মানবজাতির প্রতি প্রভু যিশু খ্রিস্টের ভালবাসার শিক্ষা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বজনীন কাথলিক মÐলীর সাথে একাত্মতায় গত ৮-১০ আগস্ট, ২০১৯ খ্রিস্টবর্ষে “National Pastoral Workshop on Migration – 2019” শিরোনামে অভিবাসী, শরণার্থী, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী, মানবপাচার ও জলবায়ু বিষয়ক একটি কর্মশালা কাথলিক বিশপ সম্মিলনী’র ন্যায় ও শান্তি কমিশন এর উদ্যোগে এবং Migrants & Refugees Section, DPIHD, Holy See, Vatican City'র সহযোগিতায় আয়োজিত হয়। সভায় বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীর আটটি ডাইওসিস থেকে মহামান্য কার্ডিনাল মহোদয়সহ শ্রদ্ধাভাজন আর্চবিশপ মহোদয়, বিশপগণ, পুরোহিত, ধর্মসংঘের প্রতিনিধি, যুবক-যুবতী, সেমিনারীয়ান, পেশাজীবি, কাথলিক গণমাধ্যমে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, সমাজকর্মীসহ ৮৫ জন অংশগ্রহণকারী নিমন্ত্রিত ছিলেন। কর্মশালার উদ্দেশ্য ছিল- অভিবাসী ও শরণার্থী বিষয়ক সেবাকাজের অভিজ্ঞতা সহভাগিতার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, সমন্বিত ( ডাইওসিস,কমিশন, স্কুল, প্রতিষ্ঠান, ওয়ার্ল্ড ভিশন, কারিতাস এবং অন্যান্য সংগঠন) উদ্যোগ গ্রহণ, কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে মণ্ডলীতে পালকীয় যত্ন আরো বেগবান করা। কর্মশালাটি সিবিসিবি সেন্টার, ২৪/সি আসাদ এভিনিউ, মোহম্মদপুর, ঢাকায় আয়োজন করা হয়। কর্মশালার মূলভাব “এশীয় প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে বাংলাদেশে অভিবাসী, শরণার্থী, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী, মানবপাচার ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রেক্ষাপট ও স্থানীয় খ্রিস্টমণ্ডলীর ভূমিকা”। এতে সম্মিলিতভাবে প্রার্থনা, খ্রিস্টযাগ, আলোচনা ও দলগত কর্ম-পরিকল্পনা প্রস্তুতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালাটি বিগত ১১-১৭ ফেব্রæয়ারী ২০১৯ খ্রিস্টবর্ষে কক্সবাজার, বাংলাদেশে এশিয়ার প্রেক্ষাপটে অভিবাসী, শরণার্থী ও মানবপাচার ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী বিষয়ক সেমিনার-এর পরবর্তী ধাপ; যা এশীয় বিশপ সম্মিলনী’র ফেডারেশন অব এশিয়ান বিশপ কনফারেন্স (FABC) এর অন্তর্ভুক্ত মানব উন্নয়ন অফিস (Office of Human Development, OHD), বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী’র শান্তি ও ন্যায্যতা কমিশন এবং এশিয়া প্যাসিফিক ন্যায্যতা ও শান্তি কর্মীদের নেটওয়ার্ক (APJPWN)-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অভিবাসী ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী যারা প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ যেমন-বন্যা, নদীভাঙ্গন, ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, জলবায়ু পরিবর্তনসহ কর্মসংস্থান, শিক্ষা গ্রহণ, আবাদযোগ্য জমির অপ্রাপ্যতা, মাটি ও পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন হ্রাসসহ বিভিন্ন কারণে তাদের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। অভিবাসী ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী তাদের আদিনিবাস ছেড়ে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছানোর যাত্রাপথে ও গন্তব্যে পৌঁছানোর পর যে অমানবিক দুর্দশা ও প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সে বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি। তাদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ও পারিবারিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। বিপরীত দিকে গ্রহণকারী জনগোষ্ঠী হিসেবে অভিবাসীদের প্রতি আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘাটতি রয়েছে এবং প্রতিবেশী সুলভ আচরণ করতে এবং তাদের বিপদ-আপদে সহায়তার হাত বাড়াতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করি, যা মানুষ হিসেবে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে দুরত্ব সৃষ্টি করে।
যিশু যেমন বলেছেন, “তুমি তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতই ভালবাসবে।” যিশুর অনুসারী হিসেবে আমাদেরকেও সকল প্রতিবেশীর প্রতি মনোযোগী ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের ইতিহাসে দেখা যায় যে, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের দেশ আজ দরিদ্রতম দেশ থেকে মাঝারি আয়ের দেশের উপনিত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মধ্যে এমন যুগান্তকারী রূপান্তর সম্ভব হয়েছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ এবং দেশ গড়ার প্রেরণা এবং সংহতিবোধ থেকে। আমাদের সম্মিলিত এই জীবনবোধ থেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ অভিবাসী ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও মানবাধিকার সম্পর্কে আরো যত্নশীল হতে হবে। শুধু তাই-ই নয়, কর্মশালায় আমরা আরো জেনেছি কুতুপালং ক্যাম্প, উখিয়া, কক্সবাজারে অবস্থানরত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা ও তাদের সংগ্রাম। আমরা দেখেছি জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক কারিতাস পরিবারের সহায়তায় বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী ও এর সমাজ উন্নয়নমূলক সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশ, সামাজিক সংগঠন, সংঘ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কীভাবে তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ অভিবাসী জনগোষ্ঠীর নিরাপদ আবাসন সমস্যা, স্বল্প ও নিম্ন আয়ের কর্মজীবিদের দীর্ঘ কর্মঘন্টা, অসুস্থতায় ছুটি না পাওয়া, অন্যায্য মজুরী, কর্মজীবি বাবা-মায়ের সন্তানের সুরক্ষার অভাব, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কের দুরত্ব, সর্বোপরি নতুন ‘বসতি সমাজ’ ব্যবস্থা, দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার অনবরত চাপ তারা অনুভব করে। এসব কিছু মিলিয়ে নতুন গন্তব্যে অভিবাসীদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অভিবাসীরা তাদের গন্তব্যে পরিচিতজনদের সাথে বা নিজ এলাকার লোকদের সাথে সম্পর্কের ভিত্তি প্রস্তুত করে। তথাপি গন্তব্য স্থানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান বা সামাজিক নেটওয়ার্ক তাতে অভিবাসীদের প্রবেশ খুব সীমিত। ফলে, বৃহত্তর সমাজের অংশ হতে তাদের দীর্ঘ সময় লেগে যায়, অথবা তারা বৃহত্তর সমাজের অংশ হতে পারেন না।
আমরা প্রত্যয় করি যে, স্থায়ী নিবাসী ও অভিবাসী সবাইকে নিয়েই আমাদের সমাজ। যারা স্থায়ী নিবাসী তাদের জীবন পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, তাদের পূর্বপুরুষরাও কোন না কোন সময় অভিবাসী ছিলেন এবং তারাও বিভিন্ন সময় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন ও তা মোকাবেলা করেছেন। আমাদের পূর্বপুরুষ আব্রাহামও পিতা ঈশ্বরের নির্দেশে মিশরে গমন করেছিলেন। নাজারেথের পবিত্র পরিবার সাথে স্বয়ং যিশু খ্রিস্টও অভিবাসী পরিবারের সদস্য। আদিপুস্তক ও মঙ্গলবাণীর বিশ্বাসের আলোকে আমরা পুন্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের চারটি করণীয় নির্দেশনা স্মরণ করি। সমসাময়িক কালের অভিবাসনের চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে নিবিড় সমন্বয় ও কার্যকরী সাড়াদানের ক্ষেত্রে এ চারটি করণীয় হল-স্বাগত জানানো, সুরক্ষা দেয়া, সংবর্ধিত করা ও সংযুক্ত করা। পোপ মহোদয় আমাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন, “তোমরা নিশ্চিত হতে পারো যে, সকল কর্মের পেছনে যে শ্রম, তাতে অবশ্যই মণ্ডলীর অংশগ্রহণ আছে।” (Pope Francis, Address to Participants in the International Forum on Migration and Peace, 21 February 2017)
আমরা অঙ্গীকার করছি যে, খ্রিস্টমণ্ডলী হিসেবে প্রভু যিশুখ্রিস্টের শিক্ষা অনুসরণ করে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব। আমরা অভিবাসী ও বাস্তুচ্যুতদের সমস্যা ও প্রয়োজনগুলো উপলব্ধি করব, প্রতিবেশী হিসেবে তাদের গ্রহণ করব, তাদের ভালবাসব ও তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করব। ঈশ্বরের সৃষ্টির সেরা হিসেবে আমরা আমাদের হৃদয় ও মনকে পিতা পরমেশ্বরের ভালবাসায় পূর্ণ করি ও সেই ভালবাসা সমাজের সকলের মাঝে বিস্তার করি।
সংহতিতে,
বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ডিডি
সভাপতি
শান্তি ও ন্যায্যতা কমিশন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী, ঢাকা।
শান্তি ও ন্যায্যতা কমিশন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী, ঢাকা।
বিশপ, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ
তারিখ: ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ খ্রিস্টবর্ষ
ড. ফা. লিটন হিউবার্ট গমেজ, সিএসসি
সেক্রেটারি
শান্তি ও ন্যায্যতা কমিশন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী, ঢাকা।
শান্তি ও ন্যায্যতা কমিশন, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী, ঢাকা।
বিশপ, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ
তারিখ: ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ খ্রিস্টবর্ষ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন