শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১

খ্রিস্ট জীবন্ত : আমাদের আশা, আমাদের মনোবল

১. পুনরুত্থান পর্বের প্রস্তুতিতে আমরা ধ্যান করতে চেষ্টা করেছি- যিশু খ্রিস্ট আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন উপবাস, প্রার্থনা এবং দান কর্ম আমাদের মন পরিবর্তনকে সম্ভব ক’রে তোলে, অন্যদিকে এসব আমাদের মন পরিবর্তনের চিহ্নও (মথি ৬:১-১৮)। উপবাসের মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত হই, প্রার্থনায় অন্তরে আশার আলো দেখতে পাই এবং দান-কর্মে মাধ্যমে ‘যত্নের সংস্কৃতি’ চর্চা করতে পারি। ফলে নিজে রূপান্তরিত হয়ে অন্যকে রূপান্তরিত হতে অনুপ্রাণিত করি। জীবনযাপনে প্রার্থনা, ধ্যান, উপাসনা ও সংস্কারীয় জীবনের প্রতি অনুরাগ ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে; খ্রিস্টিয় বিবাহ, যাজকীয় ও সন্ন্যাসব্রতী জীবনের আহ্বান সম্পর্কে নবচেতনা ও নবজাগরণ ঘটবে; ধর্মশিক্ষা গ্রহণে ও দানে নিষ্ঠতা বাড়বে; সামাজিক জীবনের সম্পৃক্ততা বাড়বে; দয়াকর্ম, সাংস্কৃতিক ও আধ্যত্মিক কর্মকাণ্ডের জন্য নতুন উদ্যোগ ও চেতনা সৃষ্টি হবে এবং খ্রিস্টবিশ্বাসে যাদের স্খলন ঘটেছে, তারা আবার খ্রিস্টীয় জীবনে ও মণ্ডলীর মিলন-সংযোগে ফিরে আসে। ফলে আমাদেরকে নিখাঁদ বিশ্বাস, জীবন্ত আশা এবং কার্যকরী দানশীলতার জীবন যাপনে সমর্থ ক’রে তোলে।

২. এ বছরের পুনরুত্থান পর্বটিও আমাদের নিকট যিশুর প্রথম শিষ্যদের অভিজ্ঞতার মতোই। করোনাভাইরাসের 'ধ্বংস ও মৃত্যুর আক্রমণ' দুর্বল হয়েও আবার নতুনভাবে সংক্রমণ শুরু ফলে সাধারণ জনগণের মনে অনিশ্চয়তা ও সংশয় বাড়ছে। যিশুর মৃতদেহ সমাধিগুহায় শুইয়ে রেখে শিষ্যদের কারও কারও মনের মধ্যে অনিশ্চয়তা, সংশয় ও সন্দেহ ছিল (মথি ২৮: ১৭)। তবে কয়েকজন নারীর একটি ক্ষুদ্রদল সক্রিয় ছিল; যিশুর মৃত্যু তাদেরকে হতাশায় পঙ্গু করে ফেলেনি। বরং তারা একটি সাধারণ কাজ অসাধারণভাবে করেছে। তারা যিশুর পবিত্র দেহে গন্ধদ্রব্য লেপনের কাজটি আরও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য সুগন্ধি-মশলা প্রস্তুত করে নিয়ে এসেছে। গত বছর নিস্তার জাগরণীর অনুধ্যানে পোপ ফান্সিস বলেছেন- "তারা তাদের ভালবাসার দুয়ার বন্ধ করে রাখেনি; তাদের অন্তরের অন্ধকারে দয়ার শিখা প্রজ্জলিত রেখেছে।" আমাদের ভাবতে হবে- আমাদের জীবনের অশ্চিয়তা, সংশয় ও সন্দেহের মুহূর্তে আমরা কি ভয়ে ভালবাসার দূয়ার বন্ধ রেখেছি? অভাবী ও বিপদাপন্ন ভাইবোনদের সেবাযত্নের জন্য আমি কীভাবে গন্ধদ্রব্য, সুগন্ধি-মশলা নিয়ে প্রস্তুত আছি?

৩. যিশুকে সমাধিগুহায় রেখে যিশুর মা একটি নতুন সূর্যকিরণ, একটি নতুন দিন দেখার আশা নিয়ে প্রার্থনারত সময় কাটিয়েছেন। তিনি আজ আমাদের সকলের 'মা' । পোপ মহোদয় একটি অনুধ্যানে বলেছেন- “যিশুর দেহটি মাটিতে  শোয়ানো বীজ যিনি পৃথিবীকে নতুন জীবন দান করবেন এবং মা মারীয়া প্রার্থনা ও ভালবাসা দ্বারা এই আশাটি প্রস্ফুটিত হতে সহায়তা করেছেন।” প্রার্থনা আমাদের জন্য একটি অন্যতম আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন সময় অভিজ্ঞতা করছি। একটি অন্ধকার ও বিরক্তকর অভিজ্ঞতা যা আমাদের কাছে অভিশাপের মত হতে পার। ঐ মুহূর্তে প্রার্থনা আমাদের জীবনে গভীর অভ্যন্তরীণ রূপান্তর আনে, শান্তির সূচনা করে। এমন কী কিছু সময় পরে অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও আর্শীবাদের অভিজ্ঞতা করতে পারি। এই অবরুদ্ধ সময়ের দুর্গতিতে আমারা চিন্তা করি- আমরা কতটা সময় প্রার্থনায় কাটিয়েছি, আমরা কতটুকু আশা ও মনোবল নিয়ে মা-মারীয়ার মত সবকিছু নতুন স্বাভাকিতায় গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে আছি? পরিবারে কীভাবে প্রার্থনারত জীবনযাপন করছি?

৪. এই দিনেই ‘আশা’ পৃথিবীতে প্রবেশ করে। যিশুর সাথে নারীদলটির সাক্ষাৎ ঘটে। তারা বুঝেছেন যিশুর মৃত্যু তাঁর মহিমা-লাভের সোপান মাত্র। যিশুর কথা শুনে তাদের অন্তরে আশা ও মনোবল আগুনেরই মতো আবার জ্বলে উঠেছে।  পোপ ফান্সিস বলেছেন- “ভয় করো না, ভয় পেও না -এই আশার বার্তাটি আজ আমাদের কাছেও এসেছে। একই বাক্য ঈশ্বর আমাদের জন্য দিয়েছেন।” পোপ মহোদয় আরো বলেছেন- “আশা করাটা আমাদের অধিকার। ভোরের আলোর সাথে সাথেই ‘আশা’ পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে।” একদল নারীই 'আশা'র বার্তাটির প্রথম দূত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিল। এটি নৈরাশ্যের হাত থেকে আমাদের উদ্ধারের এক বার্তা, আমাদের মনে কি আনন্দ, কি ভক্তির উচ্ছ¡াস- কীভাবে তা প্রকাশ করছি? অতিভোগ, অতিউৎসব, অতিপরিবেশন ও পানাহার অথবা আমাদেরকে নিখাঁদ বিশ্বাস, জীবন্ত আশা এবং কার্যকরী দানশীলতার জীবন যাপনে সমর্থ ক’রে তোলচ্ছে। 

৫. পুনরুত্থানেরই একটি ঐশদান- 'আশা'। সবকিছুর শেষে অশুভকে পরাজিত করে শুভ জয়ী হবে এমন আশাবাদ এটি নয়। বরং এটি পিতা ঈশ্বরের কাছ থেকে আগত অনুগ্রহদান ‘আশা’। এটি একটি ঐশদান যা আমরা নিজেরা অর্জন করিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বলে থাকি আগামী সপ্তাহ বা কয়েকদিনের মধ্যে করোনাভাইরাস বাহাদুরি সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে করতে শুরু করেছি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে কিন্তু বিগত সপ্তাহগুলোতে আমরা অভিজ্ঞতা করেছি, সময় অতিবাহিত হয়েছে তথাপি আমাদের এমন আশাবাদ অর্থহীন প্রমাণিত। যিশুর প্রদত্ত আশা ভিন্ন সংবাদ দেয়। তিনি আমাদের অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস দিয়েছেন, ঈশ্বর সমস্ত কাজের সমাপ্তিতে ভালো কিছু সমাধান দিবেন। কারণ ‘কবর’ থেকেও তিনি ‘জীবন’ ফিরিয়ে এনেছেন। এই দুর্যোগের পরে পরিবেশ আরো ভাল হবে, তিনি আমাদের পরিচালনা করবেন। “ঈশ্বর যিনি শূণ্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তিনি পৃথিবীতেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন এবং সব ধরণের অমঙ্গলকে পরাস্ত করতে পারেন। অন্যায্যতা অজেয় নয়” (লাউদাতো সি - ৭৪)। অফুরন্ত আশা, গভীর বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে পিতা ঈশ্বরে দান গ্রহণে অপেক্ষা করি। প্রার্থনা, দয়াকাজ ও ত্যাগম্বীকারের মাধ্যমে আমাদের বিশ্বাস, আশা ও ভালবাসা নবায়িত হতে দেই। 

৬. পোপ ফ্রান্সিস অনুধ্যানে বলেছন- “তিনি হৃদয়ের পাথরও সরিয়ে দিতে পারেন। একটি কবর থেকেই জীবন আবির্ভূত এটাই আমাদের আশা। যিনি এমন এক স্থান থেকে আবির্ভূত হয়েছেন, সেখান থেকে কেউ কখনও আবির্ভূত হয়নি- এটি কবর। যিনি সমাধির প্রবেশদ্বার বন্ধ করার পাথরটি সরিয়ে দিয়েছেন, এই দুর্যোগ সময়ে তিনি আমাদের ভারাক্লান্ত হৃদয়ের পাথরও সরিয়ে দিতে পারেন।” তিনি আমাদের ত্যাগ করেননি, তিনি আমাদের সাথে আবার সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি আমাদের বেদনা, যন্ত্রণা এবং মৃত্যুর মধ্যে প্রবেশ করেছেন। তাঁর আলো সমাধির অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আজ তিনি চান সেই আলো আামদের জীবনের অন্ধকারময় স্থানেও প্রবেশ করুক, কৃষ্ণকালো মেঘে ঢাকা বিশ্বেকে (দ্রষ্টব্যঃ ফ্রাটেল্লি তুত্তি) আলোকিত করুক। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে অস্বস্তিকর ও গুরভার দুশ্চিন্তা জয় করা য়ায়- “শান্ত-সমাহিত অনুভূতি নিয়ে জীবনকে দেখা, প্রতিটি মুহূর্তকেই ঈশ্বরের দান বলে গ্রহন করা (লা. সি.- ২২৬)। আমরা নিজেদের সমস্যার পাথর সরিয়ে দিতে খ্রিস্ট যিশুর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি, বারে বারে তাঁকে অনুরোধ করি, তিনি আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না। ‘ফ্রাটেল্লি তুত্তি’ প্রৈরিতিক পত্রে পোপ ফ্রান্সিস বাইবেলে বর্ণিত দয়ালু সামারীয়র উপমা কাহিনী ধ্যান করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন- আমরা যা অভিজ্ঞতা করি, এই কাহিনী তার মধ্যে একটা উজ্জ্বল আলোকরশ্মির মতো বিরাজ করছে। এই উপমা কাহিনী আমাদের স্মরণ ক’রে দেয় যে, পরিবারে যে স্বাভাবিক ভালোবাসার অভিজ্ঞতা হয়- তা আমরা অচেনা মানুষদের প্রতিও দেখাতে পারি। এই ভালোবাসা আমরা ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে প্রকাশ করে পরিবারভূক্ত হয়ে উঠতে পারি। ভ্রাতৃবোধ ও সামাজিক বন্ধুত্ব নবায়ন করে আমরা একে অন্যের হৃদয়ের পাথর সরিয়ে দিতে পারি।

৭. দুর্গতিতে ‘মনোবল’ পুনরুত্থানের একটি অনুগ্রহদান। আমাদের হৃদয়ে রাখা পাথরটি সরিয়ে দিয়েই আমরা যিশুর মনোবল গ্রহণ করতে পারি। পুনরুত্থিত খ্রিস্ট আমাদের মনের গভীরের ভয়টি অনুভব করতে পারেন। পোপ মহোদয় বলেছেন- “খ্রিস্ট আমাদের সাহস দিচ্ছেন, তিনি আমাদের জীবন এবং আমাদের মৃত্যুতেও আমাদের সামনেই চলছেন। তিনি আমাদের আগে গালিলেয়া যাচ্ছেন,  সেখানে তাঁর ও শিষ্যদের প্রতিদিনের জীবন, পরিবার ও কাজের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কাজ-কর্মে আশা নিয়ে আসতে চান।” শিষ্যদের জন্য গালিলেয়া স্মৃতিময় স্থান কারণ এখানেই তাদের প্রথম আহ্বান করেছেন। গালিলেয়া ফিরে আসার অর্থ তিনি আমাদের প্রথম ভালবেসেছেন ও আহ্বান করেছেন। রবিবার হচ্ছে পুনরুত্থানের দিন, নতুন সৃষ্টির “প্রথম দিন” যেখানে ঈশ্বরের সাথে, নিজের সাথে, অপরের সাথে ও বিশ্বসৃষ্টির সাথে আমাদের সম্পর্ক নিরাময় হয় (লা.সি.- ২৩৭)। আমরা স্মরণ করি- প্রথমবার কোথায় যিশুর আহ্বান পেয়েছি, প্রথমবার কখন বুঝেছি তিনি আমার পাশেই আছে, প্রথমবার যখন খ্রিস্ট প্রসাদ গ্রহন করেছি তখনকার অভিজ্ঞতা স্মরণ করি এবং আজও এ দুর্গতিতে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি।

৮. তিনি আমাদের আজ জগতের সর্বত্র প্রেরণ করছেন (মথি ২৮:১৯)। পোপ মহোদয় বলেছেন- “তিনি আমাদের শুধু পবিত্র স্থান গালিলেয়া নয় বরং পৃথিবীর সর্বত্র প্রেরণ করছেন।  আমরা যেখানে বসবাস করি সেখানেই তিনি আমাদের প্রেরণ করছেন।” তিনি চান তাঁর প্রতি বিশ্বাসী যারা সকলের নিকট আমরা ‘জীবনের মঙ্গলবার্তা’ পৌঁছে দেই। আমরা যারা জীবন বাণী অভিজ্ঞাতা করেছি তারা যদি জীবনের কথা না বলি তবে কে বলবে? খ্রিস্ট জীবন্ত। “তিনি কখনো আমাদের প্রত্যাখ্যান করেন না, তিনি আমাদেরকে একা ফেলে রেখে যান না, কেননা তিনি নিশ্চিতরূপে আমাদের এই পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন এবং তাঁর সেই ভালবাসা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন পন্থা খঁজে পাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দান করে” (লা. সি.- ২৪৫)। আসুন, এই যাত্রা পথে আমরা সুর মিলিয়ে গান করি। আমাদের এই কষ্টের যাত্রা, আমাদের এই সংগ্রামের যাত্রা যেন প্রত্যাশিত আনন্দ বিনষ্ট করতে না পারে। তিনিই আমাদের আশা, তিনিই আমাদের মনোবল। জয় মৃত্যুঞ্জয়, জয় তোমারই জয়।




প্রকাশিত: সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, সংখ্যা ১২, ৪-১২ এপ্রিল, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ