 'সৌভাগ্যবতী') নাম দেন। এ ছলনাময়ী নামের সাথে তার পাওয়া বিদ্রুপ, লাঞ্চনা, গঞ্জনার কোন মিল ছিল না বটে, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি উপলব্ধি করেছেন তার নামের ভবিষ্যতবাণীর সার্থকতা। যোসেফিন বাকিতা আফ্রিকার বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকায় কাজ করেছেন এবং নির্মম কষ্ট সহ্য করেছেন। একসময় এক ইতালীয়ান  রাষ্ট্র-দূত তাকে ইতালীতে নিয়ে গিয়ে তার পরিবারকে সেখানে স্থানান্তরিত করেন এবং তার পিতামাতার কাছে ফিরিয়ে দেন। এভাবে সেখানে তিনি লাভ করেন নব জীবন আর হয়ে উঠেন তার সমগ্র পরিবারের মুক্তিদাতা এবং পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠে। 

‘স্বাধীন নারী’ সিস্টার যোসেফিন বাকিতা: ইতালীর ভেনিস শহরে কেনোসিয়ান সিস্টারদের সহযোগিতায় বাকিতা কোর্ট থেকে মুক্তি লাভের সকল কার্যক্রম শেষ করে স্বাধীনভাবে ইতালীতে বাকী জীবন কাটান। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বাপ্তিস্ম ও হস্তার্পণ সাক্রামেন্ত গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কেনোসিয়ান সিস্টার হন এবং 'সিস্টার যোসেফিন বাকিতা' নামে পরিচিত হন। তিনি ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারী এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।

পাচারকৃত ভাইবোনদের প্রতিপালিকা সাধ্বী যোসেফিন বাকিতা: মানব প্রেমিক সাধু দ্বিতীয় পোপ জন পৌল যোসেফিন বাকিতাকে সাধ্বী শ্রেণীভূক্ত করেন এবং ৮ ফেব্রুয়ারী তার পর্বদিন বলে ঘোষণা করেন। ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দে মাতামণ্ডলী তার পর্বদিনটি প্রথমবারের মত পাচারকৃত ভাই বোনদের জন্য আর্ন্তজাতিক ভাবে প্রাথর্না-অনুধ্যানের জন্য উৎসর্গ ও উদযাপন করেছেন। ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিস মানব পাচার নামক গর্হিত ও ঘৃন্যতম কাজটি সমাজ থেকে নির্মূল করে অধিকার বঞ্চিত, নিপীড়িত, বিড়ম্বিত ও বলিকৃত ভাইবোনদের মুক্তি ও এদের পাশে দাঁড়াবার জন্য বিশ্বের নেতানেত্রীদের দৃষ্টি আর্কষণ করেন ও একটি যথাযথ ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। সাধ্বী যোসেফিন বাকিতার কাছে পাচারে স্বীকার হওয়া ভাইবোনদের জন্য পোপ ফ্রান্সিস নিজে বিশেষ প্রার্থনা করেন ও খ্রীষ্ট মন্ডলীর সবাইকে প্রার্থনা করতে অনুরোধ করেন। এই সাধ্বী নিজ জীবনে মানব পাচার নামক নির্মম-যন্ত্রনাদায়ক জীবনাবস্থার শিকার হয়েছেন ও এর বেদনা নিজ জীবনে উপলব্ধি করেছেন কিন্তু পরবর্তীতে স্বহৃদয়বান ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক, মানসিক, আবেগিক ও নৈতিক সমর্থন, ভালবাসা, কাউন্সিলিং ও গ্রহণীয়তা তাকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করেছে; তার অভিজ্ঞতা সহভাগিতার মাধ্যমে অন্যদের দৃষ্টি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে তাকে "পাচারকৃত ভাইবোনদের প্রতিপালিকা" বলে অভিহিত করা হয়। 

মানব পাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক প্রার্থনা ও সচেতনতা দিবস: সভ্যতা বিবর্জিত জঘন্য অপকর্ম মানব পাচার। শোষণ করার উদ্দেশ্যে ভয় দেখিয়ে বা বল প্রয়োগ করে বা অন্য কোন জোড়পূর্বক উপায়ে অপহরণ, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্বল অবস্থা কাজে লাগিয়ে অর্থ আগান-প্রদান করা একটি অপরাধ। আবার যেকোন প্রকার লোভ দেখিয়ে মানুষ সংগ্রহ, পরিবহন, হস্তান্তর, লুকিয়ে রাখা নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক ব্যধি। ঈশ্বর সম-মর্যাদা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সমগ্র সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব দিয়েছেন সেই মানুষই আজ আরেকজন মানুষকে পণ্য হিসেবে ক্রয়-বিক্রি করছে এবং যেমন তেমন ভাবে ব্যবহার-অপব্যবহার করছে। ঈশ্বর নিজে সৃষ্টি কর্তা হয়ে মানুষের স্বাধীনতাকে সম্মান করেন কিন্তু মানুষ অন্য একজন মানুষের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। তারপর জবরদস্তি করে পরিবার থেকে, সমাজ থেকে দূরে নিয়ে এমনকি দেশান্তর করে, কঠিন শ্রম দিয়ে, পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করছে। তাদের উপর যৌন নির্যাতন বা শ্লীলতাহানি, মারধর, আঘাত বা অন্য কোনো রকম শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করে তার ক্ষতি সাধন করছে। কাথলিক মণ্ডলীতে পোপ ফ্রান্সিস এ গর্হিত কাজের তীব্র নিন্দা জানিয়ে পাচারকারী ভাইবোনের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুক্তির জন্য প্রত্যেক মানুষকে জেগে উঠতে উৎসাহিত করছেন। তাই তিনি ৮ ফেব্রুয়ারী সাধ্বী যোসেফিন বাকিতার পর্ব দিনে বিশ্ববাসীদের মানব পাচার বিরুদ্ধ দিবস হিসাবে উদ্যাপন করতে আহ্বান জানান। 

তালিথা কুম নেটওয়ার্ক: ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিস মহোদয়ের অনুরোধে বিশ্বব্যাপী সিস্টার সন্ন্যাস সংঘের মেজর সুপিরিয়রদের সম্মেলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভাটিকান কেন্দ্রিক “তালিথা কুম আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক” (Talitha Kum International Network)। এ নেটওয়ার্কের সম্পৃক্ত হয়ে সিস্টারগণ বিশ্বের বুক থেকে মানব পাচার, জোড়পূর্বক অভিবাসন, অনৈতিক ও অন্যায্য মালিক-শ্রমিক সম্পর্কযুক্ত অমানবিক কর্ম পৃথিবী থেকে নির্মূল করার জন্য সেবাকাজ করে যাচ্ছেন।  পবিত্র বাইবেলের আরাময়িক শব্দ "তালিথা কুম" (বাংলায় 'খুকু আমি তোমাকে বলছি, তুমি উঠ') গ্রহণ করা হয়েছে (মথি ৫:৪১)। International Union of Superior General (UISG) সম্মিলিত ভাবে মানব পাচার নিরোধের প্রত্যাশায় ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে  সেবাকাজ আরম্ভ করেন। ২০০৭ খ্রীষ্টাব্দে যখন কাথলিক সন্ন্যাসব্রতিনীগণ অনুভব করলেন  নারী পাচারের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমে বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন থেকে সেবাকাজের অনুপ্রেরণা আরম্ভ হয় । ২০১৩ খ্রীষ্টাব্দে মোট ৭৫টি দেশের বেশ কয়েকজন নারী সন্ন্যাসব্রতী সংঘ-প্রধানগণ সম্মেলিতভাবে সিস্টার ইষ্ট্রেল্লা কাস্টালনে এর নেতৃত্বে প্রায় ৬০০ সিস্টার একত্রে গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে শুরু করেন এবং ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৮০টি দেশের ১১০০ জন সেবাকর্মী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এশিয়া মহাদেশের ৮টি দেশ এ কার্যক্রম খুবই আন্তরিকতা সাথে কাজ করছেন্। বাংলাদেশে ন্যায় ও শান্তি কমিশন-সিবিসিবি ও বিসিআর এর যৌথ সমর্থনে এবার বাংলাদেশ মণ্ডলীও  প্রত্যক্ষভাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।

তালিথা কুমের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য: (১) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রতধারী/ধারিনী, সামাজিক সংঘটন, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতা নেত্রীদের মধ্যে মানব পাচার বিরুদ্ধ নেটওয়ার্ক তৈরী করা; (২) চলমান কার্যক্রম ও পদক্ষেপগুলো কে আরো শক্তিশালী করা, সন্ন্যাসব্রতী সংঘগুলির মানব সম্পদের অনুকূলকরণ ও তাদের সম্ভাবনাগুলির সুষ্ঠ প্রয়োগ, প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, সচেতনতা প্রদান, ভূক্তভোগীদের পূর্ণবাসন ও সংরক্ষণ, এবং পাচার বিরুদ্ধ অফিসিয়াল রির্পোট প্রদান; (৩) চলমান ঘটনা বিষয়ে সদস্যাদের জন্য সচেতনতামূলক শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম প্রনয়ন ও উন্নয়ন এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাস্তবায়ন; (৪) সদস্যাদের প্রাবক্তিক ভূমিকা বিষয়ে সোচ্চার করে তোলা, শোষনকারী-দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ভাবে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, আইনী সহায়তা দাবী পূরণে সহায়তা এবং নারীদের ক্ষমতায়নে আইনী সহায়তা প্রদান ও পাশে দাঁড়ানো।

বাংলাদেশে মানব পাচারের ভয়াবহ রূপ: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রেস রিপোর্ট অনযায়ী- মানব পাচারে জড়িতচক্রসমূহ লোভনীয় চাকরি ও সুযোগ-সুবিধার নামে ‘মিথ্যাস্বপ্ন’ দেখিয়ে বাংরাদেশের লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ ও শিশুদের এ পথে নিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক পাচার, যৌন-দাসত্ব, সংখ্যালঘু ও দুর্বল মানুষদের বেআইনী ভাবে ব্যবহার ও নির্যাতন, মানবাধিকার খর্ব, প্রতারণা ইত্যাদির মাধ্যমে এক কুচক্রীমহল কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়েই চলছে এদের দমনের উদ্যোগ না নিলে দেশ ও সমাজ এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হবে। র‌্যাবের রিপোর্ট অনুসারে শুধু মাত্র ডান্স ক্লাবের নামে গত দেড় বছরে সহস্রাধিক  নারী পাচার হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে- বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরে প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে; এদের একটি বড় অংশ পাচার হয়ে যায়। এসবের মূলে দারিদ্রতা, মিথ্যাস্বপ্ন, কর্ম সুযোগের অভাব, স্বল্প শিক্ষা, পরিবারগুলির ভাঙ্গন প্রক্রিয়া, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা, অভিবাসন নীতিমালা ইত্যাদি বিষয়কে দায়ী করা যায়। তাই বাংলাদেশ মণ্ডলী মানব পাচার মুক্ত অর্থনীতি গঠনে পোপ মহোদয়ের সাথে "তালিথা কুম নেটওয়ার্ক" এর মূলনীতি অনুসরণ করে সরকার ও মানব পাচারে শিকার ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াতে ও তাদের সেবা করতে জোড়ালো ভূমিকা রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করছে। 


(তথ্যসূত্র: তালিতা কুম ডেস্ক ইনফরমেশন ও ইন্টারনেট) 




আধ্যাত্মিক একাত্মতা ও রূপান্তরমূলক পরিবর্তন

১. কারাগারে বন্দিদের সাথে সাক্ষাতের সময় একজন বন্দি পবিত্র সাক্রামেন্ত গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে তার বন্দিজীবনে নয়টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু মামলার বিচারকাজ এখনও চলমান আছে। দীর্ঘসময় সে পবিত্র সাক্রামেন্ত গ্রহণ করতে পারেনি। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালেও কারাকর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া যায়নি। অনেক আলোচনা করে বড়দিনের সাক্ষাতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া গেল। তবে সীমিত সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে । এদিকে বড়দিনের কেক কাটবেন কারাকর্তৃপক্ষ, এরপর অন্যান্য বন্দিদের মাঝে বড়দিনের উপহার বিতরণ করা হবে। ইতোমধ্যে খ্রিস্টভক্তসহ কারাবন্দিদের একটি দল দরবার কক্ষে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমে খ্রিস্টান বন্দিরা পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহণ করল তারপর অল্প সময়ে খ্রিস্টযাগ সমাপ্ত হয়েছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহণের সময় সকলের চোখেজল দেখেছি, অন্যদিকে খ্রিস্টকে গ্রহণ করে সকলের চেহারায় আনন্দের প্রকাশ ছিল। বিদায়ের সময় খ্রিস্টভক্ত বন্দির অনুভূতি অনেকটা এমন ছিল- ‍‍‌"মূল্যবান কিছু পেতে পেতে হঠাৎ যখন বঞ্চিত হই তখনই গুরুত্ব বুঝতে পারি।" বিভিন্ন কারাগারে বন্দিদের সাক্ষাৎকালে প্রায় সময় একই উপলব্ধি সহভাগিতা করেছে। কারাবন্দিরা নিয়মিত আধ্যাত্মিক অনুশীলন থেকে বঞ্চিত থাকে। তারা জানে না আবার কখন খ্রিস্টকে গ্রহণ করতে পারবে। তবে আধ্যাত্মিক একত্মতায় তারা খ্রিস্টের সাথে যুক্তই আছে। কভিড-১৯ সংক্রমণ যেন দ্রæত বিস্তারিত না হয় সেজন্য আমরা নিজ বাড়িতে অন্তরীণ ছিলাম। যা আমরা অবজ্ঞা করে চলতে পারছি না। এ সময়টা কিছুটা কারাবন্দির মতোই আছি। এ সময় নিয়মিত খ্রিস্টযাগে যোগদান করে আধ্যাত্মিক অনুশীলন আমরা করতে পারছি না, কিন্তু আমরা খ্রিস্ট ও খ্রিস্টভক্তদের সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে একাত্মই থাকতে পারি।  

২. খ্রিস্টীয় ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে অনেক সাধুজন আধ্যাত্মিক সাধনায় সন্ন্যাস জীবনযাপন করতেন। তারা স্বেচ্ছায় মরুপ্রান্তরে ছোট ছোট ঝুপড়িতে একা একা ধ্যানমগ্ন থাকতেন। পাশাপাশি ৫/৬জন সন্ন্যাসী অবস্থান করলেও পরস্পরের সাথে অতি প্রয়োজন ছাড়া দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না। একজন পথিক যাত্রাপথে পাশের সন্ন্যাসীর ঝুপড়ির সামনে ঝুড়িতে কিছু আঙ্গুর ফল রেখে গেল, এমনটি প্রচলিত ছিল। সন্ন্যাসী তার ঝুপড়ির সামনে সুস্বাদু আঙ্গুরের ঝুলি পেয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। তিনি চিন্তা করলেন- রাস্তা থেকে আমার ঝুপড়িই প্রথম। পথিকরা আমার কাছে যখন-তখন আবারও কিছু নিশ্চয়ই রাখবে। আমি বরং পাশের সন্ন্যাসীকে আঙ্গুরগুলো দিয়ে আসি। পাশেরজন তার ঝুপড়ির সামনে লোভনীয় আঙ্গুর দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি চিন্তা করলেন- বেশ ভালই হলো পাশের সন্ন্যাসী দেখছি কয়েকদিন যাবৎ অসুস্থ, আঙ্গুরগুলো এসময় তার সুস্থস্তার জন্য উপকারী হবে। এবার অসুস্থজন আঙ্গুরের ঝুড়ি পেয়ে ভাবলেন- আমার পাশে যুবক সবেমাত্র সন্ন্যাস জীবনে যোগ দিয়েছে তার নিশ্চয়ই ভালকিছু খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি আঙ্গুরের ঝুড়ি যুবকের ঝুপড়ির সামনে রেখে গেলেন। এদিকে যুবক সন্ন্যাসী চিন্তা করল- আমার সামনে অনেক সময় আছে; আমি বরং পাশের প্রবীন সন্ন্যাসীকে আঙ্গুরগুলো দিয়ে আসি। এবার প্রথম সন্ন্যাসী দেখলেন- ঝুড়ি ভর্তি লোভনীয় আঙ্গুর ফল তার ঝুপড়ির সামনেই আছে। সন্ন্যাসীরা ধ্যান-সাধনার উদ্দেশ্যে সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্ন থাকা এবং বন্ধাবস্থা স্বেচ্ছায়  গ্রহণ করেছেন। তথাপি তারা আধ্যাত্মিক একাত্মতায় পরস্পরের কাছে আছেন। বিভিন্ন কারণে মানুষ বিচ্ছিন্ন বা দূরত্বে থাকতে পারে। তবে পরস্পরের প্রতি যখন ভালবাসা থাকে, অন্যের উপকার করার মনোভাব থাকে এবং অন্যর জন্য মঙ্গলকাজ করে তখন আধ্যাত্মিক একাত্মতায় থাকতে পারি। 

৩. করোনাভাইরাসটি নির্মুল করার যুদ্ধসময়ে বিশ্বাসের ঐতিহ্যগত ‘আধ্যাত্মিক একাত্মতা’ অনুশীলন নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমানের আহ্বান। তৃতীয় শতাব্দীর প্লেগ মহামারীর সময়টা সাধু সিপ্রিয়ান মানুষের অন্তরে বিশ্বাস ও আশা জোরদারের সুযোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি প্রচুর সাহস এবং বিপুল আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন- 'এটা কতই না আধ্যাত্মিক মহিমা' যা 'ধ্বংস ও মৃত্যুর আক্রমণ' এর সামনে জীবন্ত বিশ্বাস নিয়ে অবিচল থাকা। ভয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ার পরিবর্তে বিশ্বাসে শক্তিশালী হতে 'সুযোগটি আলিঙ্গন করা' দরকার। আধ্যাত্মিক অনুশীলন হিসেবে পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ ও খ্রিস্টের উপস্থিতি অভিজ্ঞতা করার বিকল্প কিছুই নাই। কিন্তু মহামারী সময়ে 'আধ্যাত্মিক একাত্মতা' প্রথমে অর্থহীন বিকল্প হিসেবে মনে হতে পারে কিন্তু নিজেরা অভিজ্ঞতা করতে পারব যে এটি সত্যিই ঈশ্বরের একটি অসাধারণ অনুগ্রহ। অনেক শতাব্দী পর্যন্ত সাধু ও ধর্মতত্ত্ব বিদরা নিজেরা অভিজ্ঞতা করেছেন ও বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। আভিলার সাধ্বী তেরেজা অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন- যখন তুমি পবিত্র খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করতে পার না, খ্রিস্টকে গ্রহণ করার সুযোগ পাও না, তখন খ্রিস্টের সাথে 'আধ্যাত্মিক একাত্মতা' অভ্যাস করবে। তখন দেখবে খ্রিস্টের ভালবাসায় দিনে দিনে তুমি আপ্লুত হতে থাকবে। একা কারাবন্দি অবস্থায় ক্রুশভক্ত সাধু যোহন একটি কবিতায় লিখেছেন- জীবন্ত জলের ঝর্ণা বিশ্বাসীর অন্তরে সর্বদা সঞ্চারিত হয়, এমনকি বিশ্বাসের অন্ধকার সময়েও। বুলগেরিয়ার একজন বিশপ বহু বছর আগে বলেছেন- তার দেশে কমিউনিস্ট নির্যাতনের সময়কালে অনেক পুরোহিত রাজপথে প্রাণ দিয়েছে অথবা কারাগারে বন্দি ছিল। এমন অবস্থায় পুরোহিত ছিল না। বিশ্বাসী খ্রিস্টভক্তগণ যখন পাপস্বীকার করতে ইচ্ছা করত তখন তাদের পরিচিত পুরোহিতের কবরে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে পাপস্বীকার করত। পবিত্র ক্রুশ সংঘের অর্থাৎ আমার সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ফা. বাসিল আন্তনী মরো'ও স্বেচ্ছায়  'একা অন্তরীণ' ধ্যান প্রার্থনা কাটাতেন। তিনি মাঝে মাঝে ফ্রান্সের এক নিভৃত ছোট পল্লীর এই বাড়িতে প্রার্থনারত একা থাকতেন কিছু দিন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই সেখানে আমি গিয়েছি এবং একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে প্রার্থনা করেছি।

৪. মরুভুমিতে খ্রিস্ট যিশুর একাকী অভিজ্ঞতা ও তাঁর ধর্মনিষ্ঠার পরীক্ষা (মথি ৪:১-১১) ঘটনা আমার জানি। মরুপ্রান্তরে দীক্ষাগুরু যোহনের বাণী প্রচারের গল্পটি আমাদের স্মরণ আছে (৩:১-১০)।  ইহুদী ধর্মনেতাদের ভয়ে শিষ্যরা ‘দরজা বন্ধ করে’ একত্রে ছিল এবং তারা যিশুর দেখা পেয়েছে  (যোহন ২০:১০)। তারা অন্যান্য লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। বাইবেল আমরা পড়ি আরও একবার শিষ্যরা কীভাবে 'একত্রে অন্তরীণ' অবস্থায় সেই 'উপরের ঘরে' ছিলেন । লক্ষণীয় বিষয় এবার তারা ভয়ে তাদের হৃদয় হিমশীতল হতে দেয়নি বরং পবিত্র আত্মার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল (শিষ্যচরিত ১:১২-১৪, ২: ১-১২)। পবিত্র বাইবেলে অন্ধ বার্তিমেয় (মার্ক ১১০:৪৬), অসুস্থ মহিলা, অনিহুদী স্ত্রীলোক (মার্ক ৭:২৪-৩০) এমন অনেকে সামাজিক কারণে যিশুর কাছে যেতে পারেনি। কিন্তু তারা যিশুর নিরাময় কৃপা লাভ করেছেন কারণ তাঁর সাক্ষাৎ লাভের তাদের অন্তরে গভীর ইচ্ছা ছিল। যিশুর সাথে তারা আধ্যাত্মিক একাত্মতায় ছিল। অন্যদিকে করগ্রাহক ও পাপীরা (লুক ১৫:১-১০) গভীর আগ্রহ নিয়ে যিশুকে গ্রহণ করতে অপেক্ষা করেছে, যখন সুযোগ পেয়েছে তখন যিশুর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। হারানো ছেলে 'বিচ্ছিন্ন  জীবনযাপন' করে বাবার ভালবাসা আবিস্কার করেছে এবং অন্তরে আধ্যাত্মিক একাত্মতা জাগ্রত হয়েছে; অন্যদিকে বড়ছেলে বাবার সাথে একই বাড়িতে থেকেও অন্তরে বাবার ভালবাসায় একাত্ম হতে পারেনি (লুক:১৫:১১-৩২)। 

৫. করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মানুষের জীবন সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্ন থাকা এবং বন্ধাবস্থা এই চারটি পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আমরা সকলে তা অভিজ্ঞতা করেছি। এমন অবস্থায় খুব সহজেই আমাদের ভিতরে ভয়, ক্রোধ, তিক্ততা, অভিযোগ এবং হতাশার মনোভাব প্রবলভাবে প্রতিপালন করতে পারে। শিষ্যদের অন্তরীণ থাকার কী বিশেষত্ব ছিল যা তাদের অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করেছিল। আমরা পড়ের্ছি 'কয়েকজন স্ত্রীলোক এবং যিশুর মা মারীয়ার সাথে শিষ্যরা একত্রে প্রার্থনারত ছিলেন' (শিষ্যচরিত ১:১২-১৪)। প্রার্থনা আমাদের জন্য বিরাট আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন সময় দেখি ও অভিজ্ঞতা করছি। একটি অন্ধকার ও বিরক্তকর অভিজ্ঞতা যা আমাদের কাছে অভিশাপের মত হতে পার। ঐ মুহূর্তে প্রার্থনা আমাদের জীবনে গভীর অভ্যন্তরীণ রূপান্তর আনে, শান্তির সূচনা করে। এমন কী কিছু সময় পরে অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আর্শীবাদের অভিজ্ঞতা করতে পারি। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও মহা ব্যস্ততা থেকে বাধ্য হয়ে দূরে আছি যেখানে আমরা 'বিশ্বটা অবরুদ্ধ' বা 'পৃথিবীটা মনেস্টারি' ভাবছি। করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পেতে অবরুদ্ধ সময় বাধ্য হয়ে মানবিক কর্মব্যস্ততা থেকে বিরতি নিয়ে ধ্যানময় বিশ্রামে সময় কাটাতে সুযোগ পেয়েছি। এমনও হতে পারে অবশেষে সৃষ্টিকর্তা বিশ্বের এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হুমকি স্বরূপ ঘাতক ভাইরাসটি দুনিয়া থেকে নির্মুল করবেন। আমাদের বিশ্ব, আমাদের সমাজ, আমাদের মণ্ডলী হয়ে উঠবে পুনর্নবীকরণ, ব্যাপক রূপান্তরিত যা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।  

৬. এই অবরুদ্ধ সময় আমাদের ভাবতে সুযোগ দিয়েছে- শুধু পেশাগত কাজে ডুবে কাজপাগল (ওয়ার্কএহলিক) হয়ে থাকতে আমাদের সৃষ্টি করা হয়নি অথচ আমরা কেউ কেউ তা-ই করে থাকতে পছন্দ করি। পোপ ফ্রান্সিস আমাদেরকে এ বছরের প্রথম দিন 'যত্নের সংস্কৃতি' গড়ে তুলতে পরামর্শ দিয়েছেন, ধরিত্রির সুরক্ষা করা ঈশ্বরের নিকট থেকে প্রাপ্ত দায়িত্ব। পিতা ঈশ্বর বিশ্বসৃষ্টি কাজে বিশ্রাম নিয়েছেন, বিস্ময়বোধ প্রকাশ করেছে 'সত্যিই তা খুব ভালই হয়েছে।'  ধর্মীয় শিক্ষায় প্রতি সপ্তাহে একদিন বিশ্রাম দিবস উদ্যাপনের নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। তাতে আমাদের ক্ষতবিক্ষত অন্তরের পরিবেশ, মানব পরিবেশ ও প্রকৃতি পরিবেশ নিরাময় হতে পারে। এমন বিশ্রাম উদ্যাপন অনূৎপাদনশীল ও নিষ্প্রয়োজন নিষ্ক্রিয়তা বা কর্মহীনতার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, স্বতন্ত্র মনে করতে হবে। যা অন্য রকম ভাবে আমাদের অন্তরে কাজ করে, যা হচ্ছে আমদের সত্তারই নবায়ন (লা.সি. ২৩৭)। 

৭. ঘরবন্দি অবস্থায় আমরাও প্রেরিতশিষ্যদের ও মা মারীয়ার মত নিয়মিত প্রার্থনা ও পবিত্র বাইবেল পাঠ করতে পারি। এমন আধ্যাত্মিক একাত্মতা অনুশীলন করে নিজে রূপান্তরিত হতে পারি ও  অন্যকে রূপান্তরিত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারি। আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের বিশ্বাসের সাক্ষ্যদান হবে তখনই যখন- প্রার্থনা, ধ্যান, উপাসনা, ধর্মশিক্ষা ও সংস্কারীয় জীবনের প্রতি আমাদের অনুরাগ ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। খ্রিস্টীয় বিবাহ, যাজকীয় ও সন্ন্যাসব্রতী জীবনের আহবান সম্পর্কে নবচেতনা ও নবজাগরণ ঘটবে। স্থানীয়, ধর্মপ্রদেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মণ্ডলীর কর্মসূচী ও কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ বাড়বে। সামাজিক জীবনের সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ বাড়বে। দয়াকর্ম, সাংস্কৃতিক, সৃষ্টির যত্ন ও আধ্যত্মিক কর্মকান্ডের জন্য নতুন উদ্যোগ ও চেতনা সৃষ্টি হবে। খ্রিস্টবিশ্বাসে যাদের স্খলন ঘটেছে, তারা আবার খ্রিস্টীয় জীবনে ও মণ্ডলীর মিলন-সংযোগে ফিরে আসে। আসুন, আমরা আধ্যাত্মিক একাত্মতার অনুপ্রেরণায় থাকি এবং ঈশ্বরের সাথে, নিজের সাথে, অপরের সাথে ও বিশ্বসৃষ্টির সাথে আমাদের সম্পর্ক নিরামায় ও রূপান্তর হতে দিই।